ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দাম নির্ধারণের পক্ষে সরকার

এ বছরও পানির দরে চামড়া কেনার পাঁয়তারা

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ১ জুলাই ২০২২; আপডেট: ২৩:৫২, ১ জুলাই ২০২২

এ বছরও পানির দরে চামড়া কেনার পাঁয়তারা

.

কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থকরী মূলত দেশের অসহায়-গরিব ও মা-বাবাহীন এতিমদের হক বা অধিকার। এ কারণে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা এবং এতিমখানার ছাত্রদের হাতে বিনামূল্যেই গবাদিপশুর চামড়া দিয়ে থাকেন কোরবানি দাতারা। কিন্তু সেই চামড়ায় ভাগ বসান ট্যানারি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মাঠ থেকে কোরবানির চামড়া কিনে নেয়া হয় পানির দামে। এবারও আসন্ন কোরবানি ঈদ সামনে রেখে পানির দরে চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ট্যানারি খাতের ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে নানা ধরনের সঙ্কটের কথা তুলে ধরে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারের বিভিন্ন দফতর ও অধিদফতরে চিঠি দিচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম কমানো। তবে কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও কোরবানির চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ রেখে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে বলে খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা নিয়ে এবারও দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে এ খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাজার সম্প্রসারণ, ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, পরিবেশগত মান বজায় রাখা এবং ফিনিশড লেদার উৎপাদনে সর্বোচ্চ কোয়ালিটি নির্ধারণের ওপর জোর দেয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। এ দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। সে সব বৈঠকে ব্যবসায়ীরা এ শিল্প খাত বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর ওপর  সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কোরবানির চামড়ার সঠিক দাম নির্ধারণের ব্যাপারে তারা আগ্রহী নন। এ কারণে এবার কোরবানির চামড়ার দর নিয়ে দেশে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে চামড়া খাতে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের এ খাতের সুনাম নষ্ট হয়েছে। চামড়া রফতানি বাড়লেও আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রাখার তাগিদ দিয়েছেন বিদেশী (বায়ার) ক্রেতারা।  বিদেশী ক্রেতারাও দেশে কাঁচা চামড়া সঠিক দাম নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। চামড়া খাতের উন্নয়ন নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে বৈঠক করা হয় সেখানেও বিদেশী ক্রেতারা এ বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পরিবেশগত মান বজায় রাখতে শতভাগ কমপ্লায়েন্স কারখানা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে।  কোরবানির চামড়ার মূল্য নির্ধারণে আগামী ৬ জুলাই বুধবার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে জরুরী বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে ও বৈঠকে স্টেকহোল্ডারদের উপস্থিতিতে কাঁচা চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয়া হবে। তবে এবারও প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যেসব ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তারা কাঁচা চামড়া রফতানি করতে চান তাদের আগেভাগে চিঠি দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার দাম নির্ধারণের পক্ষে। এ কারণে এবারও দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে। তিনি জানান, কোরবানি দাতারা যাতে না ঠকেন সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে। দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজার দরের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। তিনি জানান, চামড়ার বাজারে যাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে। এদিকে, চামড়ার বাজারের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে এ খাতের বিভিন্ন পযায়ের ব্যবসায়ীরা সংগঠনের প্যাডে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সেসব চিঠিতে তারা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চামড়ার কেমিক্যালের দাম বাড়া, পুরো ইউরোপজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার আভাস, দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ও গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, দেশে বিভিন্ন দফায় গ্যাস-বিদ্যুত, পানি ও লবণের দাম বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের সঙ্কটের কথা বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি সহজলভ্য করার দাবি রয়েছে ব্যবসায়ীদের।

তবে ট্যানারি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যেভাবে এ খাতের সঙ্কট সামনে নিয়ে আসছেন তাতে এবারও তারা পানির দরে চামড়া হাতিয়ে নিবে বলে মনে করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আসন্ন কোরবানি ঈদ সামনে রেখে চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে চিঠি চালাচালি করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবারও তারা কোরবানির চামড়া পানির দরে কিনে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সারাদেশে কমদামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও চামড়ার নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের  (বিএফএল-এলএফইএ) প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা মোঃ জয়নাল আবেদীন স্বাক্ষরিত পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন সংক্রান্ত একটি পত্র বিভিন্ন দফতর অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে তিনি বিভিন্ন সঙ্কটের কথা তুলে ধরে জানিয়েছেন, কোরবানি ঈদ সমাগত। কিন্তু বন্ড লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রাখার কারণে কারখানাসমূহ প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল আমদানি করতে পারছে না। ফলে কোরবানির সময় বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া ব্যবস্থাপনায় প্রচ- বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে। বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, অর্থবছর (২০২০-২১) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে রফতানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুটের দাম নির্ধারণ করে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সারাদেশে খাসির চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে গত বছর ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত এই দাম কার্যকর হয়নি কোরবানির চামড়ার বাজারে।

 

×