ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবার দরোজায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্বদানব

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৫ মার্চ ২০২০

এবার দরোজায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্বদানব

বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। মরিনি। মনে হয়েছিল বয়স যখন আশির উর্ধে তখন স্বাভাবিক মৃত্যুই হবে। কিন্তু ঢাকাতেও এখন করোনাভাইরাসের আগমন। তার মধ্যেও আমার বন্ধু ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর এবং পরিচিত জন সুলতানা জামানের মৃত্যু হয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যু, করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়নি। এখন লন্ডনে যেভাবে করোনার দাপট বাড়ছে, তাতে আমি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে পারব কিনা জানি না। ১৯৭১ সালের মৃত্যু আতঙ্কের চাইতেও এবারের মৃত্যু আতঙ্ক বেশি। তখন যুবক ছিলাম। বর্ডার পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ারও একটা পথ ছিল। এবার পালাবার কোন পথ নেই। ভাইরাস থেকে অন্য দেশে পালিয়ে বাঁচব তার উপায় নেই। সারা বিশ্বে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দুই-ই ভয়াবহ। সারা ব্রিটেনে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে ৭০-এর ওপরের বয়সী লোকেরা বিরাট ঝুঁকিতে আছেন। আমার ঝুঁকিটা আরও বেশি। একে আশির ওপরে বয়স, তার ওপর করোনার বন্ধু সব রোগই আমার আছে। যেমন, ডায়াবেটিস, কিডনি ও গ্যাসট্রিকের রোগ। ডাক্তারেরা তাই চার মাস গৃহে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। কোন বন্ধু বান্ধবকে ঘরে ডাকা যাবে না। খাবার পর্যন্ত বাছাই করে খেতে হবে। দোকানপাট স্কুল কলেজ সব বন্ধ। রাস্তাঘাট জনশূন্য। আইরিশ সন্ত্রাসীদের ব্যাপক সন্ত্রাসের সময়েও লন্ডনের রাস্তা, দোকানপাট এমন জনশূন্য দেখিনি। এই জনশূন্য লন্ডন মনে আরও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে। টেলিফোনে বন্ধু বান্ধবেরা খোঁজ নেন। আমিও নেই। আমার মতো সকলেরই ভীত আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর, কেমন আছেন? বলি, ভাল আছি। কণ্ঠের আতঙ্ক ঢাকা থাকে না। বার্নাড শ’ ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। মারা যাওয়ার কিছু আগে নার্সকে ডেকে বলেছিলেন, ‘নার্স, এবার যদি আমি না মরি, তাহলে আর মরবো না।’ আমিও নিজের মনে মনে বলি, এবার করোনা ভাইরাসে যদি না মরি তাহলে আর মরব না বলি না। তবে নব্বই পর্যন্ত টিকে যাব। করোনার আতঙ্ক বাংলাদেশে ’৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদারদের বর্বর হত্যাকা-ের সময়ের আতঙ্কের চইতেও বেশি। কিন্তু এই দুই আতঙ্কের মধ্যে একটা মিলও আছে। ১৯৭১ সালের পয়লা জুন পর্যন্ত আমি ঢাকায় ছিলাম। কারফিউর মধ্যে গৃহবন্দী অবস্থা। একমাত্র সান্ত¡না স্ত্রী, ছেলেমেয়ে তখন গ্রামের শ্বশুর বাড়িতে। কিন্তু আতঙ্ক, কখন ঘরের দরোজায় টোকা পড়ে। জামায়াতিরা তখন রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছে। যেসব বাঙালী লেখক ও সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে তাদের নামের তালিকা তাদের হাতে। সেই তালিকা দেখে পাকিস্তানের হানাদারেরা একেকদিন একেক বাড়িতে গভীর রাতে গিয়ে দরোজায় টোকা দেয়। যাকে নিয়ে যায় সে আর ফেরে না। একাত্তরের এই আতঙ্কের চাইতেও ২০২০ সালের