ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এড়িয়ে চলুন করোনা গুজব

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ২৩ মার্চ ২০২০

এড়িয়ে চলুন করোনা গুজব

এটা পুরোপুরিই ভুয়া কথা। বরং ত্বকে অ্যালকোহল কিংবা ক্লোরিনের প্রয়োগ ক্ষতির কারণ হতে পারে, বিশেষত যদি তা চোখে কিংবা মুখে যায়। এগুলো বিভিন্ন জিনিসের পৃষ্ঠদেশ পরিষ্কারে ব্যবহার করা গেলেও ত্বকের ওপর সেগুলো কোনভাবেই ব্যবহার করা উচিত নয়। অ্যালকোহল বা ক্লোরিন শরীরের ভেতরে থাকা ভাইরাসের কিছুই করতে পারে না। কেবলমাত্র বৃদ্ধ ও কম বয়সীরাই এর ঝুঁকিতে আছে করোনাভাইরাসের অন্যান্য প্রকরণের মতো SARS-CoV-2 যে কোন বয়সী মানুষকেই আক্রান্ত করতে পারে। তবে যে কোন ব্যক্তি, তিনি বয়স্ক কিংবা স্বল্পবয়সী যে-ই হোন না কেন, যদি তার আগে থেকেই কোন রোগ থাকে, যেমন- ডায়াবেটিস কিংবা এ্যাজমা, তাহলে তার এতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই এই ধরনের মানুষদের উচিত নিজেদের ও একইসঙ্গে নিজের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ব্যাপারে বেশি সচেতন হওয়া। বাচ্চারা কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয় না ঠিক আগের পয়েন্টেই এ বিষয়ে বলা হয়েছে- যে কোন বয়সী মানুষই এতে আক্রান্ত হতে পারেন। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ কেস যদিও বয়স্কদের, তবে বাচ্চারাও এর আশঙ্কা থেকে মুক্ত না। তাদের উপসর্গগুলো হয়ত এতটা তীব্র রূপ ধারণ করছে না, তবে তাদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ১৫ মার্চ ২০২০ তারিখে লন্ডনে এক নবজাতকের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। কভিড-১৯ ঠিক ফ্লুর মতোই SARS-CoV-2 এর কারণে মানবদেহে যে উপসর্গগুলো দেখা যায়, সেগুলো অনেকটা ফ্লুর মতোই; যেমন- শরীরে ব্যথা, জ্বর এবং কাশি। আবার এই দুটোই সামান্য থেকে শুরু করে ভয়াবহ রূপ ধারণ, এমনকি মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে। এই দুটোর ফলেই নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে এই কভিড-১৯ এর বিষয়টি ফ্লুর থেকেও গুরুতর। অঞ্চলভেদে এর মৃত্যুহার পরিবর্তিত হলেও Worldometers এর হিসেবে এখন পর্যন্ত (১৬ মার্চ ২০২০) সামগ্রিকভাবে সেটা ৮% দেখা গিয়েছে। গবেষকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন এর সঠিক মৃত্যুহার নির্ণয়ের। তবে সিজনাল ফ্লুর চেয়ে এটা অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই রয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যু এই কথা একেবারেই মিথ্যা। ঠিক আগের পয়েন্টেই এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। Worldometers এ গিয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখেও যে কেউ বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারবেন। কিছুদিন আগেই চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এ্যান্ড প্রিভেনশনের এক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে যে, ৮০.৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্তদের উপসর্গ ছিল বেশ স্বল্পমাত্রার। কুকুর-বিড়ালের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে এই ভাইরাস এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ আছে সামান্যই। কিছুদিন আগে অবশ্য হংকংয়ের এক লোক কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে তার কুকুরটিও এতে আক্রান্ত হয়। তবে সেই কুকুরটির মাঝে ভাইরাসের কোন উপসর্গ প্রকাশ পায়নি। বিজ্ঞানীরাও এই ভাইরাসটি ব্যাপকাকারে বিস্তার লাভের জন্য মানুষকেই দায়ী মনে করছেন। ফেস মাস্ক ব্যবহারে সুরক্ষা নিশ্চিত স্বাস্থ্যকর্মীরা যেসব মাস্ক ব্যবহার করেন সেগুলো বেশ ভাল মানের হয়ে থাকে, যা তাদের মুখের চারদিকে বেশ শক্তভাবেই আটকে থাকে। ফলে রোগজীবাণু থেকে সেটা তাদের চমৎকার সুরক্ষা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে ডিসপোজেবল ফেস মাস্ক এই সুরক্ষা দিতে অক্ষম। এগুলো যেহেতু মুখের চারদিকে শক্তভাবে আটকে থাকে না, ফলে নাকে-মুখে খুব সহজেই তরলের ক্ষুদ্র কণা প্রবেশ করতে পারে। আবার সেগুলোর ভেতর