ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে ও প্রাসঙ্গিক

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

অমর একুশে ও প্রাসঙ্গিক

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...। সেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মাস এই ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই মাসের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’- এ দাবিতে বাঙালীরা যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন পাকিস্তানীরা তার জবাব দিয়েছিল বুলেটের মাধ্যমে। বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ করেছিল রঞ্জিত। সেই রক্তের ছোঁয়া পেয়ে আশ্চর্য দ্রুততায় গোটা জাতি জেগে উঠেছিল তার শেকড়ের টানে। পাকিস্তানীদের সৃষ্টি করা সাম্প্রদায়িকতা তাতে কোন বাদ সাধতে পারেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী সেদিন এক হয়ে একটিই প্রতিজ্ঞা করেছিল- মায়ের ভাষার সম্মান রাখবই, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করবই। রক্তের বিনিময়ে এ বাংলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের মতো অনেকের জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালী তার ভাষা, স্বকীয়তা এবং গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিল। রক্তের আখরে লেখা এই একুশে ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালী জাতির নবতর উত্থান ও অভ্যুদয়ের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সংস্কৃতির হৃৎপি-। বাংলা আমাদের দেশমাতৃকা, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা। বাংলা ভাষা বাঙালী হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীর রয়েছে অবদান। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে মর্যাদায় উন্নীত করতে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখো প্রাণের তাজা রক্ত। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেয়ার যে ইতিহাস বাংলার বীর সেনারা সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে আর এমন দৃষ্টান্ত নেই। বুকের তাজা রক্তের আখরে সৃষ্ট বাংলা ভাষা, সময় পরিক্রমায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বন্যায় এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত-আব্রুর বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন এই বাংলাদেশ। সমগ্র জাতি এই মাসে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের কথা, দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যারা পরাক্রমশালী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার সূর্য পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল। ওই বিজয়ের পেছনে ছিল কোটি কোটি মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় ও অকুণ্ঠ সমর্থন। ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বহু রাষ্ট্র ও শান্তিকামী মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা। সর্বোপরি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমানের অসাধারণ নেতৃত্ব। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, শক্রর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনে ‘যার যা আছে’ তা নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে যুগিয়েছিলেন প্রেরণা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাস থেকে তাঁর অসামান্য অবদান মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালালেও সফল হয়নি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাঙালী জাতির অহঙ্কার হিসেবে তাঁর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কোন আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। বস্তুত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের জন্য পরাধীন ও অবিভক্ত ভারতে জনগণের কখনও রক্তাক্ত এবং কখনও শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতা থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। আমাদের পূর্ব পুরুষরা কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবী-ব্যবসায়ী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতেন ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ-বঞ্চনার অবসান হবে। ভূমিহীন ও ভাগচাষীরা জমির স্বত্ব-স্বামিত্ব পাবে, পাবে মানবিক মর্যাদা। দেশে শিল্পায়ন হবে, বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। কেউ নিরক্ষর থাকবে না। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে দেশ এগিয়ে যাবে। স্কুল-কলেজ হবে। নারী সমাজ পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমঅংশীদার হিসেবে জাতীয় উন্নয়নে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। ঘরে ঘরে বিদ্যুত যাবে। প্রতিটি গ্রামে উন্নতমানের রাস্তাঘাট হবে। স্বাস্থ্যসম্মত সুপেয় পানির ব্যবস্থা হবে। মানুষ চিকিৎসাসেবার সুযোগ পাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সর্বোপরি আমাদের দেশের ভাল-মন্দের ব্যাপারে আমরাই সিদ্ধান্ত নেব। বস্তুত কেবল রাজনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকেই মুক্তি নয়, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম পরিব্যাপ্ত ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আদর্শগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ সব ফ্রন্টেই বিস্তৃত ছিল মুক্তির সংগ্রাম। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। এ ভাষার জাতিগত ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সার্থকতা। একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালীদের ঐক্য-চেতনার অগ্নিস্মারক। এই এক অবিনাশী, অনশ্বর-চৈতন্যের জ্যোতির্ময় শিখা। এ শতাব্দীতে বাঙালী জাতির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, তা হলো অমর এ রক্তাক্ত একুশের বিশ্ব স্বীকৃতি। ১৭ নবেম্বর ১৯৯৯ রোজ বুধবার প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান সংস্থা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এবং তা ২০০০ সাল হতে বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা নিয়ে বাঙালী জাতিকে বিশ্বে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এ মহান কার্যাদি একদিনে সুসম্পন্ন হয়নি। এর জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজ আমাদের হৃদয় গর্বে ভরে যায়। পৃথিবীর সকল দেশের জনগণ প্রতি বছর এ নদীবিধৌত পলি মাটির মনুষ্যত্ব আর গণতান্ত্রিক সমর্থনে সাধারণ মানুষ কতটা নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক হতে পারে এবং কতটা আত্মত্যাগী হতে পারে এ বিষয়ে জানছে এবং আরও জানবে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আর একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত হারানো শাশ্বত এ বাঙালীর রক্তের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ আজ পরম শ্রদ্ধায় দেদীপ্যমান সারা বিশ্বে। স্বাভাবিকভাবে একুশ আজ প্রতিটি বাঙালীর অহঙ্কারের প্রতীক। একুশ প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাঙালীর গর্ব, সাহস ও প্রেরণার উৎস। ইউনেস্কোর সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের ফলে একুশ আজ গোটা বিশ্বের সম্পদে দাঁড়িয়েছে। ভাষাভাষীর দিক থেকে বাংলা বর্তমান পৃথিবীর ৫ম ভাষা, আর আমাদের রাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা। এ ভাষার উৎকর্ষের জন্য কারও কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাঙালী খুঁজে পায় নিজস্ব সত্তা। আর এর ফলেই বাঙালী লাভ করে স্বাধীন রাষ্ট্র। বিভিন্নভাবে দেশ অনেকটাই এগিয়েছে বলা যায়, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় সেগুলোর কি নিষ্পত্তি আজও আমরা করতে পেরেছি? বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সত্য, কিন্তু তা কি চালু করা সম্ভব হয়েছে সর্বস্তরে? একুশের অন্যতম তাৎপর্য ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য, বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদি থাকবে না। এই মহৎ আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে কি? বাঙালীর ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখার ঐক্যবদ্ধ সমন্বিত প্রচেষ্টা কি লক্ষ্য করা যাচ্ছে সমাজে? চিন্তার দিক থেকে আমরা হব আন্তর্জাতিক, কিন্তু পরিচয়ে থাকব বাঙালী- এই ধারায় কি যাপন করছি জীবন? লেখক : গবেষক [email protected]
×