ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টেকসই উন্নয়নে প্লাস্টিকের বহুবিধ ব্যবহার

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

টেকসই উন্নয়নে প্লাস্টিকের বহুবিধ ব্যবহার

মহসিনা আক্তার ॥ প্লাস্টিক হল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ আবিষ্কার যা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এবং আমাদের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে নিয়ে এসেছে। আজকের বিশ্বে প্লাস্টিক সর্বব্যাপী জীবনের মান উন্নয়নে অবদান রাখছে। পোশাক থেকে আশ্রয়, যোগাযোগ থেকে পরিবহন, বিনোদন থেকে স্বাস্থ্যসেবা এমন কোন মানবিক ক্রিয়াকলাপ নেই যেখানে প্লাস্টিক ভূমিকা পালন করে না। প্লাস্টিকের এই বহুবিধ ব্যবহারের কারণ হল- হালকা ওজন, সহজে প্রক্রিয়াকরণ এবং মজবুত। কম খরচ, সহজ উৎপাদনযোগ্যতা, বহুমুখীতা, পানির সাথে সংবেদনহীনতা, বহনযোগ্যতা ইত্যাদি কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে পলিমারের তৈরি প্লাস্টিক সামগ্রী৷ ১৯৫০ সালে যখন প্রথম প্লাস্টিকের উৎপাদন শুরু হয়, তখন থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৯.১ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে। পঞ্চাশের দশক থেকে হিসাব করলে এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত একশ পচাত্তর মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। প্লাস্টিকের এই যুগে প্লাস্টিক, রাবার ও সিনথেটিক ফাইবার ছাড়া জীবন-মান অনেকাংশেই দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। প্লাস্টিক মূলত এক ধরনের পলিমার। প্রকৃতি বহু শতাব্দী ধরে এই প্লাস্টিক জাতীয় উপকরন ব্যবহার করে আসছে। প্লাস্টিকের বহুবিধ ব্যবহার অনেকাংশেই প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে যাচ্ছে, উদাহরনস্বরূপ- ভোজ্যতেল এবং দুধের প্যাকেজিং নমনীয় ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের ব্যবহার টিন ও কাচের ব্যবহার কমিয়েছে। তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী এবং হালকা বলে বর্তমানে কাঠের পাশাপাশি প্লাস্টিকের আসবাবপত্র এবং উপকরণের বাজারও বেশ ভালো। এসব আসবাবপত্র ও উপকরণের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ার, টেবিল, সোফা, আলমারি, ওয়ারড্রোব, কিচেন রেক, লন্ড্রি বাস্কেট, বালতি, স্টোরেজ বক্স, হটপট, ড্রাম, কনটেইনার ইত্যাদি। হাই-ডেনসিটি পলি ইথিলিন ব্যারেল ব্যবহার করা হচ্ছে কেমিক্যাল স্টোরেজের জন্য যা স্টিল ড্রামের বিকল্প হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা ছাড়াও আধুনিক শিল্প ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। ওজনে তুলানামূলক হালকা হওয়ায় অটোমোবাইল এবং বিমানের মতো শিল্পগুলিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে উচ্চ গতি এবং জ্বালানী দক্ষতা দু’টিই অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে। আধুনিক শিল্প কারখানাগুলো ভারি ধাতুর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত হালকা প্লাস্টিকের পলিমার ব্যবহার করছে। প্লাস্টিক ব্যাগ, পলিব্যাগ বা থলি এমন এক ধরনের পাত্র যা পাতলা, নমনীয়, প্লাস্টিকের ফিল্ম, নন ওভেন ফেব্রিক বা প্লাস্টিকের টেক্সটাইল দিয়ে তৈরি। প্লাস্টিকের ব্যাগ সাধারণত খাদ্য, উৎপাদন, গুঁড়ো, বরফ, ম্যাগাজিন, রাসায়নিক এবং বর্জ্য হিসাবে পণ্য ধারণ ও পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি প্যাকেজিংয়ের একটি সাধারণ রূপ। নির্মাণের উপর নির্ভর করে, প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত হতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশে চামড়াবিহীন জুতা তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে কৃত্রিম চামড়া (সিনথেটিক), রাবার, প্লাস্টিক কিংবা কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলো রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের নামী ব্র্যান্ডগুলোর কাছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৯১ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। জুতা