ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন আহম্মেদ হীরা

মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল

বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে প্রথম বৈঠক বসে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাড়িতে। সেখানে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান সিএসপি, পুলিশ সুপার ফখরুদ্দিন আহমেদ ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলাম। সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় ২৫ মার্চ শেষরাতে পুলিশ বাহিনীর অস্ত্রাগার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল সরবরাহ করা হয়। বরিশাল শত্রু কবলিত হওয়ার আগেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সচিবালয় গড়ে তোলা হয় নগরীর পেশকারবাড়ি সংলগ্ন সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সবাইকে নিয়ে এ সচিবালয় গঠিত হয়েছিল। এখান থেকেই বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে এ সচিবালয় থেকে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হতো। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য শক্তিশালী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। এরমধ্যে বেসামরিক বিভাগে নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, প্রতিরক্ষা বিভাগে মেজর এমএ জলিলসহ বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পান তৎকালীন আব্দুল মালেক খান, মহিউদ্দিন আহমেদ, এ্যাডভোকেট আমিনুল হক চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, শামসুল হক, এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এ্যাডভোকেট হাসান ইমাম চৌধুরী, এ্যাডভোকেট সরদার জালাল উদ্দিন, ডাঃ হুরমত আলী, এ্যাডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, মাকসুদ আলী বাদল, এমএ বারেক ও লুৎফর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা হিরু, লে. মেহেদী, আলী ইমাম, লে. নাসির, লে. অধ্যাপক সামসুদ্দিন খান, মাহফুজ আলম বেগসহ কয়েকজন। নৌপথে পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য জুনাহার নদীতে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে তা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে। আক্কাস হোসেনের নেতৃত্বে শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান ও সঙ্গীত পরিবেশন করে যুদ্ধে মুক্তিকামীদের প্রেরণা যুগিয়েছেন। সংগ্রাম পরিষদের অনুমোদিত বাংলাদেশ নামের একটি অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন এসএম ইকবাল, মিন্টু বসু ও হেলাল উদ্দিন। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। তিনি সর্বপ্রথম গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার নেতৃত্বে আগৈলঝাড়ার শিকিরবাজার, রামশীল ও পয়সারহাটে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে গৌরনদীর হোসনাবাদ গ্রামের নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে ৬০ থেকে ৭০ জন মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় আসেন। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাকবাহিনী জঙ্গী বিমান নিয়ে আকাশপথে বরিশালে প্রথম হামলা চালায়। জল, স্থল ও আকাশ পথে ২৭ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় বরিশাল শহরের বেলসপার্কে (বঙ্গবন্ধু উদ্যান) প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে আতঙ্কে শহর ছেড়ে পালায় অসংখ্য মানুষ। লোকজন গ্রামে আশ্রয় নিয়ে মাটি খুঁড়ে বাঙ্কার তৈরি করে বসবাস করতেন। ২৫ এপ্রিল মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৫ জনের একটি দল বানারীপাড়া থানায় আক্রমণ চালিয়ে লুট করে নেয় সব অস্ত্র। কিছুদিন পরই বাউকাঠী এলাকায় দুজন নারীযোদ্ধাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৭ জনের একটি দল পাকসেনাদের একটি লঞ্চে গুলিবর্ষণ করে। নিহত হয় আট পাকসেনা। ঝুনাহার নদী দিয়ে পাকবাহিনী নৌপথে বরিশালে প্রবেশের পর থেকেই তারা শুরু করে নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিল আড়াই শতাধিক সৈন্য ও ৫০ জনের মতো রাজাকার, আলবদর। বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রিজে পাক মিলিটারিদের বাঙ্কার ছিল। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এদের দোসররা ছিল এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিস কমিটির সদস্য। পাকবাহিনী বিভিন্নস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ লোকজনদের ধরে নিয়ে গৌরনদী কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পে হাত-পা, চোখ বেঁধে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাত। পাকবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা সিপাহী আনোয়ারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ঝালকাঠীর ফিরোজ কবিরকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক হানাদাররা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে সড়কপথে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা গৌরনদীর সাউদের খালপাড় নামক স্থানে তাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। হানাদাররা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। পাকসেনাদের সঙ্গে সেদিন সম্মুখযুদ্ধে প্রথম শহীদ হন গৌরনদীর নাঠৈ গ্রামের সৈয়দ হাসেম আলী, চাঁদশীর পরিমল ম-ল, গৈলার আলাউদ্দিন ওরফে আলা বক্স ও বাটাজোরের মোক্তার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওইদিন আট পাকসেনা নিহত হয়। এটাই ছিল বরিশালে স্থলপথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ এবং এরাই প্রথম শহীদ। এছাড়া গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, পয়সারহাট, কোটালীপাড়ায় সম্মুখযুুদ্ধে অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। মে মাসের শুরুতে গৌরনদী থেকে পাকবাহিনীর একটি দল বরিশাল শহরে ঢুকতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে মারা যায়। ৩ মে মেদাকুলে পাকসেনাদের ঘাঁটি থেকে চার সৈন্য পূর্ব নবগ্রামে ঢুকে সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে লুটপাট চালায়। গ্রামবাসী ওইদিন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই চার সৈন্যকে খতম করে। ১৪ জুন রাতে হরিণাহাটি নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে পিছু হটে পাকবাহিনী। কোটালীপাড়া থানায় আশ্রয় নিয়ে তারা রাজাকার-আলবদর ও পুলিশের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে একপর্যায়ে পালানোর চেষ্টা করে তারা। খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই শতাধিক পাকসেনা, রাজাকার-আলবদর ও পুলিশ। পরেরদিন খালে ভাসমান অবস্থায় তাদের ৫০জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বন্দী করেছিল শত্রুপক্ষের ১৮ জনকে। পরেরদিন পাকসেনারা লঞ্চ নিয়ে পয়সারহাটে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চে গুলি চালায়। এতে পাকবাহিনীর ছয় সৈন্য নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। গৌরনদী, উজিরপুর, কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থেকে চারটি স্পীডবোটযোগে পাকসেনারা প্রতিশোধ নিতে আগৈলঝাড়ার কোদালধোয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পয়সারহাট থেকে আট মাইল দূরত্বে সংঘটিত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরাস্ত করে। ওই যুদ্ধে নয় পাকসেনা মারা যায়। দীর্ঘ সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর সীমান্তে মিত্রবাহিনী আক্রমণ শুরু করার পর সন্ধ্যা থেকেই পাকসেনারা বরিশাল ত্যাগের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বরিশাল শহরমুখী সড়ক পথগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নৌযানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ তাদের দালাল ও রাজাকাররা বরিশাল ত্যাগ করতে থাকে। পাকবাহিনীর শহর ত্যাগের খবরে আট মাস অবরুদ্ধ থাকা মুক্তিকামী মানুষ বিজয়ের আনন্দে সেøাগান দিয়ে দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে। নগরীর ওয়াপদা কলোনিতে পাকিস্তানী সৈনদের স্থায়ী ঘাঁটিতে লুকিয়ে থাকা পাকসেনা ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, লে. মাহফুজ আলম বেগ ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতান মাস্টারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জেলার সর্বশেষ পাক হানাদার মুক্ত হয় গৌরনদী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলেও বরিশালের গৌরনদী পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল ২২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের মধ্যে সর্বশেষ বিজয় পতাকা উড়েছিল গৌরনদী। টানা ২৮দিন মুজিববাহিনীর কমান্ডার বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে (বর্তমান সংসদ সদস্য ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে তার চাচাত ভাই রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্বগ্রামের মেজর শাহ আলম তালুকদারসহ মুজিববাহিনীর সদস্যরা পশ্চিম দিক থেকে এবং পূর্বদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধা নিজাম বাহিনীর সদস্যরা গৌরনদী কলেজের পাক সেনাদের স্থায়ী ক্যাম্পে যৌথ আক্রমণ চালায়। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা পরাস্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে অবস্থানরত শতাধিক পাকসেনা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। লেখক : বরিশাল প্রতিনিধি, দৈনিক জনকণ্ঠ
×