ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবেদনকারীর সম্মতিতে উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ

খালেদার জামিন আবেদন খারিজ

প্রকাশিত: ১১:০১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

খালেদার জামিন আবেদন খারিজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জিয়া চ্যারিটেবল (দাতব্য) ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দ-িত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। আদেশ দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে জামিন আবেদন খারিজ (ডিসমিসড) করা হলো। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যদি আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) প্রয়োজনীয় সম্মতি দেন, তাহলে মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তার এ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের (বায়োলজিক এজেন্ট) জন্য পদক্ষেপ নেবে, যা বোর্ড সুপারিশ করেছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ এ বৃহস্পতিবার পিনপতন নীরবতার মধ্যে এই আদেশ দেয়। বেঞ্চে অপর পাঁচ সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি আবু বরক সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, দুদকের পক্ষে খুরশীদ আলম খান। আর খালেদা জিয়ার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও জয়নুল আবেদীন। উচ্চাদালতে আদেশের ফলে খালেদা জিয়াকে এখন কারাগারেই থাকতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত দুটি মামলায় ১০ ও ৭ বছরের কারাদ-ে দ-িত হয়েছেন। আপীলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের কারাদ- বেড়ে ১০ বছর এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিশেষ আদালতে ৭ বছরের কারাদ-ে দ-িত হন তিনি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার পর থেকে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে অবস্থিত ঢাকা সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিনের আপীল আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে। শুনানিকে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্টের প্রতিটি প্রবেশপথ, আশপাশ ও আদালত চত্বরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশির পর আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের আদালত চত্বরে প্রবেশ করানো হয়। প্রধান বিচারপতি এজলাসে ৮টি সিসি ক্যামেরা পাঠানো হয়েছে। আদালতে প্রবেশের মুখে প্রথম তল্লাশির পর প্রধান বিচারপতির এজলাসে যেতে আরও তিন দফা তল্লাশি চালানো হয়েছে। তল্লাশির সময় সুপ্রীমকোর্টের গেট থেকে ফাইজুল্লাহ নামে এক আইনজীবীকে আটক করা হয়। বিকেলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রধান বিচারপতির এজলাসে প্রবেশ করার সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের তর্ক-বিতর্ক চলে। যাদের আপীল বিভাগের এনরোলমেন্ট নাই তাদের ঢুকতে দেয়নি। এ নিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীগণ এজলাস কক্ষের সামনে হট্টগোল শুরু করে। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি উভয় পক্ষের ৩০ জন করে মোট ৬০ আইনজীবীকে এজলাস কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেন। কিন্তু এক আইনজীবী, সাংবাদিক, বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আদালত কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। শুনানি চলাকালে আওয়ামীপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীগণ পৃথক পৃথকভাবে আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল বের করেন। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস ও আথ্রাইটিসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল বলে মত দিয়েছে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড। একইসঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড মনে করছে, খালেদা জিয়া রাজি না হওয়ার কারণেই তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়া যায়নি। আপীল বিভাগে দাখিল করা খালেদা জিয়ার সর্বশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদনে এসব বলা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখে আপীল বিভাগে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন খারিজ করে দেয়। এদিকে সুপ্রীমকোর্টের আদেশের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আপীল ভিাগের ছয় বিচারপতি নিশ্চয়ই যথেষ্ট বিবেচনা করেই খালেদা জিয়ার জামিন না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আমরা যেহেতু আইনের শাসনে বিশ^াস করি, তাই আমাদের