রপ্তানির মোট আয়ের ৩০ শতাংশ এসেছে চামড়াবিহীন জুতা থেকে। বিশ্বখ্যাত জুতা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান এডিডাস সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে জুতা উৎপাদন করে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। অন্য অনেক বস্তু যে সুবিধা দিতে পারেনা, একসঙ্গে বহুমুখী কর্মক্ষমতা সম্পন্ন প্লাস্টিক সেই সুবিধা প্রদান করে বলেই ডিজাইনার ও ইঞ্জিনিয়ারদের এত পছন্দের প্লাস্টিক। আধুনিক ভবন এবং নির্মাণগুলিতে কাঠের পরিবর্তে প্লাস্টিকের দরজা, জানালা, মেঝে এবং প্রাচীরের আচ্ছাদনগুলি ব্যবহার করে বৃক্ষ সংরক্ষনে অবদান রাখছে। প্লাস্টিকহীন কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য নিস্ফল এক আবেদন। বাংলাদেশ নয় শুধু গোটা উন্নয়নশীল আর অনুন্নত বিশ্বে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। বাচ্চাদের খেলনা সামগ্রী তৈরির ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বিকল্প নেই কারণ প্লাস্টিকের খেলনা সহজে ভাঙ্গে না এবং কম দামেই ছোটখাট খেলনা পাওয়া যায়। দামে সস্তা ও রঙিন প্লাস্টিকের খেলনা গ্রাম বা শহর দুই জায়াগার বাচ্চাদের কাছেই সমান জনপ্রিয়। উন্নতমানের প্লাস্টিক দিয়ে খেলনা তৈরি করতে পারলে বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব। স্বাস্থ্যসেবা খাতেও রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। রক্ত ব্যাগ, টিউবিং, হার্ট ক্যাথেটার, ডিসপোজাবল পণ্য (গাউন, মাস্ক, সিরিঞ্জ) ইত্যাদি পণ্য তৈরিতে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় কারণ এগুলো যেমন সহজ, স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও নিরাপদ। অধিকাংশ প্লাস্টিকই তৈরি হয় পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ থেকে। প্লাস্টিকের এই উৎপাদন জীবাশ্ম জ্বালানির উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলছে তা কিন্তু নয়। মোট উৎপাদিত পেট্রোলিয়াম এর মাত্র ৫% ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিক উৎপাদনে। অনেক প্রাকৃতিক উপকরন (গ্যাস, কাগজ, কাঠ, ধাতু) প্রক্রিয়াকরণ জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে প্রাপ্ত শক্তি অনেক বেশি ব্যবহার করে। সুতরাং প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে অনেকাংশেই জীবাশ্ম জ্বালানির উপর চাপ কমানো যায় যা টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পরিবেশবিদদের কাছে প্লাস্টিকের দূষণ বর্তমানে খুবই একটি আলোচিত বিষয়। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে প্লাস্টিকের দূষণ অনেকাংশেই কমানো যায়। প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী হৈচৈটা অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী অনেক গবেষণা চলমান বায়োমাস (biomass) এবং রিনেবেভল রিসোর্স (renewable resource) থেকে প্লাস্টিক তৈরির জন্য। একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যা প্লাস্টিকের ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, সেটি হল প্লাস্টিক মাটি বা পানির সাথে অপচনশীল। সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক মিশে এই দূষণ মারাত্মক আকারে সমুদ্রের ইকোসিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। কিন্তু সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এবং পর্যাপ্ত পুনর্ব্যবহার সুবিধার আওতায় আনলে এই ক্ষতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়। মূলত সঠিক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পারে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে, উপরন্তু যে কাচামাল থেকে প্লাস্টিক তৈরি হয় সঠিক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আবার ওই কাচামালই তৈরি করা যায়। কোন পণ্য বা উপাদানকে সত্যিই টেকসই হিসাবে বর্ণনা করার জন্য এটি পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে টেকসই হতে হবে। এই দিকগুলো হল স্থায়িত্বের তিনটি স্তম্ভ। স্থায়িত্বের তিনটি স্তম্ভ প্লাস্টিক ইতিবাচক অবদান রাখছে। প্লাস্টিক