দিয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির ভাইরাল পার্টিকেলও চলে যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, যদি কারও শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত কোন অসুস্থতা থাকে, তাহলে তার মাস্ক ব্যবহারই অন্যদের আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন হসপিটালের এ্যাকিউট মেডিসিন এ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস-এর কনসাল্টেন্ট ডাক্তার বেন কিলিংলের মতে, ফেস মাস্ক ব্যবহার যে একজন ব্যক্তিকে করোনাভাইরাসের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে পারে এ বিষয়ে তেমন কোন প্রমাণ নেই বললেই চলে। বরং ফেস মাস্ক ব্যবহার করে অনেকে নিজেদের সুস্থতার ব্যাপারে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং রোগটি থেকে বেঁচে থাকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপায় (যেমন : হাত ধোয়া) নিয়ে তখন আর তাদের তেমন একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যদি কেউ কভিড-১৯ এ আক্রান্ত কারও দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন, তাহলে তার উচিত হবে ফেস মাস্ক ব্যবহার করা। তবে এই মাস্কের ব্যবহার তখনই কাজে আসবে যদি কেউ এ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব কিংবা সাবান ও পানি দিয়ে নিয়মিত তার হাত পরিষ্কার রাখেন। আবার মাস্ক কিছুদিন ব্যবহারের পর সেটা এমনভাবেই ফেলে দিতে হবে যেন সেটা আবার পরে রোগের উৎস হিসেবে কাজ না করে। হ্যান্ড ড্রায়ার করোনাভাইরাস ধ্বংস করে না, হ্যান্ড ড্রায়ার এমনটা করতে পারে না। আপনার নিজের এবং পরিচিতদের এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে এ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব কিংবা সাবান ও পানি দিয়ে নিয়মিত হাত পরিষ্কার করুন। কভিড-১৯ এ আক্রান্ত কারও সঙ্গে ১০ মিনিট থাকলেই কেবল এই রোগে আক্রান্ত হয়। কভিড-১৯ এ আক্রান্ত কারও সঙ্গে যত বেশি সময় ধরে থাকা হবে, অপর ব্যক্তির জন্য তাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও ততই বেড়ে যাবে। তবে এটা ১০ মিনিটের কম সময়েও হতে পারে। স্যালাইন দিয়ে নাক ধোয়ার মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধ সম্ভব না, এ বক্তব্যের পেছনে কোন বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা নেই। ব্লিচিং পাউডার দিয়ে কুলকুচা করে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব না, এই কথাটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। বরং এর ফলে যিনি এমনটা করবেন তারই বেশ শারীরিক ক্ষতির শিকার হতে হবে। এ্যান্টিবায়োটিক হলো করোনাভাইরাসের যম উহু, এ্যান্টিবায়োটিক কেবল ব্যাকটেরিয়াকেই ধ্বংস করে, ভাইরাসকে নয়। থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় সম্ভব থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কারও জ্বর হয়েছে কি না সেটা বোঝা যায়। সিজনাল ফ্লুর কারণেও একজন ব্যক্তির জ্বর হতে পারে। তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, একজন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার ২-১০ দিন পরে তার দেহে কভিড-১৯ এর উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে। এর মানে দাঁড়ায়, জ্বর হওয়ার আগে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক শারীরিক তাপমাত্রাতেই থাকবেন, যদিও তিনি ততক্ষণে করোনাভাইরাসের আক্রান্ত। আর এই সময় থার্মাল স্ক্যানার সেটা কোনভাবেই শনাক্ত করতে পারবে না। রসুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম রসুনের এ্যান্টিবায়োটিক গুণাবলীর ব্যাপারে কিছু কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দিলেও সেটা যে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দিতে সক্ষম এর কোন প্রমাণই নেই। চীন থেকে আসা পার্সেলের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা বলে, এই ভাইরাস কোন চিঠি বা অন্য কোন মালপত্রের ওপর বেঁচে থাকতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, কোন পণ্য যদি বেশ কিছুদিন কিংবা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে যাত্রাপথে থেকে অবশেষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছায়, তবে সেটা কোন করোনাভাইরাস আক্রান্ত অঞ্চল থেকে আসলেও এর মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ঘরোয়া বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমেই করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্ভব কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর এমন কোন ঘরোয়া ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ভিটামিন সি গ্রহণ, এ্যাসেনশিয়াল ওয়েল, সিলভার কলয়েড, তিলের তেল, রসুন, প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর পানি পান করার মতো বিষয়গুলো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। এর চেয়ে বরং নিয়মিত হাত পরিষ্কার করুন এবং কভিড-১৯ এ আক্রান্ত মানুষ থাকতে পারে এমন স্থান এড়িয়ে চলুন। ভিন্ন দেশে বসে চাইনিজ খাবার খেলেও আপনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। না, এটা একেবারেই ভিত্তিহীন কথা। মলমূত্রের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। না, এই কথাটি সত্য নয়! তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাসটি মরে যাবে। কোল্ড ও ফ্লু ভাইরাসের মতো কিছু ভাইরাস শীতকালে বেশি সহজে ছড়াতে পারে। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সেগুলোর কার্যক্ষমতা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন যে তাপমাত্রার পরিবর্তন SARS-CoV-2 এর মাঝে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে চলেছে। মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস হলো এই করোনাভাইরাস SARS-CoV-2 হয়ত ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে মারাত্মক হতে পারে, তবে এটাকে সে জন্য ‘মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস’ বলা অনুচিত। উদাহরণস্বরুপ, ইবোলা ভাইরাসের কারণে মৃত্যুহার নভেল করোনাভাইরাসের চেয়ে বেশি। ফ্লু এবং নিউমোনিয়া ভ্যাক্সিন দিয়ে কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সম্ভব এখন পর্যন্ত (১৬ মার্চ ২০২০) এমন ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি যেটি এই ভাইরাসকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম। চীনের এক ল্যাবরেটরিতেই এই ভাইরাসের উৎপত্তি ইন্টারনেটে এই বিষয়ে অনেক গুজব থাকলেও এই বিষয়ে কোন প্রমাণ আসলে নেই। বিজ্ঞানীরা বরং মানবদেহে এই ভাইরাসটি প্যাঙ্গোলিন (আফ্রিকান ও এশীয় এক ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী) কিংবা বাদুড় থেকে এসেছে বলেই ধারণা করছেন। মানুষজন বাদুড়ের স্যুপ খাওয়ার ফলেই এই ভাইরাসটি এত দ্রুত ছড়াতে পেরেছে। যদিও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে প্রাণিজগত থেকেই এটি মানবসমাজে বিস্তার ঘটিয়েছে, তবে এটা যে একেবারে বাদুড়ের স্যুপ থেকেই এসেছে এই বিষয়ে কোন শক্ত প্রমাণ নেই। গরম পানি দিয়ে গোসল করলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সম্ভব। নাহ, এটাও একেবারে ভিত্তিহীন কথা। বরং, বেশি প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে যদি আপনি বেশি গরম পানি দিয়ে গোসল করেন, তাহলে হয়ত আপনি নিজের চামড়াই পুড়িয়ে ফেলতে পারেন গরম পানি দিয়ে! আল্ট্রাভায়োলেট জীবাণুমুক্তকরণ ল্যাম্প কি তাহলে ব্যবহার করা যাবে? হাত বা শরীরের অন্য কোন অংশ পরিষ্কারের উদ্দেশ্যেই এই ল্যাম্পটি ব্যবহার করা যাবে না, কারণ এতে করে ওই স্থানে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি হবে। যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির ফলে তথ্য সহজলভ্য হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর চেয়েও দ্রুতগতিতে যেন ছড়িয়ে পড়ছে গুজব নামক ভয়াবহ বিষয়টি। তাই নিজে সচেতন থাকুন, অপরকেও এসব বিষয়ে সচেতন করুন। গুজব ছড়াবেন না, বরং এগুলো যে গুজব, ভুয়া কথা এই বার্তাটিই ছড়িয়ে দিন। এর পরেও কেউ এই কথাগুলো বললে তাকে এই লেখার লিঙ্ক দিয়ে বলবেন, ‘আরে ভাইরে ভাই, এসব তুমি কই শুনছ! এইগুলা তো একেবারে ভুয়া কথা! রোর বাংলার এই লেখাটা পড়, তাইলেই সব জানতে পারবা!’
×