ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি ॥ গ্রন্থমেলা প্রতিদিন

প্রকাশিত: ১১:০৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি ॥ গ্রন্থমেলা প্রতিদিন

মনোয়ার হোসেন ॥ বড্ড ব্যস্ত শহর ঢাকা। এখানে সমান্তরালে ছুটে চলে জীবন আর জীবিকা। আছে যান আর জনজটের ভোগান্তি। তবে এই অজস্র ঝক্কি-ঝামেলার ভেতরেও জেগে ওঠে প্রাণের ঢাকা। ধরা দেয় ভাললাগার অনুভব। অনুর্ধ উনিশ ক্রিকেটারদের চমকে দেয়া বিশ্বকাপ জয় তেমনভাবেই আন্দোলিত করেছে শহরবাসীকে। স্পন্দিত হয়েছে নগরের কোটি প্রাণ। সপ্তাহের শেষভাগে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরেছে অনুর্ধ-১৯ ক্রিকেট দল। অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দেয়া আকবর আলীদের বরণ করে নিতে এয়ারপোর্ট থেকে মিরপুর পর্যন্ত সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল ক্রিকেটপ্রমীরা। জানিয়েছে বিশ্বকাপজয়ীদের প্রতি ভালবাসা। এমন আনন্দের মাঝে কয়েকটি উৎসবের সূত্র ধরে ¯িœগ্ধ রূপ নিয়েছে বায়ান্ন বাজার তিপান্ন গলির ঢাকা। শহরজুড়েই বইছে বসন্ত বরণ ও ভালবাসা দিবস উদ্্যাপনের সুন্দরতম দৃশ্যচিত্র। শুধু কি তাই? মনন বিকাশের অপরূপ প্রতিচ্ছবি মেলে ধরেছে ভাষাশহীদদের নিবেদিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমিতে বই নিয়ে কেটে যাচ্ছে গ্রন্থানুরাগীদের সুসময়। শিল্প-সংস্কৃতি যারা পছন্দ করেন তাদের মন রাঙাতে চলছে দুটি বড় উৎসব। সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তনে ঘিরে চলছে জাতীয় নাট্যোৎসব। দেশব্যাপী নাট্যচর্চার তাগিদে ঢাকা থেকে সূচনা হওয়া উৎসবটি পৌঁছে গেছে বাকি ৬৩ জেলায়। জঙ্গীবাদ আর অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনায় গ্রুপ থিয়েটারের ফেডারেশন আয়োজিত ৩০২টি নাটকে সজ্জিত উৎসবটিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন সারাদেশের চার শতাধিক নাট্যদলের ত্রিশ হাজার নাট্যকর্মী। অন্যদিকে শিল্পকলার চিত্রশালায় চলছে শিল্পরসিকদের নয়নজুড়ানো ঢাকা আর্ট সামিট। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের পাঁচ শ’র বেশি চিত্রকর ও ভাস্করের শিল্পসম্ভার দেখার সুযোগ করে দিয়েছে এই শিল্প সম্মেলন। শিল্পমনা নগরবাসীরাও বিবিধ বিষয়ক সেসব শিল্পের টানে ভিড় জমাচ্ছেন এই শিল্প-আসরে। বৃহস্পতিবার ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলার দ্বাদশতম দিন। এদিন প্রাক বসন্তের আমেজটি দারুণভাবে ধরা দিয়েছে বইমেলায়। সঙ্গে ছিল আগাম ভালবাসা দিবস উদযাপনেরও চিত্রকল্প। বিকেল থেকেই পাঠক আর দর্শনার্থীর আগমনে সরব হয়েছে গ্রন্থমেলা। সন্ধ্যায় জমাটবাঁধা পাঠক আর আড্ডাবাজদের আগমনে মুখরিত হয়েছে মেলা। অধিকাংশ প্যাভিলিন থেকে স্টলেই ছিল গ্রন্থানুরাগীদের পদচারণা। বসন্তের আগাম উদযাপনে কপালে ফুলের টায়রা পরা তরুণীদের হাতে হাতে ঘুরেছে বইয়ের ব্যাগ। পাঞ্জাবিসহ নানা পোশাক পরিহিত তরুণ থেকে বয়োজ্যেষ্ঠরাও সংগ্রহ করেছেন আপন মননের উপযোগী গ্রন্থটি। সেই সুবাদে বইয়ের বিকিকিনি ভাল হওয়ায় বিস্তৃত হয়েছে প্রকাশকের হাসি। বাংলা পঞ্জিকার পরিবর্তনে কারণে দুই উৎসব মিলে যাচ্ছে আজ শুক্রবার। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন পয়লা ফাল্গুন এবং ভালবাসা দিবস এক হয়ে যাবে আজ। সব মিলিয়ে ছুটির দিনে ভিন্নরকম রূপ নেবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। লোকে লোকারণ্য হবে মেলার মাঠ, এটাই প্রত্যাশিত। আজ বইমেলার দ্বার খুলে যাবে বেলা ১১টায়। দুপুর ১টা পর্যন্ত চলবে শিশুপ্রহর। মেলা চলবে টানা রাত ৯টা পর্যন্ত। এমন একটি কাক্সিক্ষত দিনের অপেক্ষাই করছিলেন লেখক, পাঠক ও প্রকাশকরা। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রকাশক আদিত্য অন্তর বলেন, আমাদের জন্য কাল (আজ শুক্রবার) মেলার কাক্সিক্ষত একটি দিন। একইসঙ্গে পহেলা বসন্ত, ভ্যালেন্টাইস ডে ও শুক্রবার। সব মিলিয়ে জমে উঠবে মেলা। শুধু তাই নয় এই রেশ অব্যাহত থাকবে মেলার শেষ দিনটি পর্যন্ত। নতুন বইয়ের খবর বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নতুন বই প্রকাশ হয়েছে ১৮০টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছে সুব্রত বড়ুয়ার বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন কথা’। অনন্যা এনেছে আনিসুল হকের ‘কবিতা সমগ্র’ ও রকিব হাসানের গোয়েন্দা কাহিনী ‘শয়তানের বাঁশি’। অন্যধারা প্রকাশ করেছে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার বই ‘আমার একজনই বন্ধু’। আদর্শ এনেছে জাকির তালুকদারের উপন্যাস ‘হাঁটতে থাকা মানুষের দল’। কথাপ্রকাশ এনেছে আনজীর লিটনের প্রবন্ধ ‘গদ্যের ধারাপাত’। একই প্রকাশনা থেকে এসেছে রেজানুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘আবাস ভূমি’। শোভা প্রকাশ এনেছে কচি খন্দকারের গল্পগ্রন্থ ‘এক ঢিলে দশ পাখি’। নালন্দা এনেছে সুধাংশ শেখর বিশ্বাসের ভ্রমণগল্প ‘মস্কোর ঘণ্টা’। সময় প্রকাশন এনেছে প্রসূন রায়ের ‘রাশিয়ার পরিব্রাজক প্রথম খ-’ ও গোলাম রব্বানী টুপুলের ‘ভূত রহস্য’। চন্দ্রাবতী একাডেমি এনেছে খান মাহবুবের ভ্রমণগ্রন্থ ‘সীমান্তের ওপারে’। মেলামঞ্চের আয়োজন বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সুব্রত বড়ুয়া রচিত বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন বড়ুয়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন লুৎফর রহমান রিটন এবং মনি হায়দার। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন সুব্রত বড়ুয়া। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। প্রাবন্ধিক বলেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ দর্শন জানা এবং চর্চা করা। নতুন প্রজন্মের নবীন-তরুণদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যত আগ্রহ সৃষ্টি করা যাবে, তারা ততই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ার পক্ষে এটা হতে পারে অত্যন্ত জরুরী উদ্যোগ। সুব্রত বড়ুয়া রচিত বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা গ্রন্থখানি কিছুটা হলেও আমাদের এগিয়ে দেবে সেই লক্ষ্যে। উক্তি-ভাষ্যে, আলোচনায় বঙ্গবন্ধুকে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে বিশ্বনেতার মানদ-ে। আলোচকবৃন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিশাল সমুদ্রের মতো যিনি তাঁর চেতনায় ধারণ করেছেন বাংলা, বাঙালী ও বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখক সুব্রত বড়ুয়া বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য ও সংগ্রামী জীবনকে ইতিহাস ও তথ্যের ভিত্তিতে তুলে আনার প্রয়াস পেয়েছেন। এক কথায় বলা যায় সাবলীল ভাষায় লেখা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম বিষয়ক এটি এক অনন্য গ্রন্থ। গ্রন্থের লেখক বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা গ্রন্থটি লেখার পেছনে যে দুটি বিষয় আমার প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে তা হলো বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। এ গ্রন্থে আমি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর জীবনকে ইতিহাস, সংগ্রাম ও কর্মের প্রেক্ষাপটে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। বৃহস্পতিবার লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, মৌলি আজাদ, রাসেল আশেকী এবং শোয়েব সর্বনাম। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি মাহবুব সাদিক, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, মুনীর সিরাজ এবং মাসুদ হাসান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মোঃ শাহাদাৎ হোসেন, অনিমেষ কর এবং তামান্না সারোয়ার নীপা। নৃত্য পরিবেশন করেন সৌন্দর্য প্রিয়দর্শিনী ঝুম্পা-এর পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘জলতরঙ্গ ডান্স কোম্পানি’র নৃত্য শিল্পীবৃন্দ। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী দীনাত জাহান মুন্নী, আঞ্জুমান আরা শিমুল, কাজী মুয়ীদ শাহরিয়ার সিরাজ জয়, মোঃ রেজওয়ানুল হক এবং সঞ্জয় কুমার দাস।
×