ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পারিবারিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যা জরুরি

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২০ মার্চ ২০২০

পারিবারিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যা জরুরি

উপমহাদেশে নারীদের সামাজিক অধিকার বাস্তবায়ন নিয়ে বেগম রোকেয়ার লেখনীতে সোচ্চার অবস্থান দেখা গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পর্যায়ে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি সামনে আসে আশির দশকে ক্ষুদ্র ঋণ চালুর পর থেকে। এক্ষেত্রে প্রান্তিক নারীর অর্থনীতি পরিবর্তনে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ স্যারের অবদান আমাদের সামনে সমুজ্জ্বল। আমরা বলছি, নারীর অর্থনীতি পারিবারিক স্বাস্থ্যের অন্যতম নিয়ামক। যার প্রতিফলন আমরা বিভিন্ন গবেষণা সমীক্ষায় পাই। এক্ষেত্রে পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ে এবং পরিবারের সদস্যদের খাদ্য এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। আমাদের দেশের সামাজিক কাঠামোতে সবচেয়ে ছোট প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। পরিবারে উপার্জনকারী পুরুষ অথবা নারী সদস্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব রাখবে এটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি, নারী যদি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে কোন উদ্যোগ নিয়ে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করে, তবে তার ভূমিকা বাড়বে পরিবারের প্রতি। আমাদের বাংলাদেশের নারীদের সঞ্চয়ী মনোভাব বিদ্যমান যেটি আমরা ঐতিহাসিক সাহিত্য থেকেও ধারণা পাই। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ধর্মীয় এবং সামাজিক বাধা অতিক্রম করে অর্থনীতির মূল ধারায় অবদান রাখতে একজন নারীকে বিভিন্ন পর্যায় পার করতে হয়। পাশাপাশি বিয়ের পরে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে কিনা সে প্রশ্নে প্রথম পর্যায়ে উদারতা দেখালেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায় আমাদের সমাজে। আজকে বিশ্বজুড়ে নারী দিবস পালনের উদ্দেশ্য বিধেয় সবারই জানা, তবে সংখ্যা তত্ত্বের দিক দিয়ে আয়োজন কিংবা আলোচনা সব কিছুর অর্জনই শূন্যের কোঠায় চলে যাবে যদি না মূল ধারার অর্থনীতিতে নারী অংশগ্রহণ না বাড়ে। আর এক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক হচ্ছে উদ্যোক্তা তৈরি করা। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন থেকেই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন ক্লারা জেটকিন। মেয়েদের অবাধ শিক্ষার কথা বলা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে মেয়েদের জন্য স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা সহায়ক বৃত্তি চালু আছে। তবে বাধাটা কোথায়। মানুষ হিসেবে জন্মলাভের পর লিঙ্গ বৈষম্যের কারণেই একজন মেয়েকে নারী হয়ে বাঁচতে শেখায় আমাদের সমাজ। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অর্থনীতি এগোচ্ছে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণে। এতসব প্রতিবন্ধকতার মাঝেও কিছু তথ্য আমাদের নতুন সমীকরণে ভাবতে শেখায়। খ্যাতনামা ভারতীয় অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ তাঁর ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি ও কা জ্ঞান বইয়ে বাংলাদেশ-বন্দনায় বলেছেন, ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ-বৈষম্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে। লিঙ্গ-বৈষম্যের অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে ভাল। এমনকি কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও বাংলাদেশের বেশি।’ লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাবেক এই শিক্ষক জঁ দ্রেজ ভারতের তুলনায় যেসব সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিয়েছেন তার বেশিরভাগই নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। নারীর কর্মসংস্থানের বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। গত এক দশকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে মজুরি বৈষম্যও কমিয়ে এনেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশ্বব্যাংকের ‘ভয়েসেস টু চয়েসেস : বাংলাদেশেস জার্নি ইন উইমেনস ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ যদি এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারে তবে লিঙ্গসমতা আরও বাড়বে। তথ্য বলছে, চাকরি, অর্থায়ন ও সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের পছন্দ, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখনও কম। তবে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের নারীর অংশগ্রহণের হার ২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ। প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ‘এশিয়া প্যাসিফিক এমপ্লয়েমেন্ট এ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক’ শীর্ষক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর বেকারত্বের হার পুরুষের চারগুণ। নারীদের বেকারত্বের হারে উচ্চ শিক্ষিত নারীর সংখ্যাই বেশি। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমজরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমবাজারে রয়েছে। ২৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে শ্রমবাজারে আছেন মাত্র ৩৪ শতাংশ। আবার এই নারীদের বড় অংশই কৃষিতে কর্মরত। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) ২০১৬১৭ অর্থবছরের পরিসংখ্যান বলছে, স্কুলশিক্ষা সমাপ্ত করেছেন তাদের প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী। কলেজ শিক্ষায় নারীর ভাগ ৪৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রায় ২৩ শতাংশ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষিতদের প্রায় ৪২ শতাংশই ছিলেন নারী। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি থাকার কথা ছিল সেই সেবা ও বিপণন কাজে নারীর অংশগ্রহণ ৫ শতাংশেরও কম (শতকরা ৪.৯৫ ভাগ)। আর ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নারীর সংখ্যা মাত্র ০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। দেশে সাক্ষরতার দিক থেকে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। নারীদের শিক্ষার হার ৭১ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ও এর বেশি বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষার হার দাঁড়িয়েছে ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশে। এর মধ্যে পুরুষদের মধ্যে শিক্ষার হার ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৭১ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়ভাবে শিক্ষার হার ছিল ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ। এ হিসেবে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার হার বেড়েছে। সাত বছর ও এর বেশি বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে সাক্ষরতার হার গড় ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৭ সালে এ অংশের সাক্ষরতার হার ছিল ৭২ দশমিক ৩ বছর। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ার তথ্য আমাদের বুঝতে শেখায় যে পরিবারের সদস্যদের স্বাথ্য এবং সুষম খাদ্য নিরাপত্তার সিদ্ধান্তে গত তিন দশকে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ছে। আরেকটি বিষয় হলো সামাজিক অন্ধত্ব যা ট্যাবু নামেই পরিচিত। আগের সময়টায় নারী স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ করলেই মেয়েরা লজ্জায় চুপ হয়ে যেতো। ফার্মেসিতে গিয়ে ন্যাপকিন কিনতে জড়তা ছিল তাদের মাঝে। এমনও উদাহরণ আমরা পেয়েছি যে, ক্লাসে নারী স্বাস্থ্য নিয়ে অধ্যায়টি অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্টাপেল করে রাখতে বলেছে, যাতে না পড়াতে হয়। যাই হোক সময়ের সাথে পরিবর্তন আসছে। আমরা বলছি, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমাতায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।মা এবং নবজাতক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জনে সরকারে নানামুখী উদ্যোগের মাঝেও পত্রিকার সংবাদ তথ্য বলছে দেশে নবজাতকের মৃত্যুহার কমছে না। ১ হাজার নবজাতক জন্ম নিলে ৩০টি মারা যাচ্ছে বয়স ২৮ দিন হওয়ার আগেই। পাঁচ বছর আগে এই হার ছিল ২৮। এক বা পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের পরিস্থিতিও ভাল নয়। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিলও একই কথা বলছে। ইউনিসেফের মতে বিশ্বের সর্বোচ্চ নবজাতক মৃত্যুকবলিত দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। নির্ধারিত সময়ের চর বছর আগেই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার কমানোর বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন করে উন্নয়ন আইকন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি, প্রতিবছর জন্মের পর মারা যায় ৬২ হাজার নবজাতক। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নীত সংখ্যক নবজাতকের মৃত্যু হয় যেসব দেশে তার একটি বাংলাদেশ। এসব শিশুর মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম মাসে এবং অর্ধেকই মারা যায় পৃথিবীতে আসার দিনই। ভাল, খারাপ। সাদা কালো। প্রতিটি বিষয়ের দুটি সমান দিক বিবেচনা করলে বলা যায় ভালর পাল্লাই বেশি। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। নারীর সক্ষমতা বাড়ছে। বাড়ছে পরিবারে সিদ্ধান্ত নেয়ায় অংশগ্রহণ। আমরা বলছি নারীর অর্থনীতি পরিবর্তন হলে বদলে যাবে পরিবার, পরিবর্তন আসবে সমাজে। সাধিত হবে সমুন্নয়ন। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
×