ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁচাতে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে;###;বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের গবেষণা রিপোর্টে তথ্য;###;রিপোর্টে নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় করতে বলা হয়েছে

বছরে ৭১ হাজার হেক্টর কৃষিজমি যাচ্ছে অকৃষিতে

প্রকাশিত: ১১:০৮, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯

বছরে ৭১ হাজার হেক্টর কৃষিজমি যাচ্ছে অকৃষিতে

ফিরোজ মান্না ॥ প্রতিবছর দেশের প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর কৃষিজমি অকৃষি খাতে পরিবর্তিত হচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বনভূমি ও জলাশয় তৈরি এবং আবাসনই এর মূল কারণ। খুব দ্রুত সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে না পারলে কৃষি জমি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তারা বলছে, অর্থনৈতিক অগ্রসরমান বাংলাদেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ভৌত পরিকল্পনায় নানামুখী সমস্যার সমাধানের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। নগর ও গ্রামীণ পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ অবস্থার দ্রুত উন্নতি সম্ভব হতে পারে। বিআইপির রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা, অধিক জনঘনত্ব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দেশের প্রতিইঞ্চি ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রতিবছর দেশের প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর জমি অপরিকল্পিত অকৃষি খাতে বদলে যাচ্ছে। একদিকে যেমন শিল্পায়ন প্রয়োজন অন্যদিকে দেশের বনাঞ্চল, জলাভূমি, হাওড়, বিল, পাহাড়ের মতো সংবেদনশীল এলাকা সংরক্ষণও দরকার। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য টেকসই উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে সারাদেশের ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরিকল্পিত উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। পরিকল্পিত নগর ও গ্রাম উন্নয়নকে সঠিক নীতি ও আইনী কাঠামোর আওতায় আনা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে প্রণীত খসড়া ‘নগর উন্নয়ন নীতি’ ও ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন’ চূড়ান্ত অনুমোদন দরকার। দেশের প্রবহমান উন্নয়ন ব্যবস্থা মহাপরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার পরিকল্পনার মাধ্যমে শৃঙ্খলিত করা দরকার। এজন্য নগর-শহরে ভৌত পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। গ্রামাঞ্চলে যেহেতু দ্রুত নগরায়নের ছোঁয়া লাগছে। গ্রাম ও উপজেলার সুষ্ঠু ভূমি ব্যবহারের জন্য উপজেলা পর্যায়ে ‘পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ’ তৈরি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, নগরজনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করে। দেশের মোট আয়তনের আনুমানিক ৭ ভাগ নগর এলাকা থেকে জাতীয় আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ অবদান রাখছে। ’৪০ সালের মধ্যে দেশের অর্ধেক মানুষ নগরেই বসবাস করবে। তাই বর্তমান নগরায়ণের বাস্তবতা ও ভবিষ্যত প্রেক্ষিত বিবেচনায় নগরায়ণকে সঠিকভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে একটি ‘নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ প্রয়োজন। ’৩০ সালের মধ্যে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত পরিকল্পিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এগিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্দেশিত উপজেলাভিত্তিক বর্তমান ইমারত নির্মাণ নক্সা অনুমোদন প্রক্রিয়াকে যথাযথ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি অতি জরুরী। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে। প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও একই সঙ্গে বাড়ছে আয় বৈষম্য। দেশের আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে ও উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণ এবং সারা দেশের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। ভূমি স্বল্পতায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দেশের নদী, খালসহ বৃহৎ জলাভূমি রক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া অতীব জরুরী। একই সঙ্গে পাহাড়, বন ও সমুদ্রসীমা রক্ষায়ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিআইপি বলেছে, সব ধরনের নাগরিক সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায়ে আয়ের ভিত্তিতে নয় বরং উপকারভোগীর সংখ্যা ও ধরন বিবেচনায় নিয়ে বিতরণের প্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শহর ও গ্রামকে সমান বিবেচনায় নিতে হবে। শহর এলাকায় উন্মুক্ত স্থান, গণপরিসর ও বিভিন্ন বয়সের মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য পাড়া ও এলাকাভিত্তিক পার্ক ও খেলার মাঠের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের অসংখ্য স্থানীয় সরকারকে নিজ নিজ এলাকায় পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এটা না করতে পারলে দেশের কৃষিজমি একদিন হারিয়ে যাবে। কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে তখন আর বাংলাদেশের পরিচিতি থাকবে না। কৃষি পণ্য উৎপাদন করার জমি না থাকলে সব কিছুই দেশের বাইরে থেকে আনতে হবে। বিলুপ্তি ঘটবে চাষী সমাজের এমন যদি হয় তাহলে দেশের জন্য তা হবে ভয়াবহ ঘটনা। এ জন্য সরকারকে আগে থেকেই পরিকল্পিত নগর ও গ্রাম উন্নয়ন করতে হবে। বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে বিআইপি দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পিত নগরায়ণসহ গ্রাম পর্যায়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও বিভিন্ন সময় পরিকল্পিত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। নীতি ও আইন প্রয়োগ না হওয়ায় পরিকল্পনার কাক্সিক্ষত প্রসার এখনও ঘটেনি। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক ভারসাম্যের অভাব রয়েছে। পরিকল্পিত উন্নয়নে সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে পৌরসভা, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পর্যায়ে করতে হবে। দেশে জমি দিন দিন কমে আসছে। পরিকল্পিত উন্নয়ন না করতে পারলে ভবিষ্যতে দেশে কৃষিজমি পাওয়া কঠিন হবে। আর এ জন্য পরিকল্পনাসহ অন্যান্য কারিগরি পেশার অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
×