ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পিকনিক এখন তো বাঙালীর প্রীতিপদ উৎসব

একদিন দলবেঁধে কজনে মিলে যাই ছুটে খুশিতে হারিয়ে ॥ চড়ুইভাতি থেকে বনভোজন

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২০ জানুয়ারি ২০২০

 একদিন দলবেঁধে কজনে মিলে যাই ছুটে  খুশিতে হারিয়ে ॥ চড়ুইভাতি থেকে বনভোজন

সমুদ্র হক ॥ রোমান্টিসিজমের আইডিয়া থেকে এসেছে ‘ভুলকাভাত’। নামটি শুনে অনেকে আঁতকে উঠতে পারেন। কিন্তু যারা প্রবীণ ও গ্রামীণ জীবন সঙ্গী করে নগর জীবনে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছেন তারা প্রাণের হাসি দিয়ে আনন্দই পাবেন। কেউ হয়তো বলবেন কত দিন পর...। বনেবাদাড়ে চড়ুই পাখিদের কিচিরমিচির ডাকের ছন্দে সংগৃহীত খাবার একসঙ্গে খাওয়া থেকে হয়তো উৎপত্তি চড়ুইভাতি। শিশুদের সংগ্রহ করা চালডালে রাঁধাবাড়া করে খাওয়াই চড়ুইভাতি, এ থেকেই ছোট্টবেলার ভুলকাভাত। ভোঁ-দৌড় দিয়ে মায়ের কাছে ‘পুষ্ণার’ বায়না। পুষ্ণা শব্দটিও নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা। দেশের কয়েকটি অঞ্চলে, এলাকাভেদে নাম পুষ্ণা, পুষলা, পুষলি, পুষালি বা পুষরা। অর্থ পৌষ মাসে একদল কিশোর তরুণ বাড়ি থেকে চাল-ডাল ডিম হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে কোন খোলা জায়গায় অথবা গাছের নিচে বসে রান্না করে খাওয়া। কালেকালে বনভূমিতে গিয়ে প্রীতি সম্মিলনে প্রীতি উৎসবের সঙ্গে চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে প্রীতিভোজন। ভোজনের পর বিচিত্রানুষ্ঠান। প্রীতিপ্রদ উৎসবের নাম এভাবেই হয়ে যায় বনভোজন। ইংরেজী পিকনিক। বনভোজন নিয়ে কথার শেষ নেই। অনেকের মতে ‘বনভোজনে’র সঙ্গে বাঙালীকে প্রথম পরিচিতি ঘটিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘অচলায়তন’ নাটকে কবিগুরু নতুন শব্দ তুলে ধরলেন- বনভোজন। চোখের বালি উপন্যাসে আশালতা আর বিনোদিনীর সেই শান্ত সুন্দর পিকনিকের বেলা হৃদয়ে গেঁথে যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র একটি দৃশ্যে পিকনিকে খেলতে বসে মেমোরি গেম দৃষ্টিনন্দন হয়ে আছে। মার্গারেট মিসেলের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ নির্মিত হয়েছে একদল নগরবাসীর বনে গিয়ে পিকনিকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। বাঙালীর জীবনে বনভোজন এখন তো শীত মৌসুমের প্রীতি উৎসবে পরিণত হয়ে গেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচিত্র অনুষঙ্গ। দর্শনীয় স্থান পর্যটন এলাকা, কিংবা নিসর্গের কোন স্থানে দলবল নিয়ে ভ্রমণে গিয়ে একদিন বা কয়েক দিন অবস্থান পিকনিকে প্রতিপদ আমেজ পেয়েছে। কখনও সবাই মিলে পিকনিকের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এমন প্রীতির সম্মিলনে অনেকের ডেটিং পর্ব, প্রণয় পর্ব চলে। বিবাহিতরা ফিরে পায় তারুণ্যের রোমান্টিসিজমের দিন। বনভোজনের অর্থ বঙ্গীয় শব্দকোষে এসেছে রন্ধন পূর্বক ভোজন। পরে অভিধানে বিস্তৃত বর্ণনায় বলা হয়েছে বন বা রম্য স্থানে গিয়ে সংঘবদ্ধ রন্ধন, প্রীতিভোজন। ছেলেবেলার প্রীতিভোজন সম্পর্কে প্রবীণ আশরাফুজ্জামান বললেন, শীতে পাড়ার মানুষ একদিন তরিতরকারি চাল-ডাল নিয়ে কোথাও গিয়ে রান্না করে খাওয়ার আয়োজন করত। দল ছোট হলে জোগাড় করা হতো ডিম, মুরগি। আর বড় হলে হাঁড়িকুড়ি, চাল-ডাল সবজি ছোট খাসির গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো গায়ের বাইরে। বড় কোন গাছ তলায়। চুলা খুঁড়ে খড়ি জ্বালিয়ে শুরু হতো প্রাক রন্ধন পর্ব। একদল রাঁধত, অন্য দল হৈ হুল্লোড় রং তামাশায় মেতে উঠত। কাছে নদী বা জলাশয় থাকলে ডুব সাঁতারও চলত। কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে অংশ নিত নারী-পুরুষ সবাই। উচ্ছ্বাস-আনন্দের পালায় একত্রে বসে প্রীতিভোজন ছিল মহা-আনন্দের। খাওয়া