আদালতের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আপীল বিভাগ। জামিনের বিরোধিতা করে আমরা বলেছি, তিনি পৃথক মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। কারা হেফাজতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার খালেদা জিয়ার সর্বাত্মক চিকিৎসা দিচ্ছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা আগে থেকেই ছিল। তার হাঁটুতে পূর্বেই অপারেশন হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন তাতে দেখা যায় খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়নি। তিনি আগে যেমন ছিলেন এখনও তেমনই আছেন। অন্যদিকে এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, জামিন চেয়ে আমরা আইনী লড়াই চালিয়েছি। সাত বছরের সাজায় জামিন না দেয়া নজিরবিহীন। এটি সুপ্রীমকোর্টের জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা হয়ে থাকবে। বৃহস্পতিবার আদালতে মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদনের ওপর এবং তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্টার জেনারেল আলী আকবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বোর্ডের পাঠানো প্রতিবেদন আদালতের কাছে পেশ করেন। শুনানির শুরুতে আপীল বিভাগের তালিকাভুক্ত না হলে আইনজীবীদের আদালত কক্ষে ঢুকতে বাধা দেয়ায় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সবাই ভেতরে ঢুকতে পারলেও বিএনপিপন্থীদের তালিকাভুক্তি আছে কি না তা দেখা হচ্ছে। এমনকি তার জুনিয়রকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের মতামতের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি দুই পক্ষের ৩০ জন করে আইনজীবী থাকার অনুমতি দেন। ঠিক হয়, খালেদা জিয়ার মামলার শুনানি শুরুর আগে ৫ মিনিট সময় দেয়া হবে। তখন সবাই বেরিয়ে গিয়ে আবার ঢুকবে। উভয় পক্ষের ৩০ জন করে আদালতকক্ষে থাকতে পারবে। কিন্তু সকাল ১০টার কিছু সময় পর আপীল বিভাগে খালেদার মামলার শুনানি শুরু হলে দেখা যায় কোন পক্ষই বেঁধে দেয়া সংখ্যা মানেনি। এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। এরপর রেজিস্টার জেনারেল আগের ও বর্তমান দুটি মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। আদালতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সেই প্রতিবেদনের সারমর্ম উপস্থাপন করেন। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সর্বশেষ মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করে শুনানিতে বলেন, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসকরা তার যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারছেন না। আমরা তার জামিন আবেদন নাকচ করার আর্জি জানাচ্ছি। বেলা ১টায় শুনানি শেষে মিনিট দশেক বিরতি দিয়ে সিদ্ধান্ত জানায় আপীল বিভাগ। হাইকোর্টের জামিন খারিজের আদেশই তাতে বহাল থাকে। আদালতে পাল্টাপাল্টি মিছিল জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত ছিল আদালত চত্বর। পাল্টাপাল্টি মিছিল ও স্লোগান দেয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। আদালতে বিশৃঙ্খলা চলবে না, বহিরাগতদের আদালতে ঢুকতে দেয়া হবে না বলে আওয়ামী আইনজীবীরা স্লোগান দিচ্ছেন। এর আগে সাবেক সংসদ সদস্য ও আইনজীবী নীলুফা ইয়াসমিন মনিরের নেতৃত্বে মিছিল বের করে বিএনপি আইনজীবীরা। তারা স্লোগান দিচ্ছেন- বিচারের নামে টালবাহানা চলবে না, খালেদা জিয়ার মুক্তি দিতে হবে। প্রবেশে কড়াকড়ি প্রবেশে তল্লাশি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দ-িত খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি ঘিরে সুপ্রীমকোর্টে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আদালতের ফটকে প্রবেশের সময় সবার পরিচয়পত্র দেখা হচ্ছে। প্রবেশপথে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার এসএম শামীম বলেন, নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে তল্লাশি করা হচ্ছে। তল্লাশির নামে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। আপীল বিভাগে আদালত কক্ষের বাইরে আর্চওয়ে বসানোর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নেয়। প্রতিটি প্রবেশ পথে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। আইনজীবীরা বললেন অবিচার, অবিচার’ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর আদালত কক্ষে ‘অবিচার, অবিচার’ বলে চিৎকার করেছেন আইনজীবীরা। শুনানিতে খালেদার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মানবিক কারণে তার জামিন চেয়ে বলেন, বেগম জিয়া কারাগারে ভাল মানুষ গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আজ পঙ্গু হওয়ার পথে। তিনি হাত-পা নড়াতে পারছেন না। চিকিৎসা এত উন্নত হচ্ছে যে দিন দিন তিনি পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। ৬ মাস পর হয় তো তিনি লাশ হয়ে বের হবেন। অপরদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ইবনে সিনা থেকে খালেদার রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। রিপোর্ট দেখে তাকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তিনি ভ্যাকসিন নিতে রাজি হচ্ছেন না। