ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদার মুক্তির জন্য চেষ্টা-তদ্বির স্বজনদের

প্রকাশিত: ১০:২০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

খালেদার মুক্তির জন্য চেষ্টা-তদ্বির স্বজনদের

শরীফুল ইসলাম ॥ কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির অপেক্ষায় তার স্বজনরা। তিনি আদৌ মুক্তি পাবেন কিনা, পেলেও কখন পাবেন এ নিয়ে তাদের ভাবনার শেষ নেই। তবে যে কোনভাবেই হোক এ মাসেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন এমনটি ধরে নিয়ে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা। এদিকে মুক্তি না পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে এবং পেলে কিভাবে তাকে লন্ডনে চিকিৎসার জন্য নেয়া হবে এবং কোথায় তার চিকিৎসা হবে সে বিষয়েও বিএনপি প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, লন্ডনে তারেক রহমানের ক’জন ঘনিষ্ঠজন খালেদা জিয়ার মুক্তির পর কিভাবে তাকে লন্ডনে নিয়ে চিকিৎসা করা হবে সে জন্য কাজ করছেন। সূত্র জানায়, লন্ডন থেকে প্রতিদিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আপডেট জানতে চান। পরিবারের সদস্যরাও প্রতিদিনই দলীয় আইনজীবী, চিকিৎসক, দলীয় নেতা ও সরকারী দলের বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের জামিনের আবেদনের প্রেক্ষিতে রবিবার উচ্চাদালতে শুনানির পর জামিন হতে পারে বলে তারা আশা পোষণ করছেন। আর কোন কারণে এই প্রক্রিয়ায় না হলেও অন্য কোন প্রক্রিয়ায় যাতে তাকে মুক্ত করা যায় সে চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছেন স্বজনরা। এভাবেই তাকে মুক্ত করে এ মাসেই বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করতে স্বজনদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবারও স্বজনরা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাক্ষাত করেন। বিকেল ৩টার দিকে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দারের নেতৃত্বে ছয় জন স্বজন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তারা বেরিয়ে আসেন। তবে বেরিয়ে এসে শামীম ইস্কান্দার বা অন্য কোন স্বজন গণমাধ্যমের সঙ্গে কোন কথা বলেননি। স্বজনদের মধ্যে ছিলেন-শাফিন ইস্কান্দার (ভাতিজা), অরণী ইস্কান্দার (ভাতিজার স্ত্রী), অভিক ইস্কান্দার (ভাতিজা), শাহরিয়া হক (ভাগিনা) ও কানিজ ফাতেমা (ছোট ভাইয়ের স্ত্রী)। কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে বেশ ক’দিন আগে থেকেই পরিবারের পক্ষ থেকে লবিং-তদবির চালানো হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া নিজে প্যারোলে মুক্তির আবেদনে স্বাক্ষর না করায় এ বিষয়ে তেমন অগ্রসর হতে পারেনি তারা। তবে এখন আবার নতুন করে প্রক্রিয়ায় চেষ্টা তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। খালেদা জিয়ার স্বজনরা এখন তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন দুইভাবে। প্রথমত, প্যারোলের বিষয়ে রাজি করানো। আর তা সম্ভব না হলে বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে বিকল্প উপায়ে তাকে মুক্ত করা। এ ব্যাপারে কারাকর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে তারা। তারা উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে তাকে প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করবেন। জীবন রক্ষার স্বার্থে খালেদা জিয়া যেন রাজি হন সে চেষ্টা চালাবেন। তবে তিনি প্যারোলের আবেদনে স্বাক্ষর করতে রাজি না হলে কিভাবে বিকল্প কায়দায় তাকে মুক্ত করে কিভাবে বিদেশে পাঠানো যায় সে চেষ্টা চালানো হবে। জানা যায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয় নিয়ে দলের মহাসচিবসহ কিছু নেতা আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করলেও খালেদা জিয়া প্যারোলে রাজি না থাকায় সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। আর এ কারণেই মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বা অন্য কোন নেতার সঙ্গে কেউ কথা বলেননি। তবে ফখরুলের এ কথার পর ওবায়দুল কাদের তার কাছে ফোনালাপের রেকর্ড আছে জানালে এ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করেননি বিএনপি মহাসচিব। ফখরুলের এ বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপি খালেদা জিয়ার মঙ্গল চায় না। বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি করতে চায়। তবে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিবসহ দলের কিছু নেতা আগের অবস্থান থেকে সরে আসার বিষয়টিকে তার পরিবারের সদস্যরা ভালভাবে নিতে পারেননি। তাই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপির ওই নেতাদের বাদ দিয়ে অন্য নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে নতুন উদ্যমে চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদিকে আইনজীবীদের নতুন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে উচ্চাদালতে আবেদনের পর তার মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকদের সঙ্গেও পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার বিষয়টি যাতে আদালতে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকেও সঠিকভাবে যায় সেটাই স্বজনরা চায়। এ চেষ্টায় সফল হলে আদালতেই জামিন হতে পারে বলে বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করছেন। কারাবন্দী খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় আসে ১১ ফেব্রুয়ারি তার বোন সেলিনা ইসলাম জরুরী ভিত্তিতে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার কথা বলার পর থেকে। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, যে কোনভাবেই হোক তারা খালেদা জিয়ার মুক্তি চান। ওই দিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার সুপারিশ করার জন্য খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার একটি আবেদন করেন। এর পর থেকেই খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। মাঝখানে এই জল্পনা-কল্পনা কিছুটা থেমে গেলেও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার কথা বলে মুক্তির আবেদন করায় নতুন করে এ বিষয়টি আলোচনায় স্থান পায়। খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি করার বিষয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলীয় এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ফোনালাপের বিষয়টি জানান। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও ওবায়দুল কাদের জানান। আর এরপর থেকেই সারাদেশের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে আলোচনায় স্থান পায় বিষয়টি। যদিও বিএনপি মহাসচিব ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলার কথা স্বীকার করলেও প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেননি বলে জানান। খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষায়িত হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দাবি করে আসছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছে বিএনপি। তবে ১১ ফেব্রুয়ারি আগে তারা বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার কথা স্পষ্ট করে বলেননি। গত বছর ১ এপ্রিল থেকে কারাবিধি অনুযায়ী বন্দী হিসেবে তাকে সরকারী হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। খালেদা জিয়ার দাঁত ও জিহ্বার চিকিৎসা সেখানে ভালভাবে সম্পন্ন হলেও তার ডায়াবেটিসসহ আরও কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়। এর প্রভাবে তিনি যে কোন সময় আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন এবং বড় কোন অঘটন ঘটলে সরকার দায়ী থাকবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে হুঁসিয়ারিও উচ্চারণ করা হয়েছে। দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া কারাবন্দী। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে কারা হেফাজতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চিকিৎসাধীন। তার সুচিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন ধরে স্বজনরাসহ বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে পরিবারের সদস্যরাসহ বিএনপির কিছু নেতা তাকে মুক্ত করে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নিতে চান। এখন খালেদা জিয়ার স্বজনরা অপেক্ষা করছেন কখন তার মুক্তি হয় সে জন্য। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেয়ার সকল প্রস্তুতিও তারা নিয়ে রেখেছেন। প্রথমে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় নিয়ে সেখান থেকে লনডনের ভাল কোন হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। এরপর পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তারেক রহমানের বাসায়ই তার থাকার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।
×