ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু, অগ্নিঝরা মার্চ স্পন্দিত বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১০:০৩, ২৬ মার্চ ২০২০

বঙ্গবন্ধু, অগ্নিঝরা মার্চ স্পন্দিত বাংলাদেশ

‘মার্চ’ স্বাধীনতার মাস। বাঙালীর জাগতিক দ্রোহের অবিনাশী চেতনায় উৎসারিত কৃতাঞ্জলি। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পবিত্র জন্ম তারিখ মার্চ ১৭। ৭ মার্চ কালোত্তীর্ণ স্বাধীনতার ভাষণ। ২৬ মার্চ বাঙালী জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রতিটি দিনক্ষণ ছিল জাতাঙ্কুর কালাতিপাত। দূরীভূত ঘটনার সৃজিত পঞ্জিকার প্রাসঙ্গিকী। মহান মুজিব শতবর্ষের উদযাপন পরিক্রমায় ২০২০ সালের ২৬ মার্চ অর্থবহ স্বাধীনতার মাঙ্গলিক প্রার্থনায় নিরবচ্ছিন্ন উত্তমাশায় ভাস্বর। দুঃখজনক হলেও সত্য; সাম্প্রতিক সময়কাল পুরোবিশ্ব প্রাণঘাতী নোভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে আতঙ্ক-আশঙ্কায় নিগূঢ় প্রকম্পিত। জীবন বিধ্বংসী এই রোগের প্রাদুর্ভাব বিশ্ববাসীকে করেছে অজানা আশঙ্কায় বিনিদ্র। বাঙালীর প্রাণিত দিবসসমূহের মধ্যে মার্চ মাসে উল্লেখ্য তিনটি তারিখ যারপরনাই প্রোৎসাহিত। সকল দলমত-জনগোষ্ঠী সমর্থনপুষ্ট বাংলাদেশ সরকারের নৈর্ব্যত্তিক মনন সিদ্ধান্তে মুক্তির মহানায়ক, বাঙালী জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, প্রাবাদিক দেশপ্রেম-আদর্শ-চেতনা-দর্শনের প্রারব্ধ নৈবেদ্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কিছুটা ম্রিয়মাণ হলেও বিশ্বব্যাপী সকল বাঙালীই অবিস্মরণীয় সংকীর্তনে ছিল অব্যাহত। ইত্যবসরে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংস্থার নেতাদের নোভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ-পরিত্রাণে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং সার্ক তহবিল গঠনও অর্থ ব্যয়ের সমন্বিত প্রায়স নির্ধারণ সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা ১৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় ‘করোনাভাইরাস নিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করবেন না, শক্ত থাকুন। সচেতন হোন। রেডিও-টেলিভিশনসহ অন্য মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ান। মানুষকে বুঝিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’ সতর্কতা অবলম্বনে সরকার প্রধানের পরিচিন্তন নির্দেশনা ও বাচনিক চিত্তাকর্ষ মনোবৃত্তি তৈরিতে অবশ্যই অনন্য ভূমিকা পালন করবে। অধিকন্তু দ্রুততম সময়ের মধ্যে অকৃত্রিম আন্তরিকতায় কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, থার্মাল স্ক্যানিং, পর্যাপ্ত পরীক্ষণ কিট প্রস্তুত ও সংগ্রহসহ প্রবাসীদের যথার্থ সতর্কতামূলক বার্তা, পরামর্শ, আইনানুগ উদ্যোগ জনগণকে স্বাধীন মাতৃভূমির স্বাধীন সত্তায় উদ্ভাসিত হওয়া এবং স্বাধীনতার এই মাস নির্মোহ মূল্যায়নে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের উদাহরণ হবে। এটি সর্বজনবিদিত যে, বঙ্গবন্ধুর শুভ জন্মেই প্রোথিত ছিল স্বাধীন বাংলার উৎসাঞ্জলি। বিশ্বকবি রবিঠাকুরের অমর ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার বর্ণিত পঙক্তিগুলো যেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শ্বাশত সোৎসাহ আশীর্বাদ- ‘কবি দিল আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে,/‘জয় হোক মানুষের, ঐ নবজাতকের, ঐ চিরজীবীতের।’/সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী, জ্ঞানী এবং মুঢ়-/উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করল : ‘জয় হোক মানুষের, ঐ নবজাতকের, ঐ চিরজীবীতের।’ আজ বিশ্বব্যাপী বাঙালী বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু উপাধিতে অভিসিক্ত করে স্বাধীন বাংলার ভৌগোলিক পরিসীমা, সবুজ-নদীবিধৌত ভূখ-, লাল সবুজের পতাকা, বস্তুনিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাঙালীর আত্মত্যাগ, আত্মমর্যাদা এবং আত্মসম্মানকে সমগ্র বিশ্ব করেছে সুমহান সম্মানিত ও মর্যাদাসীন। ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্যকেন্দ্রিক বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচিত হয়েছিল দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অধিকার আদায়ের সকল আন্দোলন-সংগ্রামের মৌলিক নির্যাস ছিল অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। অপকৌশল বা আপোসকামিতার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, সৎ ও সত্যবাদী সুদূরপ্রসারী বিচক্ষণ জাত্যভিমান বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হতে শক্তি ও সাহসে প্রাণিত করেছে। বহিঃ ও অন্ত-উপনেশিক শোষণ-শাসন-নীপিড়ন-নিষ্পেষণ কালক্রমে বাঙালী জাতিকে করেছে নির্বিশঙ্ক। নির্বৃত নেতৃত্বে প্রবুদ্ধ জাতি উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ইন্দ্রজালিক বিজিগীষায় হয়েছে বিস্ফোরিত। অতীত