ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তথ্যপ্রযুক্তি খাত

প্রকাশিত: ১০:৩০, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

  তথ্যপ্রযুক্তি খাত

ফিরোজ মান্না ॥ তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠেছে। হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি পণ্য রফতানির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশে তৈরি মোবাইল ও ল্যাপটপ রফতানি হচ্ছে আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে। আউটসোর্সিংয়ে তরুণরা ভাল করছে। তরুণ-তরুণীরা এখন ভারতের কাছাকাছি আউটসোর্সিং করছে। ফলে এই সেক্টরের ভবিষ্যত অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তৈরি পোশাক শিল্পের আয় একদিনে বাড়েনি। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশে খুব শীঘ্রই রফতানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাক খাতের জায়গা করে নেবে তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর। ডাক ও টেলিযোগযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জনকণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন। মন্ত্রী আরও বলেন, তৈরি পোশাক ধীরে ধীরে শিল্পের আয় বৃদ্ধি পেয়ে এ বছর ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিও ঠিক একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে প্রথম ধাপটি পার করব। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে। ২০৪১ সালের মধ্যে এই সেক্টর থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি আয় হবে। এবারের ডিজিটাল মেলায় আমরা এ কথাই তুলে ধরেছি। ফাইভ-জি চালু হলে জিডিপিতে গ্রোথ আড়াই থেকে তিন শতাংশ বেড়ে যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন তথ্যপ্রযুক্তিবিদরাও এই সেক্টর নিয়ে আশাবাদী। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও বেসিসের সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লা এন করিম জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। দিন দিন ‘ইমার্জিং চেইন’ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আরও বড় ‘স্কেলে’ করতে হলে ইন্টারনেট স্পীড বাড়াতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইডেন, হল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের ৭০ থেকে ৮০ দেশে আমাদের তরুণরা আউটসোর্সিং করছে। ১০ বছর আগেও এটা ভাবা যেত না। ভারতে আউটসোর্সিংয়ের জন্য হায়দরাবাদের নামই হয়ে গেলে ‘সিলিকন ভ্যালি’। তখন থেকেই দেশটির যুবসমাজ বিলিয়িন বিলিয়ন ডলার আয় করছে। এখন আমাদেরও এমন সুযোগ তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বড় কোম্পানিগুলো আমাদের তরুণদের কাজ দেয়ার জন্য আগ্রহী। কারণ এখানে প্রতি ঘণ্টা কাজ ৩ থেকে ৪ ডলারে করে নিতে পারে। অন্য যে কোন দেশ থেকে এই দামে তারা কাজ করাতে পারে না। তাই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প একদিন বড় একটা স্থান করে নেবে। তৈরি পোশাক শিল্পকে অতিক্রম করতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। তবে তথ্যপ্রযুক্তির ভবিষ্যত অনেক সম্ভাবনাময়। এবারের ডিজিটাল মেলায় ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক প্রদর্শন হয়েছে। ফাইভ-জি এলে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব সেক্টরে বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটবে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন সাব্বির জনকণ্ঠকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরটি নিঃসন্দেহে সম্ভাবনার একটি বিষয়। কারণ এই সেক্টরের ভবিষ্যত অনেক বেশি আশা জাগায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজম্মের কাছে এটা একটা বড় ক্ষেত্র। এখান থেকে তারা আয় রোজগার করতে পারবে। তবে সেবার ক্ষেত্রে সম্ভাবনা যেমন বাড়ছে তেমনই তৈরি হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জ। বেসিস, বাক্যসহ দেশে দেড় হাজার আইটি ও আইটিইএস কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের পাঁচ শ’ কোম্পানি রফতানিতে রয়েছে। শুধু বেসিসে এক হাজারের বেশি সদস্য কোম্পানি রয়েছে। অটোমেশন, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এবারের ডিজিটাল মেলায় কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানে অনেক সম্ভাবনার কথা বলা হয়। বাস্তবেও অনেক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও বলেছেন, এই সেক্টর একটি দিন তৈরি পোশাক শিল্পকে ছাড়িয়ে যাবে। এটা ঠিক যে, এই সেক্টরে অনেক কাজ আছে। কিন্তু একটা সমন্বয় লাগবে। ইন্টারনেটের উচ্চ গতি সবার আগে প্রয়োজন। তাহলে কিন্তু আমাদের প্রযুক্তিবিদরা বড় ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। দেশে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে রফতানি ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যা টাকার হিসেবে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) ও সফটওয়্যার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সরকারের টার্গেট বা লক্ষ্য ছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন রফতানি আয় করা। এ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রফতানি করা। সফটওয়্যার রফতানিতে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেয়াসহ এ খাতের উন্নয়নের নেয়া নানা পদক্ষেপের কারণে ২০১৮ সালে সফটওয়্যার রফতানি বেড়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আগে আমাদের নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করত। এখন আমরা সবদিক থেকেই নেতিবাচক ধারণাটিকে ইতিবাচক করতে পেরেছি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এক বিলিয়ন ডলারের রফতানি করতে পারবে কেউ বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারেনি। এখনও হয়ত কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, আমরা ৫ বিলিয়নে পৌঁছতে পারব। বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখাতে পারে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে। এর বড় কৃতিত্ব হচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রফতানি মানে শুধু সফটওয়্যারে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারেও উন্নতি করছে। ভারত, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি এখন ফিলিপিন্স, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। তবে দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া ব্লকচেইন, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের মতো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মানানসই প্রযুক্তি নিয়ে দেশী উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হবে। দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে। আমরা বিদেশী সফটওয়্যারকে রিপ্লেস করছি। বিদেশী সফটওয়্যারের জায়গায় দেশী সফটওয়্যার প্রতিস্থাপন করতে পেরেছি। আমাদের সফটওয়্যার ১৮০টি দেশে রফতানি হয়। আমাদের সফটওয়্যার আয়ারল্যান্ডের পুলিশ ব্যবহার করে, সিকিউরিটির জন্য আমাদের সফটওয়্যার আছে, মোবাইল অপারেটররা ব্যবহার করছে। এটার গতি অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি। বেসিস সূত্র জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যারের বাজারও বড় হচ্ছে। দেশের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আবার দেশী সফটওয়্যার নির্মাতারা দখল করেছেন। তবে বড় প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোর ক্ষেত্রে এখনও বিদেশী সফটওয়্যারের ওপর নির্ভরতা থেকে গেছে। দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৭ ব্যাংকেই দেশী সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের সফটওয়্যার খাতে বেশি চাহিদা রয়েছে ইআরপি, বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন তৈরিসহ, ডিজিটালাইজেশনের কাজে ব্যবহৃত সফটওয়্যার। দেশের বাজারে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন সফটওয়্যার নির্মাতারা বিদেশেও রফতানি করছে। তবে দেশ থেকে বড় ধরনের একক সফটওয়্যার রফতানি হাতেগোনা। এখন পর্যন্ত আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপিও, সার্ভিস রফতানি হচ্ছে। বিপিওর ক্ষেত্রে ব্যাংকের নানা কাজ, নানা রকম সেবা দেয়া হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে গ্রাফিকস, ওয়েবের কাজ হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সফটওয়্যার এখনও রফতানির সব অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে আসে না। ফলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া কঠিন যে কত ডলার বাংলাদেশ আয় করেছে।
×