দাওয়া হতো কলাপাতায়। বনভোজন কি ইংরেজ অনুকরণ? পিকনিক অর্থ ইংরেজদের কাছে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে পার্টিতে একত্রে ভোজন ‘পিক এ্যাট ইউর ফুড’। ইংরেজরা এখনও এই কাজটি করে। ষাটের দশকে দেশের চলচ্চিত্র রহমান শবনম অভিনীত ‘তালাশে’র গল্পটাই ছিল এমন: ঢাকা বিশ^দ্যিালয়ের একদল শিক্ষার্থী দূরে কোন এক বনে বনভোজনে যায়। সঙ্গে বাস্কেটে থাকে তৈরি খাবার। এগুলো রেখে দিনভর হৈ হুল্লোড় করে খেতে এসে আরেক কা-, ছেলেরা খাবার সাবাড় করে দিয়েছে। দৃশ্যটি ছিল মজার। পিকনিক প্রথার শুরু ১৬৯২ সালের দিকে। সেকালে কয়েকজন মিলে শীতকালে কোন সরাইখানায় গিয়ে খানাপিনা, পরে যুক্ত হলো আড্ডা। এই পিকনিক ছিল শুধু রাজকীয় আয়োজনে। পরে সাধারণ মানুষ বিকল্প আয়োজন শুরু করল। তারা সূর্যকে সঙ্গী করে ফসল তোলার সময় জমিতে বসে খাবার খেত। এক পর্যায়ে শীতের দিনে জমিতে গিয়ে রান্না করে খাওয়ার পালা শুরু। সেদিনের এমন ছবি এঁকেছেন অনেক চিত্রশিল্পী। ফরাসী বিপ্লবের পর রাজকীয় উদ্যানগুলো প্রথমবারের মতো সাধারণের গন্তব্যস্থানের স্বীকৃতি পায়। খুলে যায় বনভোজনের অবাধ দুয়ার। পিকনিকের আঁতুড় ঘরের ফরাসী বিপ্লবের রাজপুরুষরা ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে অস্ট্রিয়া প্রুশিয়া আমেরিকায় জড়ো হয়। বেশিরভাগ পাড়ি দেয় ইংল্যান্ড। ফ্রান্স জার্মানী সুইডেন ঘুরে পিকনিক চলে আসে ইংল্যান্ডে। ১৭৬৩ সালে লেডি মেরি কোক বোনকে লেখা চিঠিতে পিকনিক পার্টির কথা উল্লেখ করেছেন। উনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে একত্রে বসে খাওয়ার ‘পিকনিক সোসাইটি’র উদ্ভব ঘটে। ভিক্টরিয়ান ব্রিটেনে পিকনিক ছিল সামন্ত প্রভুদের এস্টেটের আউটডোরে খাওয়া দাওয়ার অলস অবসর। পরে মধ্যবিত্তের জীবনে আসে পিকনিক অবকাশ। ইনডোরের বদলে আউটডোরে পিকনিক হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। সেদিনের পিকনিকের কিছু স্পট খ্যাতির তালিকায় এখন জ্বলজ্বলে। ব্রডসওয়ার্থ হল, প্লেজার গার্ডেন, ইংলিশ হেরিটেজ ট্রাস্ট, উইটলি কোর্ট গার্ডেন, জ্যাকরিয়ান ম্যানশন হাউস, বেলসি হল ছিল আকর্ষণের অন্যতম স্থান। মহারানী ভিক্টরিয়ার প্রিয় ছিল অসবোর্ন হাউস অবকাশ কেন্দ্র। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অবকাশ যাপন এক ধরনের পিকনিক, যা আজও আছে। ব্রিটিশ রাজ্যে পিকনিকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিকারের ইতিহাস। ইংরেজরা ভারতবর্ষে আসার আগে হোমবার্ডরা জলাভূমি ও বনাঞ্চলে নিরুপদ্রবেই থাকত। ব্রিটিশরা পিকনিকের সঙ্গে পশুপাখি বধ শুরু করে। পিকনিকের সেদিনের খাবারে ছিল স্কচ এগ, মাংসের পাই ডান্ডি, ভাপা পুডিং, কেক, জ্যাম, পাফ পটেড মিট, মাখনমাখা টোস্ট রোস্টেড চিকেন, চিজ কেক পুডিং স্যান্ডউইচ ইত্যাদি। বাঙালীর বনভোজনে ডাল-ভাতের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীতে শুরু হয় বাঙালীর পোলাও-কোরমা, কালিয়া-কোপ্তা, মাছ-মাংসসহ বহুমুখী খাবার দাবার। এভাবে শুরু হয় বাঙালীর বিদেশী খাবার প্রীতি। ‘একদিন দল বেঁধে ক’জনে মিলে যাই ছুটে খুশিতে হারিয়ে’... মান্না দের কণ্ঠের জাদুকরী গান মনে করিয়ে দেয়। ছেলেবেলার রাঁধাবাড়া খেলা কলেজ ভার্সিটির জীবনে বাসে ‘বনভোজন’ ব্যানার টাঙ্গিয়ে দূরে কোথাও যাওয়া, বিচিত্রানুষ্ঠান, কতই না মধুর। সুন্দর কণ্ঠের সঙ্গে হেড়ে গলার গানও ভাল লাগত। চড়ুইভাতি, ভুলকাভাত, পুষ্ণা, বনেজঙ্গলের প্রীতি সম্মিলনে প্রীতিভোজ কিংবা পিকনিক। দেশে দেশে পিকনিক প্রীতিপ্রদ চিরন্তন উৎসব হয়ে গেছে। বাঙালীর বনভোজন কাল পৌষে যাত্রা করে বসন্তের অনেকটা সময় ধরে চলে, রূপ নিয়েছে শীতবসন্তের প্রীতি উৎসবে। বিদেশে চেরি ফুলের আনন্দের সঙ্গী হয়েছে পিকনিক। প্রীতিপ্রদ উৎসব বলে কথা, একদম তর সয় না। শীতবসন্ত বাঙালীকে বনভোজনের ভুবনে স্বাগত জানায়।
×