ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুসলমানরা আদায় করছেন নামাজ, হিন্দুরা দিচ্ছেন পূজা

বারো আউলিয়ার দরবারে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উদাহরণ

নিজস্ব সংবাদদাতা, বরিশাল

প্রকাশিত: ১২:৫৯, ৭ জুলাই ২০২২; আপডেট: ১৩:১৯, ৭ জুলাই ২০২২

বারো আউলিয়ার দরবারে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উদাহরণ

বারো আউলিয়ার দরবার শরীফ

তারা এসেছিলেন ইসলাম প্রচার করতে। সেই সুবাদে চন্দ্রদ্বীপের রাজা তাদের জন্য উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই উপহার ফেরত চাওয়া হয়। উপহার দিয়ে ফেরত নেওয়ার এই হীনম্মন্যতা মেনে নিতে পারেননি তারা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চলে যাবেন।

কথিতমতে, চলে যাওয়ার আগে অলৌকিক ক্ষমতায় মাটির সুড়ং থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য, পিতলের থালা, কাপড়, খাদ্যশস্য, জীবন্ত ঘোড়া উগড়ে দিয়ে সেই সুড়ং ধরেই গায়েব হয়ে যান বারোজন আউলিয়া। এ খবরশুনে জমিদার ঘোড়ার বহর নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুঁটে আসেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে যতটুকু এলাকায় আউলিয়াদের পা পরেছে, সেই জমি খাজনামুক্ত করে দেন। সুড়ঙের চারপাশে তুলে দেন প্রাচীর।

ক্ষমতার পালাবদলে হারিয়ে গেছে ‘বাঙাল’ রাজত্ব। ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ বাকলার চিহ্নও বিলীন। বাঙাল, বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপ কোনো সাম্রাজ্যই আর নেই। অতঃপর প্রতিষ্ঠা পাওয়া চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের আধ্যাত্মিক সাধকদের তীর্থস্থান বারো আউলিয়ার দরগাহ’র গোড়াপত্তনের কিংবদন্তি এভাবেই হয়েছে।

বাকলার রাজধানী কচুয়া বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। কিন্তু ইতিহাস, ঐতিহ্যের অমোচনীয় স্বাক্ষী আর মানবকল্যাণের স্মারক হয়ে আজও টিকে আছে বারো আউলিয়ার দরগাহ বা দরবার। এ দরবারে শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আনাগোনা নয়; সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও আসেন পূজা দিতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই দরবারে মুসলমানরা আদায় করছেন নামাজ, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দিচ্ছেন পূজা। ফলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অন্যান্য উদাহরণ হয়ে আছে বরিশালের বাকেরগঞ্জের বারো আউলিয়ার দরবার।

বারো আউলিয়াদের চলে যাওয়ার সেই সুড়ং মতান্তরে মাছিম শাহের কবর ঘিরে রাখা পাকুড়গাছের শিকড়ে-ডালে অসংখ্য পলিথিন এবং কাপড় বেঁধে রাখা হয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস, মনের আশা পলিথিনে বা কাপড়ে লিখে এই গাছের সাথে বেঁধে রাখলে তা পূরণ হয়। আবার আশা পূরণ হলে তা নিজ দায়িত্বে খুলে ফেলতে হয়।

গোড়াপত্তনের ইতিহাস ॥ বাকেরগঞ্জের বারো আউলিয়ার দরবার প্রতিষ্ঠার দুইধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সিরাজ উদ্দিন আহমেদের ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বরিশাল বিভাগের ইতিহাস’-এ সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসেবে তিনশ’ বছরের পুরোনো অর্থাৎ ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে দরবারে পালিত ৫৬৫ তম ওরশ মাহফিলের হিসেব অনুসারে রয়েছে ১৪৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। যদিও বারো আউলিয়ার দরবারের ওরশের বর্ষ হিসেব যে সঠিক, তা ঐতিহাসিকভাবে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উপঢৌকনের বিষয়ে জনশ্রুতি রয়েছে, বাকেরগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা আগা মুহাম্মদ বাকের খানঁ রাজার দেওয়া উপঢৌকন বারো আউলিয়ার কাছ থেকে ফেরত নিতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ সম্রাট আওরঙ্গজেব নতুবা তার দ্বিতীয় পুত্র মির্জা আজম শাহের মাধ্যমে বাংলার রাজত্ব পাওয়া মুর্শিদ কুলী খানের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত। কারণ ওইসময়ে বাকের খাঁন এই অঞ্চলের জমিদার বা বাদশায় নিযুক্ত কর্মচারী ছিলেন।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দিচ্ছে-পারস্য থেকে বাংলায় আসা অভিজাত সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন মির্জা আগা মুহাম্মদ বাকের খাঁন। তিনি ছিলেন বুজুর্গ উমেদপুর ও সলিমাবাদ পরগনার প্রভাবশালী জমিদার। মুঘল আমলে এ দুটি পরগনা (বর্তমানে বৃহত্তর বরিশাল জেলার) বিশাল অংশে বিস্তৃত ছিল। আগা বাকের ছিলেন নবাব সরফরাজ খানের অধীনে ওডিশার নায়েব নাযিম রুস্তুম জংয়ের জামাতা। ওডিশার অধিকার নিয়ে রুস্তুম জং ও আলীবর্দী খানের মধ্যকার সংঘর্ষে আগা বাকেরের দুঃসাহসী ভূমিকা ছিল।

