ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদান

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদান

(গত শুক্রবারের পর) সুলতানি আমলের প্রায় সব সুলতানই বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিশেষ করে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কবীন্দ্র পরমেশ্বর সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন : কলিযুগ অবতার গুণের আধার/পৃথিবী ভরিয়া যাঁর যশের প্রসার। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেন তা স্বাধীন ইলিয়াস শাহী সালতানাত নামে দীর্ঘ দুইশ বছরের অধিককাল স্থায়ী ছিল। এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক বিস্তার ঘটে। বাংলা সাহিত্যের এই বিস্তারের নব নব অধ্যায় পরবর্তীকালেও নির্মিত হয়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ বলতে যে সময়কালকে বুঝানো হয় মূলত সেটাই হচ্ছে বাংলার সুলতানগণের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্য নির্মাণের যুগ। আর সেটাই হচ্ছে বাংলা ভাষার আলোকিত যুগ। সপ্তদশ শতাব্দীতে কবি আবদুল হাকিম, সৈয়দ আলাওলসহ বহু কবি অবদান রেখেছেন। কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার কদর সমুন্নত করতে গিয়ে লিখেছেন : যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/ দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়। সেকালের অন্যান্য কবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, শেখ ফয়জুল্লাহ, শেখ চান্দ, দোভাষী পুঁথির উদ্ভাবক শাহ গরীবুল্লাহ প্রমুখ। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যখন বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায় তখন শাহ গরীবুল্লাহর বয়স ২৪ বছর। তার রচিত ছহি জৈগুন নামক পুঁথিতে তিনি বলেন : আল্লাহকে একিন জান হইয়া মমিন/খুশিতে কবুল কর মোহাম্মদী দীন। পলাশীর যুদ্ধের পর এদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুসলিমদের দমন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ বছর ধরে গড়ে ওঠা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাঞ্জলতার টুঁটি চেপে ধরে তাকে কটমটে ও দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দ যোগ করে কঠিন ভাষায় পরিণত করে। এ সম্পর্কে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন : ‘যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়তো এই পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু মুসলমানের পুস্তকের ভাষা হইত।’ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে দুর্বার স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় এই নতুন দুর্বোধ্য সংস্কৃত বহুল বাংলায় মুসলিমগণ বাংলা সাহিত্য চর্চায় অনেকটা অমনোযোগী থাকে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী-জনতার মহাবিপ্লবের পরে নতুন করে তারা আবার কলম ধরে। ওই শতাব্দীর আশির দশকে ফুরফুরা শরিফের পীর সাহেব কেবলা মুজাদ্দিদে যামানা মওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) বাংলায় সাহিত্য চর্চায় জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তখন থেকেই নব উদ্যমে সাহিত্য চর্চায় লিপ্ত হন মুসলিম কবি-সাহিত্যিকগণ যাদের তালিকা সুদীর্ঘ। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম প্রামাণ্য বিস্তারিত ও মৌলিক তাসাউফ গ্রন্থ এরশাদে খালেকিয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব। এই গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন যশোরের খড়কীর পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ আবদুল করিম রহমতুল্লাহি আলায়হি। ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকেই মুসলিম কবি-সাহিত্যিক লেখকদের মধ্যে বিপুল উদ্যমের সৃষ্টি হয় কায়কোবাদ, মীর মশাররফ হোসেন, মুন্সী রিয়াজউদ্দীন আহমদ, রিয়াজউদ্দীন মাশহাদী, মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শেখ আবদুর রহীম, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এয়াকুব আলী চৌধুরী, কাজী আবদুল ওদুদ, ডক্টর লুৎফর রহমান, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, কাজী ইমদাদুল হক, নজিবর রহমান, কবি গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্্দীন, ফররুখ আহমদসহ আরও অনেকে বাংলা সাহিত্যের নব নব অধ্যায় সৃষ্টি করেন। কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে আবির্ভূত হয়ে বাংলা কাব্যে রীতিমতো বৈপ্লবিক অবদান রাখেন। রবীন্দ্র সুদৃঢ় বলয় ভেদ করে তিনি আর এক মজবুত বলয় সৃষ্টি করেন। এর ফলে যে গতিবেগ সৃষ্টি হয় মুসলিম মননে তার ধারাবাহিকতা একংবিংশ শতাব্দীতে এসেও নতুন নতুন মাত্রা এবং উন্নততর আঙ্গিক সৃষ্টি করে এগিয়ে চলেছে। যে বাংলা ভাষা মুসলিম আগমনের পূর্বে নিদারুণ অবহেলিত অবস্থায় ছিল, যে বাংলা ভাষা চর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যাওয়ার ভয় দেখানো হতো, সেই বাংলা ভাষা মুসলিম সুলতানগণের একান্ত পৃষ্ঠপোষকতায় শাহী সম্মান লাভ করেছিল, তাকে আবার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অধিষ্ঠিত করার জন্য উনিশশো বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিক, সালাম প্রমুখ তরতাজা প্রাণ নিজেদের রক্ত ঝরিয়ে জান কোরবান করে দিয়ে বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে মাতৃভাষার মর্যাদার নবঅধ্যায় রচিত করলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা কায়েম হলো। আর সেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে সজ্ঞাত চেতনার রাজপথ ধরে ১৯৭১-এর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করল। বাংলা ভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে রক্ত ঝরেছিল তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও জাতির মধ্যে মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত করার জন্য অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে। এসবই বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদানের ফসল। এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে বাংলাভাষী জনসংখ্যা প্রায় ২২ কোটি, যার মধ্যে মুসলিম হচ্ছে ১৫ কোটি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×