ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রুট পরিবর্তন

রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবা আনা হচ্ছে রাখাইন থেকে

প্রকাশিত: ১১:২৯, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবা আনা হচ্ছে রাখাইন থেকে

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কুখ্যাত কারবারিরা ইয়াবার চালান আনতে বর্তমানে তাদের রুট পরিবর্তন করেছে। রাখাইন রাজ্যে এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক নির্মাণ হওয়াতে আলাদা সুবিধা ভোগ করছে ওপারের চোরাচালানিরা। ইয়াবা কারখানাস্থল মংডু থেকে পণ্য ডেলিভারি স্থান একটু দূরে হলেও মেনে নিচ্ছে ইয়াবা কারখানার মালিকরা। প্রতিদিন সকালে কারখানা থেকে নিজেদের গাড়িতে করে ইয়াবার চালান পৌঁছানো হচ্ছে মিয়ানমারের তুমব্রু এলকায়। ওপারে চাকমাকাটাসহ নারাইনশং, কক্ষদইঙ্গা ও তোয়াইঙ্গাপাড়া এলাকায় জমা করে রাখাইনের ব্যবসায়ীরা। সেখান থেকে সুবিধামতো নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, ভাজাবনিয়া, চাকমাপাড়া, বাইশফাড়ি, উত্তরপাড়া, উখিয়ার দরগাবিল, টাইপালং, রহমতেরবিল ধামনখালী ও বালুখালীর পছন্দমতো সীমান্ত দিয়ে পার করানো হচ্ছে ইয়াবার চালান। সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে ঢোকানোর পর এপারে দায়িত্বরত বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের হাতে কিছু কিছু চালান জব্দও হচ্ছে। শনিবার পৃথক অভিযান চালিয়ে র‌্যাব দুইটি ইয়াবার চালানসহ তিনজনকে আটক করেছে। এদিকে দুই দফায় গডফাদারসহ মাদকচক্রের ১২৩ জন আত্মসমর্পণ করলেও ইয়াবা কারবারের লাগাম টানতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। প্রতিনিয়ত আসছে ইয়াবার চালান। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন, গডফাদাররা যদি আত্মসমর্পণ করে তাহলে ইয়াবা আনছে কারা? ইয়াবার বড় চালান আনা বা লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করছে কে? আত্মসমর্পণ করলেও তাদের কাছে বাকি পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা বিক্রির টাকা। হাজতবাসকারী গডফাদারদের পরামর্শ মতে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের স্বজনরা। দেশে ইয়াবা প্রবেশের প্রধান পথ নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় ঘুরে সর্বস্তরের জনতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন সাগরপথে নয়, তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে পায়ে হেঁটে ইয়াবার চালান আনা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে। কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে শনিবার ভোর রাতে উখিয়ার রাজাপালং পূর্ব ডিগলিয়া ও বালুখালী এলাকা থেকে ২৬ হাজার ৩৫০ পিস ইয়াবাসহ ৪ ইয়াবা কারবারিকে আটক করেছে। র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ মোহাম্মদ শেখ জানান, আটকরা হচ্ছে, পূর্ব ডিগলিয়ার মৃত সোলতান আহমদ ভেন্ডারের পুত্র ছৈয়দ আলম, চাকবৈঠা গ্রামের আবদুস শুক্কুরের পুত্র মোঃ নুরুল ইসলাম, পূর্ব ডিগলিয়াপালং এর আলী আহমদের পুত্র নুরুল ইসলাম ও বালুখালী দুই নম্বর গজঘোনা গ্রামের মোঃ আলী মিয়ার মেয়ে তৈয়বা খাতুন। কারাগারে সাক্ষাত প্রার্থীদের মাধ্যমে ইয়াবা গডফাদাররা তাদের গোপন তথ্য বাইরে পাচার করছে। আবার কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসলে কোর্ট হেফাজতের কক্ষের কোনায় বসে মোবাইল ফোনে ইয়াবার চালান আনা নেয়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে কথা বলে গডফাদাররা। তাদের স্বজন ও রোহিঙ্গা পার্টনারদের মাধ্যমে এখন ইয়াবার নিয়ন্ত্রণ চলছে। মামলার হাজিরা দিতে কোর্টে আনা হলে সেদিন স্বজনদের মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে কোর্ট পুলিশের সেফ কক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে থাকে আত্মসমর্পণ করা ওই গডফাদাররা। সীমান্তের একাধিক সূত্র মতে, উখিয়া টেকনাফে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ইয়াবা চালান আনার নেপথ্যে কাজ করছে। জানা যায়, দুই দফায় গডফাদার ও কারবারিরা আত্মসমর্পণ করেছে সত্য। ১২৩ জন আত্মসমর্পণ করলেও কিছু মাদক কারবারি এখনও অধরা থেকে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ইয়াবা ব্যবসার লাগাম টানতে পারছে না। ওইসব মাদক কারবারিদের মধ্যে পালংখালী ইউপি