১৭৪১ সালের ডিসেম্বরে আলীবর্দী খাঁন বিশেষ অভিযান চালিয়ে মহানদীর দক্ষিণ তীরে রায়পুর নামক স্থানে নবাব সরফরাজ খাঁনের অধিনস্ত মির্জা আগা মুহাম্মদ বাকের খাঁনকে পরাজিত করেন। ১৭৪২ সালের শুরুর দিকে আলীবর্দী খাঁনের কাছে আত্মসমর্পণ করেন বাকের খাঁন। তাকে বুজুর্গ উমেদপুর ও সলিমাবাদ পরগনার জায়গির প্রদান করা হয়।

১৭৫৪ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আগা বাকের তার জায়গিরে বহাল ছিলেন। আগা বাকের বুজুর্গ উমেদপুরে একটি বড় গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের নামানুসারে নাম দেন বাকেরগঞ্জ। বাকেরগঞ্জ তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে রূপ নেয়। যেখানে পারস্য, আর্মেনিয়া, কাশ্মীর থেকে বণিকরা লবণ ও চামড়ার ব্যবসা করতে আসতেন।

বাকের খাঁনকে পরাজিত করে জায়গির প্রদানকারী আলীবর্দী খান ছিলেন ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র মির্জা আজম শাহের দররবারের কর্মচারী। ১৭৪০ সালে তিনি দিল্লির রাজদরবারে অবস্থানরত বন্ধু মুতামানউদ্দৌলার সহযোগিতায় বাদশাহ মুহম্মদ শাহের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও ওডিশার শাসনভার গ্রহণ করেন।

এ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বারো আউলিয়ার দরবারটি ছিল মূলত আউলিয়াদের ধ্যানের জায়গা। স্থানীয় জমিদারের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলে সুড়ঙ্গ পথে নিরুদ্দেশ হন আউলিয়ারা। ভক্তরা মাজারের উত্তর পাশের সেই সুড়ঙ্গপথে দুধ ঢেলে দিতেন। যা কাছের একটি পুকুরে গিয়ে জমা হতো। সেই পুকুরটিকে বলা হয় দুধ পুকুর। আউলিয়ারা চলে গেলে স্থানীয় বিখ্যাত দরবেশ ফকির জালাল আরেফিন দরগাহ ও মাজারের তত্ত্বাবধান করেন। তবে দরবারের প্রতিষ্ঠাতা ফকির জালাল আরেফিনও নন। মূলত মাছিম শাহ নামে একজন পীরের বসবাসের স্থান ছিল ওই দরবার এলাকা। সেই মাছিম শাহ বারো আউলিয়াদের দক্ষিণাঞ্চলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বারো আউলিয়ার দরগায় এই মাছিম শাহের কবর রয়েছে।

একই দরবারে নামাজ ও পূজা ॥ পাকুড়গাছে আবৃত মাজারে প্রবেশের হাতের ডান দিকেই চোখে পরে একটি লম্বা আকৃতির কালো পাথর। পাথরের গায়ে তাজা সিঁদুর ও সরিষার তেল। এই পাথরটি নিয়ে সঠিক কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। কেউ এটিকে বলেন, শিব পাথর, অনেকে বলেন শিবলিঙ্গ। নতুন বিয়ের পর নির্ধারিত তিথিতে পাথরটির মাথায় সিঁদুর ও সরিষার তেল দিয়ে যান নবদম্পতি। দেবতা শিবের সন্তুষ্টির জন্যই এই অর্চনা।

দরবারের পূর্বপাশে রয়েছে নারীদের নামাজের স্থান। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন আমলে যে স্থানে মসজিদ ছিল, সেটি এখন বিলীন হয়ে গেছে। ওই আমলের একটি ঘাটলা ও দিঘির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের ধারণা, বর্তমানে যেখানে ঈদগাহ, সেখানেই ছিল মসজিদ ও ঘাটলা। যদিও এখন নতুন নকশায় আরেকটি দোতলা মসজিম নির্মাণ করা হয়েছে দরবারের মূল অংশে প্রবেশের মুখেই।

একই দরবারে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শিব পাথরে পূজা ও মুসলিমদের নামাজ আদায় নিয়ে কারো কোনো বিশেষ আপত্তি নেই।