এই করোনাভাইরাসের আতঙ্ক আরও বেশি। তার হাত থেকে পালানোর সুযোগ নেই। সে গভীর রাতে ঘরের দরজায় টোকা দেয় না। নিঃশব্দে আসে। নিঃশব্দেই প্রাণ হরণ করে। যাদের করে না তারা সৌভাগ্যবান। মানবতা ও মানব সভ্যতার এতবড় বিপদ আগে কখনও এসেছে বলে জানি না। নূহ নবীর আমলে বিরাট প্লাবন এসেছিল বলে শোনা যায়, তাও বিশ্বব্যাপী নয়। তার ওপর প্রাণীকূলের নূহ নবীর নৌকায় আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ ছিল। এবার কে কোথায় আশ্রয় নেবে? সুদূর চীনে যেমন হাজার হাজার লোক মরেছে, মরছে ইতালিতে, মরছে সংখ্যায় কম হলেও ব্রিটেনে, ভারতে, বাংলাদেশেÑঅর্থাৎ বিশ্বের সব দেশে, এমনটা আর কখনও ঘটেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে মহামারী এসেছে। যেমন, বাংলাদেশে এসেছিল ম্যালেরিয়া ও কলেরার মহামারী, তা বিশ্বব্যাপী ছড়ায়নি। এবার করোনার প্রকোপ বিশ্বব্যাপী। মনে হয় বিশ্বায়নের যুগে মহামারীরও বিশ্বায়ন ঘটেছে। কেউ জানে না আমেরিকা ও চীনের জীবাণু অস্ত্র তৈরির গোপন গবেষণাগার থেকে এই বিশ্বধ্বংসী রোগ ছড়িয়েছে কিনা! এই রোগ প্রথম যখন চীনে ও ইরানে ভয়ানকভাবে সংক্রমিত হয়, তখন আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো এই ভেবে খুশি হয়েছিলেন যে, করোনা আমেরিকার শত্রু চীন ও ইরানকে আক্রমণ করেছে। তার কথাবার্তায় করোনাকে গুরুত্ব না দেয়ার আভাস ছিল। এখন করোনা আমেরিকাসহ ব্রিটেন, ইতালি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশকেও ভয়াবহভাবে আক্রমণ করার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ব্রিটেনের বরিস জনসন সাহেবের আরামের ঘুষ হারাম হয়েছে। ট্রাম্প সাহেব কড়া ব্যবস্থা নিয়েছেন করোনা হটানোর জন্য। তার প্রতিষেধক তৈরিতেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছেন। বর্ডারে কড়া ব্যবস্থা এবং বিদেশী প্লেন আমেরিকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করেছেন। ব্রিটেনে দেরিতে হলেও লকডাউন করা হয়েছে। স্কুল, কলেজ, দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি চার্চে সমবেত প্রেয়ার এবং মসজিদে নামাজের জামায়াতও। করোনার মুখোমুখি হয়ে এখন হয়তো বরিস জনসন ভাবছেন, এমন হুড়াহুড়ি করে ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসাটা ঠিক হয়েছে কিনা! ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশে খাদ্য মজুদ আছে বারো মাসের। কিন্তু ব্রিটেনের নাকি আছে মাত্র চার মাসের। ব্রিটেন কখনো খাদ্য মজুদ করে না। খাদ্য আমদানি করে। করোনাভাইরাসের দরুন সকল যোগাযোগ, ব্যবসা বণিজ্য যখন বন্ধ, তখন ব্রিটেন খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য খাদ্য আমদানি করবে কোত্থেকে? ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের ঝগড়া। তারা ব্রিটেনকে সাহায্য দানে এগিয়ে আসতে চাইবে না। অন্যদিকে, ট্রাম্প সাহেব কারও বিপদের বন্ধু তা এখনও প্রমাণ হয়নি। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে ব্রিটেনে খাদ্যদ্রব্যের অভাব প্রকট হলে তারা কি করবে এটা ভেবেও অনেকেই আতঙ্কিত। এখন আর ব্রিটেনের কলোনি নেই যে, সেখান থেকে খাদ্য লুট করে এনে চাহিদা পূরণ করা যাবে! করোনার মতোই যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তা হলো, এই রোগ অদূর ভবিষ্যতে প্রশমিত হলেও বিশ্বময় ইকোনমিক ডিপ্রেশন বা বিরাট অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। তাতে অনেক উন্নয়নশীল দেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। ব্রিটেনে ইতোমধ্যেই খাদ্যদ্র্রব্য রেশনিং করার কথা উঠেছে। শেয়ারবাজারে ধস নামার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, যার ফলে জার্মানিতে দুর্ভিক্ষে লোক মারা গিয়েছিল, সেই মন্দা অনেকটা ইউরোপে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, করোনা যুগে অথবা করোনা পরবর্তী সময়ে যে ভয়ানক অর্থনৈতিক মন্দা হবে তা হবে বিশ্বব্যাপী। আগে এশিয়া-আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ মন্বন্তরে মানুষ মারা যেত। এবার উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলোতেও মানুষ মারা যেতে পারে। একদিকে করোনার মৃত্যু ছোবল, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দার বিভীষিকাÑ এই দুটির কোনটাকে মোকাবেলা করার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেয়া হবে, তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের কর্তারা। করোনাভাইরাস এবং তজ্জনিত অর্থনৈতিক মন্দায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। যেখানে রোগ দমন করাই তাদের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ, সেখানে মহামারীর পর মহামন্দা অর্থাৎ রাক্ষসের পর খোক্কস মোকাবেলা করা অনেকের জন্যই দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশে ‘বেশি বেশি ওয়াজ নসিহতের’ কারণে করোনা ছড়াবে না বলে একশ্রেণীর মোল্লা যে প্রচার চালাচ্ছিলেন, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশেও করোনা মৃত্যুদূত হয়ে দেখা দিয়েছে। এর ছোবলে বাংলাদেশে অর্থনীতির যে বিরাট উন্নয়ন ঘটেছে, তাতে ভয়ানক আঘাত লাগতে পারে। সরকার এই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক বলে মনে হয়। রোগ প্রতিহত করার, আক্রান্তদের চিকিৎসা দানে সরকার সাধ্যমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, ‘তারা যেন আতঙ্কিত না হন এবং রোগ প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ থাকেন। তিনি গুজবে বিশ্বাস না করার জন্যও সকলকে সতর্ক করে দিয়েছেন।’ আতঙ্ক ও গুজব পাশাপাশি থাকে। এজন্যে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে সবসময় অবহিত রাখা এবং গুজব প্রচারকারীদের কঠোর শাস্তি দানের ব্যবস্থা থাকা দরকার। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে এবং বিজ্ঞানীরা কবে পর্যন্ত এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারে সক্ষম হবেন, তা কেউ জানে না। এখন সকল দেশের সরকারেরই উচিত, আমরা যে আতঙ্কে ভুগছি সেই আতঙ্ক দূর করার জন্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত রাখা এবং সাহস দেয়া। আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দা রোধের জন্য এখনই বিশ্ব নেতারা সমবেতভাবে এবং সব দেশের সরকারই নিজস্বভাবে আগাম সতর্কতাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অর্থনৈতিক মন্দার ছোবল সবটা না হলেও অনেকটাই সামাল দেয়া যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে এবারের করোনাভাইরাসের হামলা বিশ্ব মানবতার বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় আঘাত। এতবড় আঘাত আগে কখনও আসেনি। মানবিক সাহস ও সমবেত চেষ্টাই হচ্ছে এখন এই শত্রুকে মোকাবেলা করার একমাত্র উপায়। লন্ডন, ২৪ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০২০।
×