ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা নিয়ে ‘এসএ সেভেন’ সানজিদা

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৬ মার্চ ২০২০

করোনা নিয়ে  ‘এসএ সেভেন’ সানজিদা

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে মেয়েটি। একদিন টিফিনের সময় স্যার তাদের মাঠে নামান। বলেন ফুটবল খেলতে। অথচ খেলাটির কিছুই বোঝে না মেয়েটি। এমনকি নারী ফুটবলাররাও যে বুট পরে খেলেন, এটাও জানা ছিল না তার! জীবনে কোনদিন ফুটবলে পা দিয়ে লাথিই মারেনি। প্রথমবারের মতো যখন ফুটবলে লাথি দিল, তখন তার সে কি ভীষণ লজ্জা! কিন্তু ম্যাডাম আর স্যাররা সাহস জোগাতেন তাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সেই মেয়ের স্কুল হয়েছিল সেরা। ময়মনসিংহ জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বঙ্গমাতা ফজিলাতুনন্নেসা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০১৩ ও ২০১৪ সালের জাতীয় চ্যাম্পিয়শিপে। নাসরিন একাডেমির হয়ে খেলেছে ঢাকা মহানগর লীগে। এর পরেই ডাক পায় অনুর্ধ-১৬ জাতীয় ফুটবল দলে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের ইতিহাসে সাফল্যের নজির স্থাপন করেছিলো মেয়েটি। এএফসির সেরা দশ মহিলা ফুটবলারের তালিকায় ছিল তার নামটি (সপ্তম স্থান)। যে মেয়েটির কথা বলছি, অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সবচেয়ে সুন্দরী ফুটবলার হচ্ছে এই মেয়েটি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। সানজিদা আক্তারের কথাই বলছি। গত ২০ মার্চ উনবিংশতম জন্মদিন পালন করা এই তারকা ফুটবলার শুধু ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুরের কৃষক বাবা লিয়াকত আলী এবং গৃহিণী মা জোছনা খানমেরই গর্ব নন, তিনি সারাদেশেরই গর্ব। অথচ ক্লাস ফোর থেকে যখন প্রথম ফুটবল খেলা শুরু, তখন তার পরিবারই খেলাটি খেলতে বাধা দিয়েছিল তাকে! এমনকি বাবা তাকে বাল্যবিয়ে দেয়ারও কথাও ভেবেছিলেন! তার ৪ মেয়ে, ২ ছেলে। সানজিদা হচ্ছে তার তৃতীয় কন্যা। এই কন্যাই আজ সংসার চালাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পতুর্গাল সুপার স্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর অন্ধভক্ত সানজিদা। রোনাল্ডোর মতো তিনিও জাতীয় দলে পড়েন ৭ নম্বর জার্সি। মহিলা ফুটবল লিগে বসুন্ধরা কিংসের সানজিদার জার্সি নম্বর এখানেও ৭! ফেসবুকে অনেকেই সানজিদাকে ‘এসএ সেভেন’ নামে ডেকে থাকেন। রাইট উইঙ্গার পজিশনে দুরন্ত গতিতে খেলা সানজিদা নিজে গোল করার চেয়ে সতীর্থদের দিয়ে গোল করাতেই ভালবাসেন। খেলাতেই যার আনন্দ, সেই সানজিদার মন ভাল নেই। থাকবে কিভাবে? ভয়ংকর করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের সব খেলাধুলা যে বন্ধ। ফলে ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত মহিলা ফুটবল লিগের খেলাও বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। বসুন্ধরা কিংসও তাদের ক্যাম্প বন্ধ করে ফুটবলারদের ছুটি দিয়েছে। দলটির মহিলা ফুটবল দলের কোচ মাহমুদা শরীফা অদিতিও গাইবান্ধায় নিজের গ্রামে চলে গেছেন। যাওয়ার আগে শিষ্যাদের বলে দিয়েছেন পারলে যেন তারা অনুশীলন করে ফিটনেস ধরে রাখে। তবে ১৯ মার্চ নিজের গ্রামের বাড়িতে এসে সানজিদা অনুশীলন করতে পারছেন না। কারণ সামনেই তার এইচএসসি পরীক্ষা। দিনরাত পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে জানান, ‘আমি, শিউলি, মারিয়া পরীক্ষা দেব। তাই পড়াশোনা নিয়েই আছি। ছুটিতে আসার আগে আমরা বসুন্ধরা কিংসের চারজন বাফুফে একাডেমিতে গিয়েছিলাম আমাদের পাঠ্যবইগুলো আনতে। কোচ ছোটন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতো তিনিও বলেছিলেন গ্রামে গিয়ে যেন ব্যায়াম করে ফিটনেস ঠিক রাখি। কিন্তু এখানে এসে পড়াশোনার চাপে তা করতে পারছি না।’ করোনা ভাইরাস কলসিন্দুরে কেমন প্রভাব ফেলেছে জানতে চাইলে সানজিদা বলেন, ‘এখানে সবাই যেমন সর্তক, তেমনি আতংকিতও বটে। আমি নিয়মিত হাত পরিস্কার করি, বাইরে গেলে মুথোশ পড়ি। আমাদের এখানে এখনও কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়নি, এটাই স্বস্তির। পত্রিকা ও অনলাইন পড়ে করোনার সর্বশেষ খবরাখবর রাখার চেষ্টা করি।’ সানজিদা আরও যোগ করেন, ‘আসলে এই ভাইরাস আল্লাহর সৃষ্টি। তিনিই এই রোগ দূর করার ব্যবস্থা করবেন। তবে আমাদেরও সতর্ক-সচেতন থাকতে হবে।’ থানকুনি পাতা খেলে করোনামুক্ত থাকার যে গুজব, এ নিয়ে সানজিদার ভাষ্য, ‘এগুলো বিশ্বাস করি না। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি ও সচেতন থাকি।’ বিদেশ-ফেরত বাংলাদেশীরা দেশে ফিরে নিয়ম না মেনে করোনার বিস্তার ঘটাচ্ছেন, সরকারের ১০ দিনের ছুটি ঘোষণায় সবাই দলবেঁধে গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছে ... এগুলো দেখেশুনে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ সানজিদা, ‘আসলে অশিক্ষিতরাই এসব করে। আমি বুঝি না সরকার তো ছুটি দিয়েছে যে যে অবস্থানে আছে, সেখানেই থাকার জন্য। কিন্তু তারা ভিড় করে গাদাগাদি করে গ্রামে যাচ্ছে কেন? এতে করে তো তারা করোনায় আক্রান্ত হবে, গ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষ এবং ঢাকায় ফিরে সেখানকার মানুষকেও সংক্রমিত করবে। বাঙালীরা এগুলো কবে বুঝবে?’ স্থানীয় পুলিশ এসে প্রতিটি বাড়িতে এসে চেক করে ফ্রিজে ময়লা কিছু আছে কি না, কেউ অসুস্থ কি না, এমনটাই জানান সানজিদা। মহিলা ফুটবল লিগ এখন বন্ধ। বন্ধ হওয়ার আগে ৫ খেলার প্রতিটিতেই জিতে সর্বোচ্চ ৫১ গোল ও ১৫ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে ছিল বসুন্ধরা। লিগ বন্ধ, কিংসের খেলোয়াড়রাও ছুটিতে বাড়িতে বসে ফিটনেস হারাচ্ছেন। পরে আবার লিগ শুরু হলে শুরুর সেই ছন্দ ধরে রাখতে পারবে তো? ‘ফিটনেস সমস্যা তো শুধু আমাদের না, সব দলেরই হবে। কাজেই এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই।’ সানজিদার ব্যাখ্যা। লিগ শুরু হলেই এইচএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়ে যাবে। তখন বেশকিছু ফুটবলারের সার্ভিস পাবে না কিংস। এতে কি দল দুর্বল হয়ে যাবে না? এ প্রসঙ্গে সানিজদার ভাষ্য, ‘আমার মনে হয় না। কারণ আমরা ৭-৮ জন পরীক্ষার জন্য খেলতে না পারলেও বাকিরা তো পারবে। তারাই জেতাবে দলকে। এ নিয়ে আমি আশাবাদী।’ জাতীয় দলের সব ফুটবলারই কিংসে খেলেন। ফলে লিগে তারাই চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছেন অনায়াসেই-এমনটা যারা ভাবেন, তাদের উদ্দেশ্যে সানজিদা বলেন, ‘উত্তরবঙ্গ, নাসরিন ... ওরাও ভাল দল। তাছাড়া এখনও লিগের অনেক খেলা বাকি। আমরা শক্তিশালী হলেও আমরাই যে চ্যাম্পিয়ন হবো, এমনটা বলা ঠিক নয়।’ গত ২০ মার্চ সানজিদা নিজের জন্মদিন পালন করেছেন সাদামাটাভাবে, ‘জন্মদিনে ছোটন স্যারসহ অনেকেই উইশ করেছেন। বাড়িতে পিঠা ও পায়েশ রান্না করা হয়েছিলা জন্মদিনে। মারিয়াকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। কিন্তু ও আসতে পারেনি। আমরা পরিবারের সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করেছি।’ সবশেশে জনকন্ঠের পাঠকদের উদ্দেশ্যে সানজিদা বলেন, ‘সবাই যে যার ধর্ম পালন করবেন এবং সতর্ক থেকে নিয়ম মেনে চলবেন। তাহলেই করোনা থেকে বাঁচতে পারবেন।’
×