ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অলিতে গলিতে উড়ছে বিজয়ের পতাকা

প্রিয় লাল-সবুজ রঙে সংগ্রামের ইতিহাস, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ১১:২৭, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রিয় লাল-সবুজ রঙে সংগ্রামের ইতিহাস, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন

মোরসালিন মিজান ॥ বাতাস এখন জোরালো নয়। মৃদুমন্দ হাওয়া। এর পরও লাল-সবুজের পতাকাটা খুব উড়ছে। মাত্র ক’দিন পর যে ১৬ ডিসেম্বর! বিজয় দিবস সামনে রেখে সর্বত্রই বাড়তি আবেগ। অন্যরকম উত্তেজনা। সেই আবেগ উত্তেজনা যেন ছুঁয়ে দিয়েছে জাতীয় পতাকাকেও। আকাশে উড়তে থাকা পতাকার দিকে নতুন করে চোখ যাচ্ছে। অলি গলি রাজপথে দৃশ্যমান হচ্ছে লাল-সবুজ। ফেরিওয়ালারা মনের আনন্দে প্রিয় রং ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। একইসঙ্গে বাঙালীর সংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরছে জাতীয় পতাকা। মুক্তিযোদ্ধারা যে কারণে অস্ত্র হাতে লড়েছিলেন, জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন যে কারণে, সেইসব কারণ খুঁজতে উৎসাহী করছে। পূর্ব পুরুষের গৌরবের ইতিহাস সঙ্গী করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেই প্রথম সামনে এসেছিল লাল-সবুজের পতাকা। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারবাহিকতায় নতুন পতাকার দাবি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ছাত্ররা এ নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন অনেক আগেই। ইতিহাসটি হুবহু কোথাও পাওয়া যায় না। তবে সে সময়ের ছাত্রনেতারা বিষয়টি নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে লিখেছেন। তাদের অন্যতম কাজী আরেফ আহমেদ। ‘বাঙালীর জাতীয় রাষ্ট্র’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেনÑ ৬ জুন ’৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে ডেকে আমি নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানাই। এই ফ্ল্যাগ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আ স ম আবদুর রব বলেন, এই পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রীন হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নক্সা তৈরি করি। বটলগ্রীন জমিনের ওপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। ...আমি প্রস্তাব করি যে, এই পতাকাকে পাকিস্তানী প্রতারণা থেকে বাঁচাতে হলে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের মানচিত্র দেয়া উচিত। সিরাজুল আলম খানের বর্ণনার সঙ্গে এ বর্ণনাটি মিলে যায়। সেইসঙ্গে পাওয়া যায় শিবনারায়ণ দাসের নামটিও। তিনিই নক্সাটি প্রথম দৃশ্যমান করেছিলেন। যতদূর তথ্য, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রদের পক্ষে তখনকার ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব এ দায়িত্ব পালন করেন। তার চেয়েও বড় ঘটনাটি ঘটে ২৩ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর মহান নেতার হাতে পতাকা ওঠায় সেটি ভবিষ্যত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। বিজয় অর্জনের পর পতাকার ডিজাইন নিয়ে আবারও ভাবতে হয়। ততদিনে মানচিত্র সংবলিত পতাকার কিছু সমস্যা সামনে চলে আসে। অগত্যা ১৯৭২ সালে বাদ দেয়া হয় মানচিত্র। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নক্সা রং মাপ ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করেন পটুয়া কামরুল হাসান। নক্সার ব্যাখ্যাও প্রদান করেন তিনি। সে অনুযায়ী, জাতীয় পতাকায় গাঢ় সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। তারুণ্যের জয়গান করে। মাঝখানে রাখা লাল বৃত্তটি শহীদের রক্তের প্রতীকী উপস্থাপনা। সেইসঙ্গে উদীয়মান সূর্য হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কামরুল হাসানের নক্সা করা বাংলাদেশের পতাকাটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি দাফতরিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়। বর্তমানে এ পতাকাটিই দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। সারা বছর সরকারী নিয়ম মেনে পতাকা উত্তোলন করা হয়। তবে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বদলে যায় ছবিটা। এবারও সর্বত্রই পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে। বাড়িতে। শিশুর হাতে। রিক্সার হাতলেও জাতীয় পতাকা। এ বেলায় সরকার নির্ধারিত মাপ বা ব্যবহারবিধি অনুসরণ করা না হলেও, কাউকে দোষ দেয়া হয় না। এ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফের মন্তব্য : বিজয়ের মাসে নতুন প্রজন্ম পতাকাটাকে আরও বেশি আপন করে নিয়েছে। মনের আনন্দে পতাকা উড়াচ্ছে তারা। এটা দেখতেও ভীষণ ভাল লাগে। তবে শুধু পতাকা উড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। এই পতাকা অর্জনের পেছনে আত্মত্যাগের ইতিহাস আছে। বীর দর্পে লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। সেগুলোও জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করতে হবে। পতাকা সে তাগিদই দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। একই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ফিরে যান ২০০১ সালে। শহীদের রক্ত¯œাত পতাকা অবমাননার ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, সে সময় একাত্তরের দালাল যুদ্ধাপরাধী জামায়াত শিবিরের সঙ্গে কোয়ালিশন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। দলটির প্রধান জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনের কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া সে কাজকেই এগিয়ে নিয়ে যান। একাত্তরের খুনীদের ঘাতকদের ধর্ষকদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন তিনি। মন্ত্রী পরিষদের সদস্য করা হয় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে। একাত্তরের আরেক খুনী রাজাকার পুত্র ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হন। এভাবে নিষ্ঠুর অবমাননার স্বীকার হয় জাতীয় পতাকা। তীব্র প্রতিবাদ ও বিচারের মাধ্যমে পতাকা উড়িয়ে চলা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। তবে সতর্ক না থাকলে এমন দুর্দিন নামতে পারে যখন তখন। তাই বিজয় দিবসে পতাকা উড়ানোর পাশাপাশি পতাকার সম্মান রক্ষা করার শপথ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
×