অন্ধকারকে নিধন করে বিস্ময়ান্বিত আলোকে সমুজ্জ্বল হওয়ার ব্রতকে ধারণ করেছে নিবিড় আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে। ত্যাগের ভয়কে করেছে জয় এবং মরণাঘাতকে অপরাজিত করে এগিয়ে নিয়ে গেছে স্বাধীনতার শিখা অনির্বাণ। কালজয়ী ৭ মার্চ পরিপূর্ণ মেধাদীপ্ত সুকৌশলে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বহুল প্রত্যাশিত ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ ঘোষণার পরিবর্তে ১৯ মিনিটের অলিখিত ১৩০৮ শব্দের বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের শেষ বার্তা ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কী অসাধারণ শব্দচয়ন, দৃঢ়কণ্ঠ উচ্চারণ, আপামর জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট ও রণকৌশলের যথার্থ দিকনির্দেশনার পূর্ণতায় ছিল আবেগ-আকাক্সক্ষার সমীক্ষণ। সর্বসম্মতভাবে মার্কিন ইতিহাসে একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিউইয়র্কে ওয়ালস্ট্রিটের ফেডারেল হলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেছিলেন, ‘প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি এমন নজির সৃষ্টি করব, যা সারা দেশের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।’ মার্কিন সংবিধানের প্রথম প্রবক্তা জন ম্যাডিসনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি এমন নজির স্থাপন করব, যা ন্যায়নীতির সমুজ্জ্বল পাথেয় হিসেবে মানবজাতির আদর্শ হয়ে থাকবে।’ অনুরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক-গণতান্ত্রিক আদর্শ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উপস্থাপিত হয়েছিল যখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ তারও বহু আগে ১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘গবর্নর ও গবর্নর জেনারেলের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। এই ক্ষমতার বিধান রাখা হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা পূর্ণমাত্রায় থেকে যাবে। কারণ, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পদে পদে দুর্নীতি বয়ে আনবে।’ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বশীর্ষ মহানায়কদের ভাষণে এই ধরনের বিশেষিত বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি একান্তই বিরল। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সামরিক জান্তার কারাগারমুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি তাঁর স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া যেতে পারে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতাও ব্যর্থ হয়ে যায়।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘কেবল আওয়ামী লীগের সরকার চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে দরকার জনগণেরও সরকার। সাড়ে সাত কোটি মানুষ, মানুষের সরকার। এটা সম্বন্ধে পরিষ্কার থাকা দরকার। আপনাদের কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানকে সুশৃঙ্খল করতে হবে।’ উল্লেখ্য ভাষণে অমিয় বার্তা ছিল, ‘বিরোধী দলে থাকা এক রকমের পন্থা, আর সরকারের পক্ষে রাজনীতি করা অন্যরকম পন্থা এবং সেখানে গঠনমূলক কাজের দিকে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে, অত্যাচার অবিচার যেন না হয়। জুলুম যেন না হয়, লুটপাট যেন না হয়। দেশের মানুষকে সেবা করে মন জয় করতে হবে।... দুঃখী মানুষের হাসি ফোটাতে হবে। ... ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করে নাই। বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্যই আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করেছে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে।... লোভের উর্ধে উঠতে হবে। লোভ যেখানে ধ্বংস সেখানে। একবার যদি কেউ লোভী হয়ে যান, সে জীবনে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন মাতৃভূমির শুধু স্থপতি ছিলেন না, মুক্তির মহানায়ক হিসেবে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ অর্থাৎ বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে নিরন্তর আধুনিক প্রাগ্রসর সমাজের প্রণোদিত রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সুযোগ্য তনয়া বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রমে দূরদর্শী সফল রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব পালন করে দেশকে অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে সমাসীন করেছেন। স্বাধীনতার এই মাসে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও পরিবারের সকল শহীদান, জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রাণ বিসর্জনকারী ত্রিশ লাখ বাঙালী এবং সর্বোচ্চ ত্যাগী দুই লাখ জননী, জায়া, কন্যার প্রতি অজস্র বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×