ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাহবুব হাসান

ইরানের আধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক সক্ষমতা

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

 ইরানের আধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক সক্ষমতা

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। ইরান ও আমেরিকার ক্রমাগত উস্কানিমূলক ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে অচিরেই বুঝি বেজে উঠবে যুদ্ধের দামামা! এ যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই আভাস কিংবা দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের বহির্প্রকাশ। কিন্তু পরাশক্তির সঙ্গে যুদ্ধ মোকাবেলায় মধ্যপ্রাচ্যের সিংহ ইরান কতটা শক্তিশালী? ইরানের প্রযুক্তি আসলেই কতটা আধুনিক কিংবা তার সামরিক সক্ষমতাই বা কেমন? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চলছে এসব প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্সের ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক অস্ত্রের সক্ষমতার দিক থেকে ইরান আছে ১৪ নম্বরে। দেশটির পেছনে আছে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাইল (১৮) ও সৌদি আরব (২৫)। সূচকের শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে রাশিয়া ও চীন। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, ড্রোন তৈরি ও পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে বেশ এগিয়ে গেছে ইরান। ইরানী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হরমুজ প্রণালীতে মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন বিধ্বস্ত হলে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। কুদ্স বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাশেম সুলাইমানিকে আমেরিকার ড্রোন দ্বারা হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকে মার্কিন স্থাপনায় ইরানের হামলা যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রঙ্গ মঞ্চ প্রস্তুত করছে। ইরানের দুটি সামরিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে আর্টেশ বা নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী, যাতে রয়েছে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী এবং বিপ্লবী গার্ড বা আইআরজিসি। মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর ক্রিয়াকলাপের জন্য ইরানের এই বিপ্লবী গার্ডকেই বিবেচনা করা হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ইরানের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সামরিক শিল্প খাতটি চারটি বিশেষ অঞ্চলে ক্রমাগত অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং বর্তমানে দেশটি ছোট ও হাল্কা অস্ত্র, আর্টিলারি এবং মনুষ্যহীন অস্ত্র সিস্টেমের ক্ষমতা অর্জন করে ইসরাইল ও তুরস্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক নেতা হিসেবে পরিচিত করেছে নিজেদের। ইরানই মুসলিম বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাতে সক্ষম। এই ধরনের প্রযুক্তি পৃথিবীর হাতেগোনা ১০-১২টি দেশের আছে তার মধ্যে ইরান একটি। এখনও ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র নেই। ইসরাইলের গোয়েন্দারা বলছে, বর্তমানে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের হার ৪ শতাংশ। তবে আগামী ৬ মাসে এই হার বাড়িয়ে ২০ শতাংশে নিয়ে যাবে তারা। এতে চলতি বছরের মধ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরির সব সক্ষমতা অর্জন করবে দেশটি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার এর মতে, সামরিক শক্তিতে ইরান মুসলিম বিশ্বে তৃতীয়। রয়টার্সের মতে, ইরানের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ২৩ হাজার। এর মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য আছে ৩ লাখ ৫০ হাজার। ইসলামিক রেভ্যুলিউশনারি গার্ডস কোরের সদস্য আছে ১ লাখ ৫ হাজার। এ ছাড়া রিজার্ভে রয়েছে ৪ লাখ, যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ সেনাবাহিনী। দেশটির সেনাবাহিনীতে ট্যাঙ্ক সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৪। সাঁজোয়া যানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৪৫। সেনা সদস্যের ব্যবহারের জন্য কামান রয়েছে ২ হাজার ১২৮টি। পাশাপাশি ৫৭০টি সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি (সংক্রিয়কামান) এবং ১ হাজার ৯০০টি রকেট চালিত কামান রয়েছে। এ ছাড়া দেশটির সামরিক প্রশিক্ষিত জনসংখ্যা ২ কোটি ৩৬ লাখ ১৯ হাজার ২১৫ জন। ইরানের হাতে আরও আছে কুদস ফোর্স। অপ্রচলিত যুদ্ধ, ছায়া যুদ্ধ ও বিদেশের মাটিতে গোপন অভিযান চালানোর জন্য এই বাহিনী বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। আনুমানিক হিসেবে এই বাহিনীর সদস্য ৫ হাজার । ধারণা করা হয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ছড়িয়ে আছে কুদস ফোর্সের সদস্যরা। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের সামরিক ব্যয় ২০১৯ সালে সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার। ইরানের নৌবাহিনীর সদস্য ২০ হাজার। আইআইএসএসের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, ইরানের কাছে ছোট ছোট নৌযান আছে প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার। এসব নৌযান থেকে ছোট ছোট ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া যায়। ২০১৫ সালে এক সামরিক মহড়ায় দেখা যায়, এসব ছোট নৌযান দিয়েও অত্যন্ত কার্যকর উপায়ে বড় আকারের যুদ্ধজাহাজকে পরাস্ত করতে পারে ইরান। তবে নিউজ উইক বলছে, ইরানের নৌবাহিনীতে কোন এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার নেই। কোন ডেস্ট্রয়ারও নেই। তাদের ফ্রিগেট রয়েছে ৬টি, করভেট রয়েছে তিনটি এবং ৩৪টির মতো সাবমেরিন রয়েছে। ইরানের ৮৮টি প্যাট্রল বোট ও ৩টি মাইন ওয়্যারফেয়ার রয়েছে। এরা হরমুজ প্রণালীতে আর্মড প্যাট্রল বোট পরিচালনা করে। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক সামুদ্রিক মাইন আছে ইরানের। মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরানের কাছে প্রায় ৫ হাজার মাইন রয়েছে। আল আরাবিয়্যাহর দেয়া তথ্য মতে, ইরানের বিমান বাহিনীর মোট আকাশ যানের সংখ্যা ৫০৯টি। এর মধ্যে রয়েছে- ফাইটার বিমান ১৪২টি, এ্যাটাক বিমান ১৬৫টি, হেলিকপ্টার ১২৬টি ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার ১২টি। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য ১০৪টি ও পরিবহনের জন্য ৯৮টি উড়োজাহাজ রয়েছে বাহিনীটির। পুরনো সিএইচ-৪৭ চিনুক হেলিকপ্টার এবং এম৬০ প্যাটন ট্যাঙ্ক। ইরানের হাতে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত কোন স্টেলথ ফাইটার বিমান নেই। খামেনি স্পেস সেন্টার থেকে রকেট পরীক্ষা চালায় ইরান। সিআইএ বলছে, ইরানের অস্ত্র ভান্ডারে মূলত স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। ইরানের শক্তির মূল স্তম্ভ হলো এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র– ভান্ডার আছে ইরানের। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) বলছে, ইরানের ৫০টির বেশি মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার ও ১০০টির বেশি স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার রয়েছে। সম্প্রতি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে ইরান। এর মধ্যে কিয়াম-১, শাহাব-৩, শাহাব-৪ মিসাইল উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সৌদি আরবসহ পারস্য অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় আছে। এই তালিকায় আছে ইসরাইলও। মূলত বিমান হামলা চালানোর সক্ষমতা ইরানের তুলনামূলক কম। তাই পরিকল্পিতভাবেই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা শক্তিশালী করায় মনোযোগ দিয়েছে ইরান। বেশ কয়েক বছর ধরেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার করছে ইরান। মনুষ্যবিহীন ড্রোন প্রযুক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে ইরান। গত জুনে ইরান মার্কিন গুপ্তচর ড্রোন ভূপাতিত করার পর থেকে এটি স্পষ্ট যে ড্রোন প্রযুক্তি বেশ ভালভাবেই করায়ত্ত করেছে কাশেম সোলাইমানির দেশ। সুইসাইড ড্রোন তৈরি করছে ইরান। এসব ড্রোনের নাম রাদ ৮৫। এমন ড্রোনের পাখায় গোপনে বোমা বহন করাও জেটসমৃদ্ধ ইউএভি শক্তির মাধ্যমে সেই বোমা নিক্ষেপ করাও সম্ভব। ইরান নিয়মিতভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন নিয়ে পরীক্ষা চালাতেও তার পাল্টা প্রকৌশলী জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বেশ কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ইরান। দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, দেশটির এই নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাশিয়ার এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষ ব্যবস্থার সমকক্ষ। ইরানের তৈরি এমনই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নাম ‘সেভম-ই-খোরদাদ’। Email:[email protected]
×