ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল বিএনপির

প্রকাশিত: ১০:০৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

  সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল বিএনপির

শরীফুল ইসলাম ॥ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছেন দলের নেতাকর্মীরা। তবে তারা প্রকাশ্য প্রচারের চেয়ে গোপনে বেশি প্রচার চালাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে। এ ছাড়া ভোটের দিন যাতে কারচুপি করে বিএনপিকে তাদের প্রতিপক্ষ হারিয়ে দিতে না পারে সে জন্য প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য ১০১ সদস্যের কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হচ্ছে। এ কমিটি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোটের আগের দিন থেকে ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাহারা দেবে। সূত্র জানায়, বিএনপি প্রথমে এ নির্বাচনকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও এক পর্যায়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। একদিকে এ নির্বাচনকে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। আর অপর দিকে এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল নিয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল দেখে দলের ভবিষ্যত করণীয় ঠিক করতে চায় বিএনপি হাইকমান্ড। নির্বাচনে বিজয়ী হলে সর্বস্তরে দল গুছিয়ে আস্তে আস্তে আন্দোলনের দিকে যাবে। আর এ নির্বাচনে কারচুপির কারণে বিএনপি হেরে গেলে দ্রুতই রাজপথের আন্দোলনে নামবে। জানা যায়, শুক্রবার রাতে ২০ দলীয় জোট ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে জোট ও নিজ দলের নেতাদের নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দেন। এ সময় জোট ও বিএনপির সিনিয়র নেতারাও তারেক রহমানের নির্দেশ মেনে মাঠে সক্রিয় থাকার আশ্বাস দেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারা মুখে মুখে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বললেও বাস্তবে এ নির্বাচনকে টার্নিংপয়েন্ট হিসেবে নিয়েছে তারা। আর এ কারণেই শেষ দিকে এসে প্রকাশ্য ও গোপনে নির্বাচনী প্রচার জোরদার করেছে। প্রতিদিনই দলের সিনিয়র নেতারা কোন না কোন এলাকায় দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারে মাঠে নামছেন। এদিকে নির্বাচনী প্রচার জোরদার করার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। এ জন্য প্রতিদিনই নির্বাচন কমিশনে কোন না কোন অনিয়ম সম্পর্কে অভিযোগ করছে তারা। এভাবে নির্বাচন কমিশনকে চাপে রেখে মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলে বিএনপি বিজয়ী হতে পারবে বলে দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন। আর যদি নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারে আর ভোটে কারচুপি হয় তাহলে এ ইস্যুতেই রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে চায় বিএনপি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে জানান, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাইকমান্ডের নির্দেশে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তবে প্রকাশ্যে প্রচারের চেয়ে নীরবে প্রচারকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি ভোটারের ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করা হচ্ছে। আর ভোটের দিন যাতে কোন পক্ষ কারচুপি করতে না পারে সেজন্য ভোটের আগের দিন থেকে ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র পাহারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ জন্য ১০১ সদস্যের কেন্দ্র কমিটি গঠন করা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সিটি নির্বাচনে ইতোমধ্যেই বিএনপির পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে। তবে সরকারী দল যাতে ভোট কারচুপি করতে না পারে সে জন্য নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর আমাদের নেতাকর্মীরাও এবার সতর্ক রয়েছে। ভোট কারচুপি করে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হবে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ভোট কারচুপি করা হলে রাজপথে আন্দোলন করে এর জবাব দেয়া হবে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ইস্যু হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করতে চায় তারা। এ কারণেই এ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে নেতিবাচক মন্তব্য করে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে বহু চেষ্টা করেও রাজপথের আন্দোলন শুরু করতে পারছে না বিএনপি। তাই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা আন্দোলনকে টার্গেট করে এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এ কারণেই বিএনপি মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতারা কথায় কথায় বলছে তাদের দল আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তারা যে এ নির্বাচনকে ইস্যু করে আন্দোলন চাঙ্গা করতে চায় তা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদেরও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আন্দোলনের টার্গেট নিয়ে আগেই সুষ্ঠু ভোট হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে বিএনপি। এ ছাড়া দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে কোন এলাকায় কি কি অনিয়ম হচ্ছে তা জানার জন্য ঢাকা মহানগরের প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের সবকিছু নোট রেখে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিখিত রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে। আবার কেন্দ্র থেকেও দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি টিম সবকিছু মনিটর করছে। লন্ডন থেকে তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে এ নির্বাচন সম্পর্কে ব্যাপক খোঁজখবর রাখছেন বলে জানা গেছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করে তাদেরও নির্বাচনী প্রচারে নামাতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। নির্বাচনী প্রচার এক সঙ্গে করার পাশাপাশি ভোট কারচুপি হলে যেন দ্রুত একসঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচী পালন করা যায় সে প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছে তারা। তবে প্রকাশ্যে বেশি হাঁকডাক না করে সব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে গোপনে। এতে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদেরও কাজে লাগানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই বিএনপিপন্থী পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যাতে বিজয়ী হওয়া যায় সে জন্য নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখার পাশাপাশি নির্বাচনে হেরে গেলে যাতে রাজধানীসহ সারাদেশে রাজপথের আন্দোলন জোরদার করা যায় সে জন্য তারেক রহমান লন্ডন থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে দলের সর্বস্তরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। বিশেষ করে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে তারেক রহমান নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটের নেতাদের সঙ্গেও তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে কোন মূল্যে রাজপথে আন্দোলন চাঙ্গা করে বিএনপিকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করতে চায় দলের হাইকমান্ড। আর আগেভাগে শুরু করতে না পারলে শেষ দিকে গিয়ে আর সুবিধা করা যাবে না সেটা ভেবেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর থেকেই আন্দোলন শুরু করতে চায় তারা। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি সমন্বয় করার জন্য আটটি কেন্দ্রীয় কমিটি করেছে বিএনপি। এসব কমিটির নেতারা যার যার অবস্থান থেকে এখন নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এসব কমিটিতে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এমাজউদ্দিন আহমেদ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বরকতউল্লাহ বুলু বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আবুল খায়ের ভুইয়া, আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন নবী খান সোহেল, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, চিত্রনায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জল প্রমুখ। তাদের সার্বিক কর্মকা- সমন্বয় করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
×