ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গারোদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান ‘ ওয়ানগালা’পালিত

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

গারোদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান ‘ ওয়ানগালা’পালিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সাত বছরের গারো আদিবাসী মেয়ে কৃষ্টি বনোয়ারী। তার সারা শরীরে গারো সংস্কৃতির ছাপ। ছোট আকারের নকমান্দা ও টি শার্ট পরে সে রাজধানীর লালমাটিয়া স্কুল এ- কলেজ প্রাঙ্গণের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একই পোশাক পরেছে তার বড় বোন মাটি বনোয়ারী। মঞ্চে চলছে গারো নাচ ও গান। মনের অজান্তেই নিজেদের সংস্কৃতির অতি পরিচিত গানের তালে তালে নাচতে থাকে এই দু’বোন। বছরে একদিন এমন পোশাক পরার এবং সকলের সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ পায় তারা। শুধু এই ছোট দু’ বোন নয়, শুক্রবার রাজধানীতে বসবাসরত সব বয়সের কয়েক হাজার গারো আদিবাসী করে তাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব ‘ ওয়ানগালা’। এদিন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া স্কুল ও হাইস্কুল মাঠে দিনব্যাপী পূজা-অর্চনা, আলোচনা, নাচ-গানে এই উৎসবটি পালন করেছে রাজধানীতে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়। ওয়ানগালার নকমা(গ্রাম্য প্রধান) আলেক্সসিউস চিচাম জনকণ্ঠকে জানান, ওয়ানগালা' ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। আদিবাসী গারোদের বিশ্বাস, শস্য দেবতা বা 'মিশি সালজং' পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারা বছর পরিমাণ মতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ভালো শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। তাই নবান্নে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় 'মিশি সালজং'কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করে গারোরা। ফসল দেবতাকে উৎসর্গ না করে তারা কোন খাদ্য ভোগ করে না। 'ওয়ানগালা' আদিবাসী মান্দি বা গারোদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। দেড় এক যুগ ধরে প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় বসবাসরত গারোরা এ উৎসব আয়োজন করছে। যুগ যুগ ধরে গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে। খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গারোদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয়। অর্থাৎ এক সময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিষ্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন। এ সময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুক্রবার সকালে দেবতাদের পূজার মাধ্যমে শুরু হয় ‘ওয়ানগালা উৎসব ’। ‘আমুয়া’, ‘রুগালা’র মতো ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। দুপুরের বিরতির পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে নিজস্ব ভাষায় গান গেয়ে শোনান গারো শিল্পীরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল গারোদের ঐতিহ্যবাহী জুম নাচ। উৎসবে উপস্থিত গারারো জানায়, ওয়ানগালা একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। ওয়ানগালা উৎসব পাহাড়ি জুমচাষকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হয়ে থাকে। নতুন ফসল তোলার পরে নকমা (গ্রামপ্রধান) সবার সঙ্গে আলোচনা করে অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন। উৎসব উপলক্ষে শুক্রবার রাজধানীর লালমাটি স্কুল এ- কলেজ প্রাঙ্গণে জড়ো ঢাকায় বসবাসরত কয়েক হাজার গারো। । শহুরে জীবনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দিনভর তারা নিজেদের মতো করে আনন্দে মেতে থাকে। স্কুল মাঠে গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন পণ্যের অস্থায়ী স্টল। ওই সব স্টলে স্থান পায় গারো সংস্কৃতি ও আবেগবিজড়িত পোশাক, খাবার, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ধরণের পণ্য। খাবারের দোকানে ঘুরে ঘুরে স্বাদ নেয় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবারের। কেউ কেউ বাসায় খাবার জন্য কিনে নেন জুমের আলু, কুমড়া, শামুক, কাঁকড়া। ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, নতুন ধানের চালের গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে শস্য, বাড়ি ও মানুষের কপালে বা শরীরে ছাপ দেয়া হয়। ধূপ পুড়িয়ে, দামা বাজিয়ে রাজকীয় বেশে 'নকমা' বা সমাজ প্রধান ও 'খামাল' বা পুরোহিত নৃত্য করতে করতে গান গাইতে গাইতে দল বেঁধে রাজ্যের প্রজাদের নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় 'দু' বা মুরগি এবং 'চু' বা মদ দিয়ে তাততারা রাবুকা বা বাঁশ দিয়ে বানানো প্রতিমা রাক্কাসীর প্রতি ধন্যবাদ জানান। সঙ্গে নোকমি বা সম্প্রদায় প্রধানের স্ত্রীও থাকেন। আর পিছে থাকে কালো বা লম্বা বাঁশ দিয়ে বানানো বাঁশি, দামা বা লম্বা ঢোল, বোম বা মহিষের শিং দিয়ে বানানো বাঁশি নিয়ে রাজ্যের সাধারণ গারোরা। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জুম ওয়ানগালা আজ শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি গারোদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার এক অনবদ্য আন্দোলন বলে দাবি করেছে উপস্থিত গারোরা। বাংলাদেশ আদিবাসীদের ফোরামের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হলেন যথাক্রমে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) ও সঞ্জীব দ্রং। রাজধানীর লালমাটির ওয়ানগালায় সঞ্জীব দ্রংসহ সন্তু লারমার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভুমিকার কারণে সমতলভূমির গারো আদিবাসীর ওয়ানগালার সঙ্গে সন্তু লারমার সম্পৃক্ততার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢ্কাা ওয়ানগালা-২০১৯ এর নকমা আলেক্সসিউস চিচাম জনকণ্ঠকে জানান, এটি পাড়াহীদের নয়, গারো সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠান। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক কিনা তা এই অনুষ্ঠাবে বিবেচনা করা হয় না। এখানে জাতিগত সম্পর্কের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। তাই গারো সম্প্রদায়ে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী তা আমরা বিবেনা করি না। এটি গারো সম্প্রদায়ের একান্ত স্বাধীন ও প্রধান সামজিক অনুষ্ঠান বলে জানান আলেক্সসিউজ চিচাম। আর বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
×