শক্তি সাশ্রয়কারী সম্ভবনা এবং অভ্যন্তরীণ পুনর্ব্যবহার যোগ্যতা এবং শক্তি পুনরুদ্ধারের বিকল্পগুলোর মাধ্যমে পরিবেশগত স্থায়িত্বের জন্য বিশাল অবদান রাখছে। অর্থনৈতিকভাবে প্লাস্টিক কেন্দ্রিক শিল্প কারখানাগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সামাজিকভাবে প্লাস্টিক ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ও শিল্প উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন আনছে। উন্নত দেশগুলোতে টেকসই উন্নয়নে রাস্তা তৈরিতে ব্যবহার করছে প্লাস্টিক। বিটুমিন নামের এক কালো হাইড্রোকার্বন আর নুড়ি পাথরের মিশ্রণ রাস্তায় বিছানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে বিটুমিন আর পাথরের মিশ্রণে গলিত প্লাস্টিক মেশানো হলে প্লাস্টিক এই দুই উপাদানকেই ধরে রাখে। বিটুমিন-মডিফাইড প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে টেনসাইল স্ট্রেংথ বৃদ্ধি পাবার ফলে রাস্তা হয় আরও বেশি নমনীয়, ঘাতসহ ও টেকসই। বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো রাস্তায় খানাখন্দের উৎপত্তিও হয় না। আর বিটুমিন ও নুড়ি পাথরের মিশ্রণের উপাদানগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা গলিত প্লাস্টিক পূরণ করে দেওয়ার ফলে জমে থাকা পানি থেকে অবকাঠামোগত ত্রুটিও দেখা দেয় না। পেট (চঊঞ) বোতল ভোক্তাকে আস্থা প্রদান করে যাচ্ছে পানীয় জল সংরক্ষণ করে ব্যবহার করার জন্য সাথেসাথে পানিবাহিত রোগ হ্রাস করতে সহায়তা করছে। ফাইবার তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিকের বোতল। কাঁচামাল হিসেবে প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া বোতল ব্যবহার করায় পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ ফাইবার বানাতে যে ধরনের বোতল ব্যবহৃত হয় তা মাটির সঙ্গে মেশে না। ফলে পরিবেশের ব্যাপক দূষণ করে এটি। সেজন্য পরিবেশ সুরক্ষায় ফেলে দেওয়া এই বোতল কারখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে কাঁচামাল হিসেবে। এছাড়া ফাইবার বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে। জাপানের উদ্ভাবকরা প্লাস্টিক ব্যবহার করে গাড়ির কাঠামোকে মজবুত করতে বিভিন্ন সোর্স ব্যবহার করেছেন। সাধারণ গাড়ির চেয়ে এই গাড়ি অধিক হালকা। এছাড়া প্লাস্টিকের গাড়ি জ্বালানি খরচও কমিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় গাড়িচালকদের জ্বালানি ব্যয় কমে যাবে। গাড়িতে সাধারণত স্টিলের ব্যবহারই বেশি করা হয়। যেটা ভারী হয়ে থাকে। এর সঙ্গে গ্যাস, রাবার, তামার তার, কোবাল্টসহ অন্যান্য পদার্থ যোগ করলে আরও ভারী হয়। প্লাস্টিকের গাড়ির শুধু এই ওজন সমস্যার সমাধান করবে না, বরং গাড়িকে স্থায়ীও করবে। কারণ এর ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা কম। এটা শব্দও কমিয়ে দেবে। বর্তমান যুগে কৃষিতে প্লাস্টিক ব্যবহার কৃষি পণ্য বৃদ্ধির একটি নতুন পদ্ধতি। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্লাস্টিকালচারের উদ্ভব হয়েছিল। খুব কম দেশই কৃষিক্ষেত্রে সহায়তাকারী এই কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করতে সক্ষম হয়েছে। প্লাস্টিকালচার হল কৃষিকাজ, উদ্যানতত্ব, জল-ব্যবস্থাপনা, খাদ্যশস্যের সঞ্চয় ও সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার। জল সংরক্ষণ, সেচ দক্ষতা, ফসল এবং পরিবেশ সুরক্ষা, পাশাপাশি পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থা, সকল ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্লাস্টিকের উপকরণ এবং পণ্যগুলি স্থাপন করা হয় এই প্লাস্টিকালচারে। দেশিয়ভাবে টেকসই কৃষিকাজের অভ্যাসের অভ্যন্তরে মেইনফ্রেম পদ্ধতিতে প্লাস্টিকালচার ভালভাবে সমন্বয় করা যেতে পারে। এর কার্যকর প্রয়োগের ফলস্বরূপ কৃষির জিডিপিতে ৪ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি হতে পারে। জীবনের সর্বস্তরে প্লাস্টিকের ব্যবহার, এর সহজলভ্যতা, শক্তি সাশ্রয়কারী সম্ভাবনা এবং পুনর্ব্যবহার যোগ্যতা যেমন জীবনে স্বাচ্ছন্দ বয়ে এনেছে তেমনি অর্থনীতি তথা সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
×