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিশেষ কোন অবনতি হয়নি স্বাস্থ্য পরীক্ষার তিনটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ২০১৮ সালের পর থেকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনিত হয়নি বলে জানিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, আমি আদালতে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার তিনটি রিপোর্ট পেশ করেছি। একটি ২০১৮ সালের রিপোর্ট, একটি এ বছরেরই কয়েক মাস আগের রিপোর্ট, আরেকটি ১১ ডিসেম্বরের রিপোর্ট। সব রিপোর্টের বক্তব্য তার রোগের বর্ণনা, শারীরিক অবস্থার বর্ণনা একই রকম আছে। কোন পরিবর্তন নেই। খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন নাকচের পর এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বেগম জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট যেটা দাখিল করা হয়েছে, সেটা পড়ে শুনানো হয়েছে। তাতে আমরা দেখিয়েছি, আসলে তার শারীরিক অবস্থার বিশেষ কোন অবনতি হয়নি। যে রকম ছিল, সে রকই আছে। সর্বশেষ মেডিক্যাল রিপোর্টে কী বলা আছেÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার দুটো হাঁটুই রিপ্লেসমেন্ট করা হয়েছে। একটা ১৯৯৭ সালে, আরেকটা ২০০২ সালে। এটা ভাল হওয়ার মতো নেই। স্বাভাবিকভাবে এত দিন পর রিপ্লেসমেন্টের কার্যকারিতা থাকে না। সেই ক্ষেত্রে এটার এ্যাডভান্সড (উন্নত) চিকিৎসা নিতে হয়। কতগুলো বিশেষ ধরনের ইনজেকশন আছে, সেই ইনজেকশন দিতে হবে। কিন্তু তার অনুমতি না পেলে তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, একজন দ-প্রাপ্ত আসামি হিসেবে তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের প্রিজন সেলে রাখার কথা। কিন্তু তাকে ভিআইপি কেবিনে রাখা হয়েছে। সেবা দান করার জন্য একজন সেবিকা দেয়া হয়েছে। সার্বক্ষণিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার দেখভাল করছেন। কিন্তু তার অনুমতি না পেলে উন্নত চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। এর আগে জামিন আবেদনের শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ৩০ বছর ধরে খালেদা জিয়া আর্থ্রাইটিস, ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিকস ও ১০ বছর ধরে হাইপার টেনশনে ভুগছেন। এছাড়া তার হাঁটু প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। খালেদা জিয়ার বাতের ব্যথার অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের রোগের চিকিৎসা এ্যাভেইলেবল। সুপ্রীমকোর্টে এরকম কারও জামিন নাকচ নজিরবিহীন বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন আপীল বিভাগ থেকে খারিজ হয়ে যাওয়াকে ‘নজিরবিহীন’ বলে অভিহিত করেছেন বিএনপিপন্থী সিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, এই মামলায় (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা) সাত বছরের সাজা পেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এর মধ্যে তিনি দেড় বছরের সাজা খেটেছেন। তিনি বয়স্ক, অসুস্থ। তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। এ অবস্থাতেও যে তার জামিন আবেদন সুপ্রীমকোর্ট নাকচ করবেন, তা নজিরবিহীন। শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও এ ধরনের জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়ার নজির নেই। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে আপীল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজের পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন। আপীল বিভাগ থেকে জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়ায় এই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়ার আর কোন আইনী প্রক্রিয়া বাকি রয়েছে কি না জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, আইনী প্রক্রিয়া থাকবে। যতদিন আইনজীবীরা আছেন, ততদিন আইনী প্রক্রিয়াও থাকবে। দেখেন, কী হয়। পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফ জামিন পেলে খালেদা নয় কেন সুপ্রীমকোর্টের বারের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন আদালতে বলেছেন, পাকিস্তানের মতো বর্বর দেশেও নওয়াজ শরীফকে মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে জামিন দিয়েছে, লন্ডনে পঠিয়েছে। মানবিক বিবেচনায় আমরা তার (খালেদা জিয়া) জামিন চাইছি। খালেদা জিয়া কেন জামিন পাবেন না। আদেশের পর তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলাম। আমরা আশা করেছিলাম, আদালত আমাদের কথা শুনে জামিন দেবেন। এর আগেও যেভাবে অন্যদের জামিন হয়েছে, সেভাবেই আমরা সাবমিশন করেছিলাম। কিন্তু আদালত আমাদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে আদালত কিছু বলেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডকে তার যথাযথ চিকিৎসা দিতে বলেছেন। এটা খুব মামুলি একটি বিষয়। এই মামলার পরবর্তী আইনী প্রক্রিয়া বিষয়ে তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে এ বিষয়টি দেখা যাবে। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় সিনিয়র আইনজীবীরা ঠিক করবেন। এখন আদালত যে আদেশ দিয়েছেন সেখানে কোন রিজন (কারণ) উল্লেখ করা হয়নি। দেখব, কী কারণে আমাদের আবেদন খারিজ করা হয়েছে। সে বিষয় দেখে আমাদের একটা সিনিয়র আইনজীবী প্যানেল আছে, ওই প্যানেলের আইনজীবীরা বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন। আমাদের আদালতের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আপীল ভিাগের ছয়জন বিচারপতি নিশ্চয়ই যথেষ্ট বিবেচনা করেই খালেদা জিয়ার জামিন না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আমরা যেহেতু আইনের শাসনে বিশ^াস করি, তাই আমাদের আদালতের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তার আলোকে বিএসএমএমইউর কিছু করণীয় থাকলে তারা তা নিশ্চয়ই করবেন। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন আইনমন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন রায়ে বা প্রতিবেদনে যত যুক্তিই থাকুক বিপক্ষে গেলে ওনারা (বিএনপি) অভ্যাস গতভাবে বলেন, এটা ঠিক না। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ছয়জন ডাক্তার পরীক্ষা করে সর্বোচ্চ আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তাই এ ব্যাপারে সন্দেহ ওনারা করতে পারেন, আমি করি না। ওনারা খালেদা জিয়ার জামিন চেয়েছিলেন মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে। মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখে সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, খালেদা জিয়াকে জামিনে অন্য কোথাও চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন নেই। বিএসএমএমইউ-তে যে চিকিৎসা হচ্ছে সেটাই যথেষ্ট। বিএনপি বলছে আদালতে মেডিক্যাল রিপোর্ট ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ওনাদের পছন্দমতো যেটাই হবে না সেটাই ভুল হবে। আর ওনাদের পছন্দ মতো যদি অন্যায় কিছু হয় সেটাই সঠিক হবে। তাই ওনাদের কথার ওপরে নির্ভর করে তো কেউ সিদ্ধান্ত দিবেন না। যে কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে, সর্বোচ্চ আদালত নিশ্চয়ই সেটা দেখেই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি যেহেতু আইনের শাসনে বিশ্বাস করি, তাই সর্বোচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেটাই আমাকে মেনে নিতে হবে। খালেদার স্বাস্থ্য প্রতিবেদন নিয়ে চিকিৎসকরা যা বললেন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাসহ দুটি মামলার দণ্ড নিয়ে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন বেগম জিয়ার রক্তচাপ এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণেই আছে। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন বলে কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিট রেজিস্ট্রার জেনারেল আলী আকবর বিএসএমএমইউয়ের প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। গত ১০ ডিসেম্বর গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডে রয়েছেন- চিকিৎসক শামীম আহমেদ, বদরুন্নেছা আহমেদ, তানজিমা পারভীন, চৌধুরী ইকবাল মাহমুদ, সৈয়দ আতিকুল হক, মোঃ ঝিলান মিয়া সরকার ও মোঃ ফরিদ উদ্দিন। এই বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কফজনিত শ্বাসকষ্ট (কফ ভেরিয়েন্ট অ্যাজমা), প্রতিস্থাপনজনিত হাঁটুতে ব্যথায় ভুগছেন। তার রক্তচাপ এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তার গেঁটেবাতজানিত সমস্যা জটিল পর্যায়ে রয়েছে; ক্রমেই এর অবনতি হচ্ছে। এর নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু এই রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে চিকিৎসা চালু আছে, গত কয়েক দশকে তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডান পায়ের ত্বকের নিচে এক ধরনের ছোট নডিউল আছে। এর জন্যও মেডিক্যাল বোর্ড একটি উন্নতমানের চিকিৎসার সুপারিশ করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার সম্মতি না থাকায় তাকে চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না।
×