ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লন্ডন থেকে চিকিৎসা তদারকি করছেন ডাঃ জোবায়দা

খালেদা মুক্তি পাওয়ায় বিএনপির সর্বস্তরে স্বস্তি

প্রকাশিত: ১০:২৮, ২৭ মার্চ ২০২০

খালেদা মুক্তি পাওয়ায় বিএনপির সর্বস্তরে স্বস্তি

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখনই মুক্তি পাবেন এমন আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন দলের নেতাকর্মীরা। রাজপথে আন্দোলন ও আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ভর করে হতাশা। তবে স্বজনদের বিরামহীন চেষ্টার ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি সাময়িক মুক্তি পাওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ দুই বছর দেড় মাস দলের যে সব নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারাও এখন নড়েচড়ে বসেছেন। এদিকে গুলশানে নিজ বাসা ফিরোজায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সার্বিক তদারকি করছেন লন্ডন প্রবাসী পুত্রবধূ ডাঃ জোবায়দা রহমান। বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে এক ভিডিও বার্তায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর মা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ায় শুকরিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশে গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে এটি অবশ্যই আনন্দ ও স্বস্তির খবর। সন্তান হিসেবে এজন্য আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ভিডিও বার্তায় তারেক রহমানের স্বস্তি প্রকাশের কথা জানান। এ ছাড়া রুহুল কবির রিজভীও খালেদা জিয়ার মুক্তিতে স্বস্তি প্রকাশ করেন। কুমিল্লার তৃণমূল বিএনপি নেতা আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি নিঃসন্দেহে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জন্য স্বস্তির খবর। দীর্ঘদিন তাঁর মুক্তির অপেক্ষায় ছিল নেতাকর্মীরা। মুক্তি পাচ্ছে না দেখে আমরা হতাশ হই। তবে এখন তিনি মুক্তি পাওয়ায় আমরা স্বস্তি প্রকাশ করছি। ঢাকার গুলশান থানার বিএনপি কর্মী আব্দুল করিম বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় আমরা হতাশ ছিলাম। ছয় মাসের জন্য তাঁর মুক্তিতে আমরা স্বস্তি পেয়েছি। আশা করব সরকার তাঁকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দেবেন। বৃহস্পতিবার খুলনা মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে তারা খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘ জীবন কামনা করেন। বিবৃতিদাতারা হলেন খুলনা মহানগর বিএনপির নেতা ও বিএনপি চেয়াপার্সনের উপদেষ্টা এম নুরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি প্রমুখ। এ ছাড়াও সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তিতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। এর আগে বুধবার বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসায় পৌঁছার পর তাঁর বোন সেলিমা ইসলাম, ভাই শামীম ইস্কান্দারসহ স্বজনরা স্বস্তি প্রকাশ করেন। এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারাও স্বস্তি প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসার সামনে অবস্থান করা সাধারণ নেতাকর্মীরাও স্বস্তি প্রকাশ করেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখন রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে বিরত রয়েছেন। চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া তিনি কারও সঙ্গে কোন কথাও বলছেন না। আর তাঁর খাবারসহ ব্যক্তিগত জরুরী প্রয়োজনে সহযোগিতা করছেন কাজের মেয়ে ফাতেমা। গুলশানে নিজ বাসা ফিরোজায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সার্বিক তদারকি করছেন লন্ডন প্রবাসী পুত্রবধূ ডাঃ জোবায়দা রহমান। ছয় সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চললেও লন্ডন থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানই চিকিৎসা সংক্রান্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। জানা গেছে, দুই বছর দেড় মাস পর বাড়ি ফিরে মানসিকভাবে শক্তিশালী বোধ করছেন খালেদা জিয়া। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন তিনি। এ সময় দলের নেতাকর্মীদের বাসায় আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া আত্মীয়-স্বজনকেও না আসার কথা বলেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীরা বাসার ভেতর সর্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তবে বাসার বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নিরাপত্তা দিচ্ছে বলে জানা গেছে। খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ওনার এখনও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ভাল করে কথা বলতে পারছেন না, উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। হাঁটতে পারছেন না, বেশিক্ষণ বসেও থাকতে পারছেন না, গায়ে হাত দিলেই ব্যথা লাগছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করতে পারছেন না, খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে। মুভ করানোর মতো অবস্থা নেই। তারপরও তিনি এখন বাসাতেই থাকবেন। বুধবার দুই ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ শেষে আগের চিকিৎসা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয় ছয় সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়াম্যান ডাঃ এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন পর বাসায় ফিরে আত্মীয়-স্বজন ও বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখার পর মানসিকভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। বৃহস্পতিবার থেকে তিনি ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে আছেন। তবে ওনার চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও নার্স রয়েছে। তারা উনাকে দেখাশোনা করবেন। এ ছাড়া বিএসএমএমইউ-তে যে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল সেগুলো কিছুটা মডিফাই করা হয়েছে। শারীরিকভাবে খারাপ অবস্থায় থাকলেও আগের চেয়ে কিছুটা ভাল আছেন। জানা যায়, বুধবার রাতে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কুশলবিনিময়কালে খালেদা জিয়া সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে সাবধান থাকতে বলেছেন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাসার বাইরে না আসতে বিশেষ করে তাঁর নিজের বাসা ফিরোজায় যেন আপাতত কেউ না আসে তাও জানিয়ে দেন। দুর্নীতির মামলায় দুই বছর দেড় মাস কারাভোগের পর বুধবার মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য তাঁর ভাই শামীম ইস্কান্দারের জিম্মায় মুক্তি দেয়া হয়। এর আগে মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার তাঁর বয়স বিবেচনায় মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে এবং বয়স ও মানবিক বিবেচনায় ৪০১ ধারায় শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তির কথা জানান তিনি। মুক্তিকালে তার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত থাকবে এবং তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং বিদেশ যেতে পারবেন না এমন শর্তে মুক্তির কথাও তিনি জানান। আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কারামুক্তির প্রক্রয়া শুরু হয়। এর পর তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যায়। ফাইলে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে সেই ফাইল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে কারা অধিদফতরে পৌঁছায়। পরে কারা অধিদফতরের মুক্তির প্রক্রিয়া শেষ করে বিএসএমএমইউ’র প্রিজন সেল থেকে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি নেতারা রাজপথে আন্দোলন ও আইনী লড়াইয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর দলের সর্বস্তরে হতাশা বিরাজ করে। এমন পরিস্থিতিতে বেশ ক’দিন আগে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য মুক্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, কোন সেলিমা ইসলাম ও বোনের জামাই রফিকুল ইসলাম। তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছেও একটি আবেদন করেন। এর পরই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা হয়। ওইদিন থেকেই পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। পরে হাইকোর্ট তাঁর সেই সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদ-াদেশ দেন। একই বছর ২৯ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ৭ বছরের সাজা হয়। দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে তিনি কারাবন্দী। গত বছর ১ এপ্রিল থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ৬২১ নম্বর কেবিনে কারা নজরদারিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
×