ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

অগ্নিঝরা মার্চ আর করোনাভাইরাসের আতঙ্ক

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২৪ মার্চ ২০২০

অগ্নিঝরা মার্চ আর করোনাভাইরাসের আতঙ্ক

১৯৭১ সালের মার্চ মাস আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিস্মরণীয় কাল পর্ব। শুরুটা হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অগ্নিস্রাত বক্তব্যে স্বাধীনতা আর অধিকার অর্জনের কালজয়ী উদ্দীপ্ত আহ্বানের মধ্য দিয়ে। আপামর বাঙালীকে ডাক দিলেন নিজেদের সাধ্যমতো রক্ষাকবচ তৈরি করতে। পাক সামরিক জঙ্গীর নৃশংস সশস্ত্র অভিযানে বাংলার মানুষ প্রতিরোধ, সংগ্রামে যেন একত্রে সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করে নিজকেসহ দেশকে বাঁচানোর প্রত্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৭ মার্চের সেই দেশ কাঁপানো ভাষণের পরে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার লাল সূর্যকে অর্জন করতে সব ধরনের বাধা প্রতিবন্ধতাকে সামলানোর দৃঢ়চেতায় সুসংহত হতে থাকে। তেমন সংগ্রামী অভিযাত্রায় সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতিতে পাক সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সহযাত্রায় এক দুনির্বার অবরোধের পরিক্রমা গতিশীল হয়। সেই দুর্বার অসহযোগ আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে আরম্ভ করে প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আসে এক লড়াকু অভিগমন, সঙ্গে সরকারী ব্যবস্থাপনায় দেখা দেয় অসহনীয় স্থবিরতা। এরই মধ্যে চলতে থাকে আলাপ আলোচনার নামে প্রহসন আর হঠকারী সিদ্ধান্ত। সঙ্গত কারণে কোন সঠিক কর্মসূচী কিংবা উপস্থিত বিপর্যয় ঠেকানোর নির্দেশনা পর্যন্ত দিতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানী সামরিক সরকার। ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর একগুঁয়েমি বঙ্গবন্ধুর যৌক্তিক আর প্রাসঙ্গিক আলোচনা আলোর মুখ দেখতেই পারেনি। এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় সুপরিকল্পিত এবং শত্রু বাহিনীর একান্ত দুরভিসন্ধির মাধ্যমে। ফলে সংগ্রাম, আন্দোলন তার নিজস্ব গতি প্রবাহে এগিয়ে চলে। এরপর ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালরাত্রির উন্মত্ত উত্থান পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্যতম গণহত্যা, ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর সশস্ত্র হামলায় নির্বিচারে, নৃশংসভাবে এক রাতেই যে মাত্রায় বাঙালী নিধন করা হয় তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ইহুদী নিধন অভিযানকেও হার মানিয়ে দেয়। সেই রক্তাক্ত, ভয়াল রাতে বঙ্গবন্ধুর সামনে আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না। স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া বিকল্প কোন কিছু ভাবার অবকাশই পাওয়া যায়নি। কারণ সেই রাতেই তাকে বন্দী করে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর গাড়িতে উঠিয়ে নেয়া হয়। তেমন দুঃসহ ঘটনাও মর্মান্তিক এবং নির্মমতায় ভরা এক তিক্ত করুণ আখ্যান। প্রতিবছর মার্চের শুরুতে এমন সব দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন করে ’৭১-এর সংগ্রামী মাইলফলকের বিপন্ন অবস্থাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০২০ সালের মার্চ মাস অত্যন্ত অহঙ্কার আর গৌরবের সঙ্গে জাতির জনকের জন্মশত বর্ষ উদযাপনে বিভিন্ন কর্মপ্রকল্পকে উৎসর্গ করা হয় আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। তবে বড় ধরনের কোন উৎসব, জমায়েত এবং আড়ম্বর ছাড়াই মুজিব শতবর্ষকে পালন করা হচ্ছে। কারণ ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে চলছে করোনাভাইরাসের আক্রমণ এবং আতঙ্ক। বাংলাদেশও কোনভাবেই এমন রোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। সর্বপ্রথম এবং আশঙ্কাজনকভাবে আক্রান্ত চীনের উবেই প্রদেশের উহান শহর। প্রায় ৮১ হাজারের মতো মানুষ আক্রান্ত হয় চীনে এবং মারা যায় ৩ হাজারের ওপরে। তবে এই মুহূর্তে সারাবিশ্বে সম্প্রসারিত রোগটির আক্রমণের শিকার প্রায় তিন লাখ মানুষ। চীনে চরম আঘাত হেনে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হতে থাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনসহ আরও অনেক দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি এসব দেশও মুক্ত থাকেনি আগ্রাসী সংক্রমণ থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আরম্ভ করে দেশীয় অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য দফতরও প্রতিনিয়তই সতর্কবাণী প্রচার করা থেকে চিকিৎসা সেবার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করে যাচ্ছে। এই ভাইরাস সংক্রমণটি বাংলাদেশের ভেতওে পূর্বে অবস্থান না করলেও প্রবাসী বাঙালীদের মাধ্যমে এখানে আসতে সময় ক্ষেপণ করেনি। প্রথমত চীন থেকে প্রচুর বাঙালী প্রবাসী দেশে ফিরে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করতে শুরু করে। কারণ এই মরণঘাতী ভাইরাসটি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আক্রান্ত দেশ থেকে আসা নাগরিকরা সবাই না হলেও কিছু