মাজারের খাদেম ও মোতোয়ালিরা বলেন, বারো আউলিয়ার দরবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সবধর্মের মানুষের প্রার্থনার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তেমনি শত শত বছর ধরে চলে আসছে এ নিয়ম। হিন্দুরা তাদের রেওয়াজ মেনে পূজা-অর্চনা করে চলে যায়। মুসলমানরা নামাজ আদায়, কবর জিয়ারত করেন। এখানে দোল পূর্ণিমা, লক্ষী পূর্ণিমা ও অগ্রহায়ণ মাসের ১০ তারিখ ওরশ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

দরবারের দখল নিতে মরিয়া ॥ দরবার প্রতিষ্ঠার সঠিক ঐতিহাসিক প্রমাণাদি পাওয়া না গেলেও বর্তমানে দুটি পক্ষ নিজেদের বারো আউলিয়ার মোতোয়ালি ও খাদেম দাবি করে বিরোধে লিপ্ত রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দরবারের দানবাক্স ও লাখেরাজ সম্পত্তির ভোগদখলকে কেন্দ্র করেই এর সূত্রপাত। খাদেমদের দাবি, ১৯ একরের বেশি সম্পত্তি রয়েছে দরবারটির। যার অর্থমূল্যে কয়েক কোটি টাকা। এরমধ্যে সাড়ে তিন একর জমিতে দরবার ও কবর, দুটি স্কুল, জামে মসজিদ, নারীদের নামাজের স্থান, হিন্দুদের পূজার স্থান, দুধপুকুর, জলাশয় দখলে রয়েছে।

দরবারের মূল অংশে কবর রয়েছে ছাদের আলী ফকির নামে এক খাদেমের। তারই বংশধর ও এলাকাবাসীর করা দরবার পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে দীর্ঘদিন পরিচালনা করলেও দরবারের মোতোয়ালি দাবি করে বাউফল উপজেলার কালীশুরির বাসিন্দা সৈয়দ মোঃ খালেক শাহ তালুকদার চিশতি ২০০৩ সালের বরিশাল তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন।

এরই সূত্র ধরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াকফ এস্টেট প্রশাসক অতিরিক্ত সচিব এমএম তারিকুল ইসলাম দরবার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মামলা পরিচালনা ও এস্টেটের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার সাময়িক নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালে গঠিত সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন জেলা প্রশাসক ও সৈয়দ মোঃ খালেক শাহ তালুকদার চিশতি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

সেই নির্দেশনা অনুযায়ী খাদেমের বংশধরদের হটিয়ে মোতোয়ালি সৈয়দ মোঃ খালেক শাহ তালুকদার চিশতির প্রতিনিধি মাওলানা হেলাল উদ্দিন দরবারটির কিছু অংশ দেখভালের দখল নিয়েছেন। তবে দরবারের জমিতে নির্মিত মসজিদ পরিচালনায় নতুন কমিটি নিয়ে তুমুল দ্বন্ধ চলছে। এদিকে খাদেমের বংশধররাও দরবারে থাকেন। তারাও দেখভাল করেন। দরবারে দানের টাকায় দরবার পরিচর্যার পরও তিন লাখ টাকার ওপরে ব্যাংকে জমা রয়েছে বলে জানা গেছে।

দরবারের খাদেম আব্দুস সালাম ফকির বলেন, দরবারের মধ্যে যে মাজারটি করা হয়েছে, সেখানে আসলে কারও মরদেহ নেই। এই দরবারে বারো আউলিয়ার কেউ নেই। তারা ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন। বাদশাহর সাথে দ্বিমতে তারা মাটির সুড়ং কেটে মালামাল ফেরত দিয়ে গায়েব হয়ে যান। সেই সুড়ংয়ের মুখে স্মৃতিস্বরূপ মাজার নির্মাণ করা হয়েছে।

গাছের শিকড়ে পলিথিন বা কাপড় গিঁটের বিষয়ে জানতে চাইলে দরবারের সেবক আব্দুল লতিফ খান বলেন, দরবারে হিন্দুরা হিন্দুদের নীতি পালন করে চলে যান। আর মুসলিমরা আমাদের নিয়ম অনুসারে ধর্মকর্ম পালন করি। একই দরবারে দুই ধর্মের মানুষের প্রার্থনায় কোনো সমস্যা হয়না। এছাড়া সব ধর্মের মানুষ মনের আশা পূরণে গাছের শিকড়ে পলিথিন বা কাপড় গিঁট দেয়। পূরণ হলে তা খুলে ফেলে।

দরবারের মোতোয়ালি প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন বলেন, দরবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ধর্মের লোক এখানে আসেন। হিন্দু বা মুসলিম যারাই আসুক, তারা তাদের ধর্মের নিয়ম অনুসারে পালন করে চলে যান।

×