ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ

ব্যাংকিং কমিশনের রূপরেখা সিপিডির

প্রকাশিত: ১১:১৫, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ব্যাংকিং কমিশনের রূপরেখা সিপিডির

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি কমিশন গঠনের বিষয়ে রূপরেখা দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এতে ব্যাংকিং কমিশনের কার্যপিরিধি এবং সম্ভাব্য সুপারিশ ও তার বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে গবেষণা সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্থতার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে ব্যাংক কমিশন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ কমিশনের সফলতার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের আলোকিত সমর্থন থাকতে হবে। তা না হলে ব্যাংক খাতের কার্যকর পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। শনিবার সকালে রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশন, সিপিডি’র প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই রূপরেখা তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘ব্যাংকিং কমিশন গঠন বিষয়ে যে আলাপ আলোচনা হচ্ছে তার বিস্তারিত আমরা এখনও জানি না। গত আট বছর ধরে আমরা ব্যাংকিং কমিশন নিয়ে কথা বলে আসছি। কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য, কার্যপরিধি, কার্যপ্রণালী এবং সুপারিশ কি হতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের কিছু ধারণা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমত কমিশনের কার্যপরিধি সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত ব্যাংকিং খাতের সঠিক তথ্য পাওয়া এবং পরিসংখ্যানের প্রাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান মূল সমস্যাগুলোর কারণ কি এবং সামনের দিনে চ্যালেঞ্জগুলো কি হতে পারে সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। চতুর্থত, ব্যাংকিং খাতের সমস্যার জন্য কারা এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী দায়ী তা চিহ্নিত করতে হবে। পঞ্চমত, স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সঙ্কট থেকে প্রশাসনিক ও আইনগত কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তার সুপারিশ তৈরি করা। তিনি বলেন, একটি সাময়িক কমিশন হিসেবে এর সময় নির্ধারিত থাকতে হবে। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে কাজগুলো শেষ করতে হবে।’ ব্যাংকিং কমিশনের কার্যপরিধির তথ্য তুলে ধরে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আগামী জুনে বাজেট আসছে। বাজেটের পর পরই যাতে কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কী পদ্ধতিতে কমিশন কাজ করবে, তার একটি অন্তর্বর্তীমূলক পদক্ষেপ দরকার। সে জন্য ব্যক্তিখাতের কয়েকজন বড় বড় ব্যবসায়ী বা নীতি নির্ধারকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে সবার সঙ্গে বসে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোক্তা, সাধারণ গ্রাহক, ক্ষুদ্রব্যবসায়ী, ছোট বড় সঞ্চয়কারী, বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, ব্যাংক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, নারী, যুবক এবং ঢাকার বাইরের জনগণ। অর্থাৎ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল তাদের সবাইকে আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং কমিশনের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। বিভিন্ন সময়েই কমিটি, কমিশন ও তদন্ত কমিশন গঠন হয়ে থাকে। সেগুলোর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে না। এ কারণে এই কমিশন গঠন হলে তাকে পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে।’ ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কমিশনের সদস্যদের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সততাই হবে একমাত্র যোগ্যতা। যাতে তারা নির্মোহভাবে প্রভাবের বাইরে থেকে কাজ করতে পারেন। কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। এ ছাড়া, সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন, অর্থ্যাৎ কমিশন যে সুপারিশ দেবে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। কমিশন গঠনের সময়ই স্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দিয়ে একটি রোডম্যাপ দিতে হবে।’ একইসঙ্গে সুপারিশগুলো কবে থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে তারও একটা ঘোষণা থাকতে হবে বলে মনে করেন বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। প্রতিষ্ঠানটির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচায বলেন, ‘এ মুহূর্তে ব্যাংকিং খাত নিয়ে আস্থার সঙ্কট আছে। একটা স্বচ্ছতার সঙ্কট আছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বস্থতার সঙ্কট আছে। আস্থার সঙ্কট, স্বচ্ছতার সঙ্কট, বিশ্বস্থতার সঙ্কট কাটিয়ে উঠে এ কমিশনকে (ব্যাংকিং কমিশন) কাজ করতে হবে।’ অর্থনীতির এ বিশ্লেষক বলেন, ‘এর জন্য সর্বোপরি প্রয়োজন পড়বে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আলোকিত সমর্থন। ওনারা (রাজনৈতিক নেতৃত্ব) যদি এ কমিশনের ওপর একটি এনলাইটেন সাপোর্ট (আলোকিত সমর্থন) না দেন, তাহলে এ কমিশন শুধু একটি কমিশনই থেকে যাবে। ব্যাংকিং খাতের কার্যকর পরিবর্তনের সুযোগ হয়তো আসবে না।’ তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমস্যা এক সময় রাজনৈতিক অর্থনীতি সমস্যায় উপনীত হয়েছিল। রাজনৈতিক অর্থনীতি সমস্যা এখন রাজনৈতিক সমস্যা হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে রাজনৈতিক সমর্থন বাদ দিয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ যে সীমিত তা প্রমাণ পায় নতুন ব্যাংক দেয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন ব্যাংক হবে না, তারপরও নতুন তিনটি ব্যাংক হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নাগরিকরা অসহায় আতঙ্ক নিয়ে একটা ভয়ঙ্কর ভঙ্গুর পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছি। এটা শুধু মন্দ ঋণের বিষয় নয়। মন্দ ঋণ অব্যাহত রয়েছে, শত প্রতিশ্রুতি ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার পরও। এর নিচে লুকিয়ে রয়েছে পুঁজির ঘাটতি, সঞ্চিতির ঘাটতি, বাণিজ্যিক লাভের ঘাটতি। এখন ব্যাংকে মানুষের টাকা রাখার পরিমাণ কমে গেছে।’ সিপিডি ফেলো বলেন, ‘সব থেকে বেশি বিচলিত করছে কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব সুবিবেচিত নীতিমালা দেয়া হয়েছে তার প্রকাশ্য বরখেলাপ। বরখেলাপগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে বেআইনী কার্যকলাপে উপনীত হচ্ছে। ফলে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানকে এখানে যুক্ত হতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, আমরা দেখছি গুটিকয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে এখন পুরো ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি যখন ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করছিল, সে রকম একটি পরিস্থিতিতে ২০১২ সালে হল-মার্কের কেলেঙ্কারি উদঘাটিত হয়, তখন থেকে আমরা ব্যাংকিং কমিশনের বিষয়ে বলে আসছি। এখন যেহেতু এটা কিছুটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে আমরা অত্যন্ত প্রিত, খুশি এবং সম্পূর্ণ সাফল্য কামনা করছি। দেবপ্রিয় বলেন, এ ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে আশীর্বাদ ও সম্মতি এসেছে। এ জন্য আমরা খুবই উচ্ছ্বসিত। আমরা মনে করি, এটা অত্যন্ত বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। এ কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে, তথ্যনির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে কাজ করতে পারে; তার জন্য তাদের পরিবেশ, ক্ষমতা ও সুযোগ দিতে হবে। কমিশনকে জরুরী বিষয়ে দ্রুত সমাধানের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দিতে হবে। এগুলো আগামী বাজেটের আগেই দিতে হবে। ব্যাংকিং কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, স্বচ্ছ, সম্মুখ, তথ্যনির্ভর এবং পূর্ণভাবে একটি মাপকাঠি নির্মাণ করা দরকার বংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে। সেইসঙ্গে প্রকাশিত ও উদঘাটিত পরিস্থিতি জাতীয় অর্থনীতির জন্য কী ধরনের অভিঘাত রাখছে এবং এ পরিস্থিতির তাৎপর্য কী তা বিশ্লেষণ করে কমিশনকে বলতে হবে। একইসঙ্গে বিরাজমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার থেকে ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কমিশনকে সমস্যার গভীরে যেতে হবে। আমরা দেখতে চাই কমিশনে কাদের ডাকা হবে, তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে কী ধরনের ক্ষমতা দেয়া হবে। ব্যাংকিং খাতের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের সমস্যা আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে দিচ্ছি। এই যে গভীরতর যেসব সমস্যা তার সমাধান যদি করতে না পারে তাহলে তা কাজে আসবে না। এ জন্য সরকারের আলোকিত সমর্থনের পাশাপাশি আলোকিত স্বার্থপরতাও থাকতে হবে, তা না হলে অর্জনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।
×