এলাকায় রয়েছে, বালুখালীর সদ্য জামিনে মুক্ত বকতার মেম্বার, তারভাই জাহাঙ্গীর, আকবর আহম্মদ, রহমতের বিলের মোঃ আকতার, মোঃ সোহেল, শেখ রাশেল, কালা মনিয়া, মোঃ কামাল, জামাল, আনোয়ার, দানু মিয়া, বেইঙ্গা নুর হোসেন, মাহমুদুল হক, মাছন, ফরিদ, ও আলা উদ্দিন। রাজাপালং ইউপি এলাকায় আতাউল্লাহ, মীর আহম্মদ, মোঃ ইদ্রিস, মঞ্জুর আলম, মেম্বার আব্দুর রহিম, আব্দুল খালেক, জসিম উদ্দিন, জালাল উদ্দিন জালু, নুর হোসেন প্রকাশ চেয়ারম্যান (রোহিঙ্গা), মাহমুদুল করিম খোকা, বাবুল মিয়া, খয়রাদিপাড়ার মোঃ আলম, ছৈয়দ আলম, আনোয়ার, শফি, চায়ের দোকানদার সোলতান, মোরশেদ আলম মেম্বারের ভাই রুহু ও খলিফা শাহজাহান জালিয়াপালং ইউপি এলাকায় ফজল কাদের, ফেচুক্রি, নেজাম উদ্দিন, শাহজালাল, হাঙ্গামা বেলাল, জয়নাল উদ্দিন ও বেলাল উদ্দিন। হলদিয়াপালং এলাকার মাদক কারবারিরা হচ্ছে- মঞ্জুর আলাম, নাছির উদ্দিন, মঞ্জুর মেম্বার ও বাহদুর। রতœাপালং ইউপি এলাকাতে অধরা রয়েছে, মোরশেদ আলম চৌধুরী, জয়নাল, রুহল্লার ডেবার বাহাদুর ও রশিদ আহমদ। উখিয়া থেকে সংবাদদাতা হানিফ আজাদ জানিয়েছেন, গতবছর ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গডফাদারসহ ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করে। তন্মধ্যে কারাগারে একজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ সরকারী কলেজ মাঠে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে শীর্ষস্থানীয় ২১ জন ইয়াবা কারবারি। এদের বেশিরভাগই গোয়েন্দা সংস্থা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়া একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মাদক কারবারিদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে যারা কারাগারে বন্দী জীবন অতিবাহিত করছে, বলতে গেলে তারা যেন জামাই আদরে বসবাস করছে। টাকার জোরে তারা আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছে কারাগারে। স্বজনরা সাক্ষাতে যেতে বিলম্ব হলেও সমস্যা নেই, জেলখানায় তাদের জন্য সবকিছু বাকিতে মেলে। সূত্র মতে, ইয়াবাসহ মাদক কারবারিরা এখন কৌশল পাল্টিয়ে রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবার চালান আনছে রাখাইন থেকে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু চালান আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, আত্মসমর্পণ করা ১২৩ জন ছাড়াও বাইরে রয়ে গেছে চিহ্নিত বহু মাদক কারবারি। তারা নিজেদের আড়ালে রেখে চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াবা কারবার। তিনি বলেন, মাদক কারবারিদের বিষয়ে কোন ধরনের ছাড় নেই। একদিন আইনের আওতায় আনতেই হবে। সচেতন মহল বলেন, ওইসব চিহ্নিত মাদক কারবারি ব্যক্তি কারা? কালো টাকার পাহাড় গড়ে সমাজে মাতব্বরি করছে কে বা কারা, ইয়াবার কালো টাকার জোরে কে কে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন? সাংবাদিকতার দোহাই তুলে প্রশাসনের সম্মুখে নিজেকে ভাল দেখিয়ে ইয়াবার চালান আনছে কারা। হঠাৎ কারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে কাদের ? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ও কক্সবাজারে গোয়েন্দাদের খাতায় কার কার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে ? এসব তথ্য প্রশাসনের লোকজনের কাছে কমবেশি জানা রয়েছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, অভিযোগের বিষয়ে আমরাও জানি, তবে হাতেনাতে ইয়াবা না পাওয়া গেলে তো ধরা যায় না। স্থানীয়রা বলেন, ইয়াবা কারবারি কেউ কেউ শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার স্বজন হওয়ায় দাপট দেখিয়ে চলেছে সীমান্ত এলাকায়। আবার অনেকে গ্রেফতার এড়াতে কতিপয় অসৎ পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে। জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের কড়া নির্দেশ থাকায় সীমান্ত এলাকায় ছাড় পাচ্ছে না ইয়াবা কারবারিরা। এবিএম মাসুদ হোসেন বলেছেন, উখিয়ায় যারা অবৈধ টাকায় অল্প সময়ে আলিশান বাড়ি, গাড়ি, অগাদ সহায় সম্পত্তি করেছে, অচিরেই তাদের সহায় সম্পত্তি বাজেয়াফত করার জন্য কাজ করবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যারা অবৈধ উপায়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, তারা এসব সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে না। ভোগ করতে দেয়া হবে না।
×