ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

বঙ্গবন্ধুর উত্থান পর্ব

প্রকাশিত: ০৯:১০, ১৪ জানুয়ারি ২০২০

বঙ্গবন্ধুর উত্থান পর্ব

২০২০ সালের সূচনাকাল থেকে শুরু হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষের উৎসব আর আয়োজন। আড়ম্বরে জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসকে ঘিরে ১০ জানুয়ারি থেকে আরম্ভ হয় ক্ষণগণনার শুভ মুহূর্ত। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চে জন্ম নেয়া এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ টুঙ্গিপাড়ার এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন। বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠার সামাজিক ও পারিবারিক বলয়ের সঙ্গে যিনি সার্বক্ষণিক সাহচর্য দিয়ে যান তিনি আর কেউ নন- পিতা শেখ লুৎফর রহমান। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বার বার স্মরণ করেন নিবেদিতপ্রাণ জন্মদাতার কথা। পুরো বইটি পড়ার পর বাবা জীবনভর কিভাবে তাঁকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছেন তেমন মুগ্ধতার বিস্ময়ও পাঠককে আপ্লুত করে। এমন পিতৃভক্তের নজির আমরা পাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনব্যাপী সৃজন-সাধনায়। পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথের সার্বিক মনন, আদর্শ আর ব্যক্তিত্বে পর্বত সমান অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করতেন। রবীন্দ্র ভক্ত আর অনুরাগী বঙ্গবন্ধুকেও আমরা প্রত্যক্ষ করি তেমন সম্মানিত আসনে। যেখানে শেখ লুৎফর রহমান তাঁর সামগ্রিক অবয়ব নিয়ে সন্তানকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত এবং চেতনায় সমৃদ্ধ করেছেন। শুধু পারিবারিক আবহেই নয়, বৃহত্তর সামাজিক আঙ্গিনা এবং অতি প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক আদর্শে ও সার্বক্ষণিক উদ্দীপকের ভূমিকায়ও পাশে থেকেছেন। সময়টা ছিল বিংশ শতাব্দীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিভাজনের এক উন্মত্ত পর্ব। ১৯০৫ সালে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ, ১৯০৬ সালে সর্ব ভারতীয় মুসলিম প্রতিষ্ঠা। এসবের সাংঘর্ষিক প্রতিক্রিয়ায় স্বদেশী আন্দোলনের অনিবার্য ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে অবিভক্ত ভারতকে ক্রান্তিকালের দুঃসময় অতিক্রম করিয়ে আরও ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তারই বিক্ষুব্ধ চিত্র বঙ্গবন্ধুর আত্মকথনে অত্যন্ত সাবলীলভাবে বর্ণিত হয়েছে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯১৪ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুুদ্ধের দামামা বেজে ওঠা, পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সব মিলিয়ে যে উত্তেজক পরিবেশ পরাধীন ভারতকে অস্থিতিশীল পর্যায়ে দাঁড় করায় তেমন সঙ্কটকালে জাতির পিতার জন্ম সেও যেন এক ঐতিহাসিক পরম্পরা। তাই আত্মজীবনীর ধারা বর্ণনায় রাজনৈতিক উন্মত্ততা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন, ঔপনিবেশিক শাসকচক্রের অন্যায়, অবিচার জবরদখলী মনোভাব সামাজিক আঙ্গিনায় যে বিষবাষ্প তৈরি করে, সেই দুঃসহ পরিবেশে এক উদীয়মান কিশোরের জীবনতরী বয়ে চলা শুধু ইতিহাস নয়, এক জীবন্ত কর্মবীরের শৌর্য-বীর্যের অভাবনীয় কাহিনী সম্ভার। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন অতি সাধারণ এবং সাবলীল ভাষায়। কিন্তু জীবন চলার অবধারিত গতি তো কোনভাবেই স্বাভাবিক আর নির্বিঘœ ছিল না। পরাধীন দেশে স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি নিয়ে বেড়ে ওঠা, সেও যেন এক অসম সাহসী কিশোরের দেশপ্রেমের অবারিত কর্মোদ্দীপনা। ভেতরের দেশপ্রেমের চেতনাকে লালন করার পর থেকেই অনুভব করলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ কিভাবে দুই সম্প্রদায়কে এক বিভাজিত দ্বন্দ্ব আর সংঘর্ষের দিকে ক্রমান্বয়ে ঠেলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে সারা বাংলায় দানা বাঁধতে থাকে স্বদেশীয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী তৎপরতা। বঙ্গবন্ধুর লেখনীতে আছে কিভাবে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেরণায় নিজেকে সমর্পণ করার সঙ্গে সুভাষ চন্দ্র বসুর ভক্ত বনে যাওয়া। ভাবতে অবাক লাগে তিল তিল করে সামাজিক আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্যে বেড়ে ওঠা এক বিস্ময়কর কিশোর ঘটনার প্রাসঙ্গিকতায় তার যৌবনের স্বর্ণদ্বারে এসে দাঁড়ান। সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার পালাক্রমে যখন তিনি উদ্দীপ্ত, সে সময় ঘটে যায় জীবনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। স্ত্রী রেণুর সঙ্গে শুভ বিবাহের মাহেন্দ্রক্ষণ। ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে ৩ বছরের শিশু রেণুর সঙ্গে ১৩ বছরের বালকের সারা জীবনের গ্রন্থি বেঁধে যাওয়া সত্যিই এক স্মরণীয় ব্যাপার। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকেই উল্লেখ করছি, ‘আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না।’ ১৯৩৮ সালের ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে জীবনভর নানামাত্রিকে আন্দোলিত করেছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক ও আদর্শিক চেতনাকে পরিপুষ্ট করার ক্ষেত্রে বাঙালীর দুই মহান নেতার অবদান বঙ্গবন্ধুকে উদ্দীপ্ত মনোবলে শাণিত করার ঘটনাও বিধৃত হয়েছে এই মূল্যবান গ্রন্থটিতে। এই দুই নেতার গোপালগঞ্জে আসার ঘটনাকে নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক তোলপাড় যা মূলত কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের আদর্শিক দ্বন্দ্ব, তেমন স্মৃতিও সব সময় তাড়িত করেছে। তবে বঙ্গবন্ধুর লেখায় স্পষ্ট হয় খ্যাতিমান নেতৃত্বের মধ্যে যে বিবাদ, বিভাজন সেখানে অতি সাধারণ মানুষের ঐক্য আর সংহতি ছিল নজরকাড়া। ফলে নিরাপদ আর নির্বিঘ্নে শেরে বাংলা এবং সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব আসতে পারলেন। যথারীতি সমস্ত কর্মসূচীও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন ১৮ বছর। নজরে পড়েন নেতৃদ্বয়ের। বিশেষ করে হোসেন সোহ্রাওয়ার্দীর। তার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ অনিবার্য পরিণতি লাভ করে। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুও মুসলিম লীগের হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়েও পড়েন। অন্য অনেকের মতো তাঁরও মনে হয়েছিল মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাস ভূমি আবশ্যক। ততদিনে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং বক্তা হিসেবে তার সফল অভিগমন সবাইকে চমৎকৃত ও বিস্মিত করে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় ১৯৪৩ সালের সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ-মহামন্বন্তর। দুঃসহ স্মৃতিও বঙ্গবন্ধুকে জীবনব্যাপী তাড়িত করে। অসংখ্য লোকক্ষয়ের কথা আত্মকথনে উল্লেখ করতে বিস্মৃত হননি। এমন সাড়া জাগানো দুর্ভিক্ষকে আলোকপাত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ব্যবসায়ীদের কূট-কৌশলের কথাও নির্দ্বিধায়-নির্বিঘেœ প্রকাশ করেছেন। সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করছিÑ ‘যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকার মণের চাল চল্লিশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নেই রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না।’ সেদিন কিভাবে লেখাপাড়া বাদ দিয়ে ক্ষুধার্ত-পীড়িত অসহায় মানুষের পাশে খাবার নিয়ে, তাদের অন্নজল দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তাও তার লেখাতে উল্লেখ আছে। কিশোর বয়স থেকে দেশ ও মানুষকে নিয়ে ভেবেছেন। দেশনায়ক হওয়ার চিন্তাও যখন মাথায় ছিল না, সে সময় থেকে মানুষের প্রতি যে অকৃত্রিম দরদ আর ভালবাসা সেটা থেকে জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত সরে দাঁড়াননি। শ্যামল বাংলার মাটি ভেদ করে যে নেতার অভ্যুত্থান, তাকে কেউ কখনও দমিয়ে রাখতে সাহস পর্যন্ত পেত না। কিন্তু ভর্ৎসনা করতে মানুষ পিছপা হয়নি। এখানেও ঢাল হয়ে সুরক্ষা দিতেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান। তিনি বলতেনÑ ‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না, যদি জেল খাটতে হয় খাটবে তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও হতে পারে। তাই আমি ওর কাজে বাধা দিই না।’ প্রতিদিনের লড়াই, সংগ্রাম, দেশ বিভাগের উন্মাদনা সব মিলিয়ে জীবনটা এগিয়ে যাচ্ছে এক স্বাধীন, সার্বভৌম মাতৃভূমির আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। কোন অবস্থাতেই নষ্ট রাজনীতির কাছে মাথা নত করেননি। দূষিত রাজনীতিকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করা বঙ্গবন্ধু সব সময় সতর্ক এবং সাবধান থাকতেন, যাতে অপরাজনীতি দেশ ও মানুষকে কোনভাবে সঙ্কটাপন্ন করতে না পারে। আত্মজীবনীতেও এ সম্পর্কে নিজের দুঃসহ অভিজ্ঞতা বর্ণিত আছে। ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলা ও বাঙালীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর অস্তিত্ব সঙ্কটকে মোকাবেলা করতে গিয়ে যে কালজয়ী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর মর্যাদায় তার আসনটি পেতে কত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বৈতরণী পার হতে হয় তাও দেশীয় ঐতিহ্যের গৌরবময় অধ্যায়। দুঃসাহসিক আর অনমনীয় দৃঢ় প্রত্যয়কে ধারণ করে দেশ ও সাধারণ মানুষকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখ- দিতে যা যা করতে হয়েছিল সবটাই সম্ভব করেছিলেন এই অকুতোভয়, নির্ভীক মানুষটি। শাসক শ্রেণীর রক্তচক্ষুকেও তোয়াক্কা করতে দেখেনি কেউ। আর সেই বোধ তো তৈরি হয়েছে একেবারে কিশোর বয়স থেকে। এই মহানায়কের সংগ্রামী জীবনে ইতিহাস থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কিভাবে শ্বাপদ শঙ্কুল অভয়ারণ্যকে পদদলিত করে বীরদর্পে সমস্ত অভিশাপ আর সামাজিক আবর্জনাকে নির্মূল করার কা-ারি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। সেই ঐতিহ্যিক গৌরব আর সংগ্রামী নেতৃত্বে এক সময় দেশের সীমানাকে দৃপ্তভাবে অতিক্রম করে বিশ্ব দরবারেও তার আসনটি পাকা-পোক্ত করে নিলেন। সারা বিশ্ব মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে প্রত্যক্ষ করে, সমৃদ্ধ বাংলা তার ঐতিহাসিক পথপরিক্রমায় এক বীরশ্রেষ্ঠ বাঙালীর অবিস্মরণীয় উত্থান আর ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলা। লেখক : সাংবাদিক
×