মানুষের মধ্যে এই সংক্রমণ বয়ে আনার ঘটনা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে। ভয়ে, আতঙ্কে আক্রান্ত দেশ থেকে প্রবাসীরা ঘরমুখো হচ্ছে। করোনা বিপর্যয়ের এমন দুঃসময়ে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে কত সংখ্যক বাঙালী দেশের বাইরে আছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ নয়ত বা লেখাপড়ার প্রেক্ষিতে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার আকাক্সক্ষায়। উন্নত দেশে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইতালি, ফ্রান্সের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গরাজ্যকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তার পরও প্রবাসী বাঙালীদের অনেকেই দেশ ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে। আর সেখানেই বিপত্তি যা ঘটার তা ঘটেই চলেছে। প্রথমত বিমানবন্দরে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর প্রাথমিক কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে গিয়ে ১৪ দিন অপেক্ষা করার কথা বলা হলেও অনেকেই এই নির্দেশনা মানছেন না। সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে হোম কোয়ারেন্টাইনই ছিল যথাযথ স্বাস্থ্যসম্মত বিধি। প্রথমেই ইতালি ফেরত দু’জনের মধ্যে এই ভাইরাস শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশনে দেয়া হয়। তাদের থেকে পরিবারের আরও একজন সংক্রমিত হলেও তারা তিনজনই এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু পরবর্তীতে আরও আক্রান্তের খবর পাওয়া গেলে তাদের মধ্যে ২ জন সত্তরোর্ধ রোগী মারা যান। তবে চিকিৎসকদের মতে তারা বার্ধক্যজনিত অন্য রোগেও ভুগছিলেন। তবে এই পর্যন্ত প্রায় ২৭ জনের দেহে করোনাভাইরাস পাওয়া গেলে তারা সবাই আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন আছেন। আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা বাড়া অসম্ভব কিছু নয়। বয়সের ব্যাপারটাও বিবেচ্য বিষয়। এই পর্যন্ত পরিসংখ্যানে বয়োবৃদ্ধ আক্রান্তরাই মৃত্যুর মুখে পড়ে যাচ্ছেন। শারীরিক অক্ষমতার সঙ্গে নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসের লড়াই করা অনেক বয়স্ক মানুষের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এমন সব আশঙ্কাজনক ব্যাপার বাদ দিয়েও এ রোগ প্রতিরোধ আর নির্মূলের সমূহ পর্যায় আমলে নিলে হয়ত বা কিছুটা সুরক্ষা মিলবে। আক্রান্ত রোগীকে অন্য সকলের কাছ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। শুধু তাই নয় বিদেশ থেকে আসার পরও প্রত্যেককে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা একেবারে স্বাস্থ্যসম্মত বিধি। এর অন্যথা হলে পরিস্থিতি নিয়মের বাইরে চলে যাবে। সঙ্গত কারণে দায়টা শুধু সরকার, প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। প্রত্যেকের সচেতন দায়িত্বশীলতায় এমন সংক্রমণ মহামারী থেকে পরিত্রাণ পাওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। গণজমায়েতকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাও প্রতিদিনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ামক বিষয়। সঙ্গত কারণে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রোজকার মিলিত প্রার্থনাকেও পাশ কাটাতে হবে। আল্লাহকে আমরা যেখান থেকেই স্মরণ করব আন্তরিক নিবেদনে সেখানেই তাঁকে পাওয়া যায় এমন বিধি বিভিন্ন ধর্মে আছে। আমরা জানি সর্বশক্তিমান সর্বত্র বিরাজ করেন। তাঁর প্রতি নিবেদিত ভক্তরা তাঁকে যেভাবে ডাকবে সেখানেই তিনি হাজির হন এটা আমরা শুনে বড় হয়েছি। আল্লাহর কাছে নিয়ামক শক্তি তাঁর কাছে সমর্পিত ভক্তের মঙ্গল। মানুষের দুঃসময় তাদের প্রতি কল্যাণ বর্ষণ করাই বিশ্ব নিয়ন্তার আন্তরিক কামনা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও এ রোগের অন্যতম প্রতিষেধক। জীবাণুমুক্ত হাত ধোয়ার সাবান দিয়ে বার বার নিজেকে দূষণমুক্ত করতে হবে। এটা যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ামক পাশাপাশি রোগ-বালাই থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেও অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এমন বলা না গেলেও নিজেকে সুরক্ষার প্রাসঙ্গিক বিধিনিষেধকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে। বিশ্বময় এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের মহাদুর্যোগ। কিন্তু এটা কোন প্রাকৃতিক অশনি সঙ্কেত নয় একেবারে মানুষের আয়ত্তে আনার সমূহ বিপর্যয়। বিশ্ব মানব নিজেদের ঐকান্তিক, সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং স্বাস্থ্যসম্মত বিষয়কে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রসারিত এই ভয়ঙ্কর মহামারীর প্রকোপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবে। এমন দায়-দায়িত্ব সমাজের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের। কারও একক প্রচেষ্টায় এর মোকাবেলা অত্যন্ত দুরূহ। অপ্রয়োজনে, অকারণে আতঙ্ক ছড়ানোও কোন বিধি নিয়মের মধ্যে পড়ে না। বরং নিজ দায়িত্বে অন্য সবার মঙ্গল কামনায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে সবাইকে। লেখক : সাংবাদিক
×