ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাদ্রিদ জলবায়ু সম্মেলন এবং নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১ ডিসেম্বর ২০১৯

মাদ্রিদ জলবায়ু সম্মেলন এবং  নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা

নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়েই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২৫তম জলবায়ু সম্মেলন। সরকারবিরোধী প্রচন্ড বিক্ষোভের কারণে সব আয়োজন সম্পন্ন করেও চিলি সরকার শেষ পর্যন্ত এ সম্মেলন আয়োজনে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে এ বছরের জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠান নিয়ে সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের আহ্বানে তড়িঘড়ি করে স্পেন সাড়া দেয়ায় নির্ধারিত সময়েই অর্থাৎ ২ থেকে ১৩ ডিসেম্বর এবারের জলবায়ু সম্মেলনটির অনুষ্ঠান সম্ভব হচ্ছে। আগামী ২০২০ সাল থেকে কার্যকর হচ্ছে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি। ফলে এই সস্মেলনেই প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের রুলবুক তথা বিধিমালা চূড়ান্ত করতে হবে। এছাড়াও কার্বন বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতি (লস এ্যান্ড ডেমেজ) সংক্রান্ত ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজমের আওতায় বিপদাপন্ন দেশগুলোকে অর্থায়নের রূপরেখাও চূড়ান্ত করতে হবে। তাছাড়া বিশ্ব যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তা প্রশমনে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন রোধেও প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জনে নতুন করে দেশগুলোকে শপথ নিতে হবে। ফলে নানা কারণে এবারের জলবায়ু সম্মেলন সবার কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারী প্রতিনিধি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ প্রায় কয়েক হাজার প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। বাংলাদেশ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল যোগ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে তাকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সব সময়ই সোচ্চার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের উপকূলবর্তী যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত ও হুমকির সম্মুখীন, বাংলাদেশ তার অন্যতম। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা বিশ্ব দরবারে আরও একবার তুলে ধরা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত প্রতিকূলতাকে জয় করে সহনশীল অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান তৈরি করতে বাংলাদেশ যেসব ভবিষ্যত কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে বৈশ্বিক পরিম-লে তা তুলে ধরা সম্ভব হবে। প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আহ্বান জানাবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য এবারের সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে: এই আলোচনায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান বিষয় অর্থাৎ গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা বা ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) অর্জনের জন্য প্যারিস চুক্তির বিভিন্ন ধারা ও সেগুলোর বাস্তবায়ন নীতিমালা চূড়ান্ত করা হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজম অন লস এ্যান্ড ডেমেজের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা এবং পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা। অতি বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মৌলিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হলো লস এ্যান্ড ডেমেজে বা ক্ষয়ক্ষতি ইস্যু। সম্মেলনে এর অর্থায়ন বিষয়েও অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে। ফলে ২৫তম জলবায়ু আলোচনা আমাদের সরকারের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সরকারের বাইরে নাগরিক সমাজও দীর্ঘদিন ধরেই জলবায়ু আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়কা ভূমিকা পালন করছে এবং বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা হলো, এবারের বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় সরকারের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের স্বার্থে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে হলে সরকারকে অবশ্যই ইউএনএফসিসিসির বিভিন্ন কর্মকমিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় মূলত দুটি পক্ষ থাকে। একটি উন্নত দেশ। অপরটি উন্নয়নশীল দেশ। আলোচনায় মূলত এই দুই পক্ষের মধ্যেই দরকষাকষি হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো আবার স্বার্থ অনুযায়ী অনেক ধারায় বিভক্ত। তবে সবচেয়ে বিপদাপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত এবং স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে অবস্থান নিয়ে জোড়াল ভূমিকা রাখা। সরকারের অবস্থান হওয়া উচিত বৈশি^ক তাপমাত্রা ১.৫০ সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য ধনী দেশসমূহকে তাদের স্বপ্রণোদিত লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করার দাবি তোলা। ‘প্যারিস চুক্তির’ মূল স্তম্ভ হচ্ছে ‘গ্রীন হাউস গ্যাসের উদগীরণ’-এর ভবিষ্যত বৈশ্বিক পথরেখাকে এমনভাবে প্রণয়ন করা, যাতে পৃথিবীর উষ্ণতা শিল্প বিপ্লবপূর্ব তাপমাত্রা থেকে ২ ডিগ্রী অথবা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ কর্তৃক ঘোষিত ২০৩০ এর মধ্যে নির্গমন হ্রাসের যে প্রতিশ্রুতি এসেছে, তা পৃথিবীর উষ্ণতা (শিল্প বিপ্লবপূর্ব) ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির মধ্যে সীমিত রাখার চেষ্টাকে কোনভাবেই সমর্থন করে না। বরং এটি ২০৩০ এর মধ্যে ৫২-৫৮ গিগাটন কার্বন নির্গমনের বিষয়টি নিশ্চিত করে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে এবং সর্বশেষ আইপিসিসির বিশেষ প্রতিবেদন এবং তাদের সুপারিশ অনুসারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে অবশ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনের হার ৪০-৫০ শতাংশ কমাতে হবে। সেই সঙ্গে ২০৭৫ সালের মধ্যে ‘শূন্য গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন’ হার অর্জন করতে হবে। ফলে সম্মেলনে ধনী দেশসমূহের ‘প্রশমন উচ্চাকাক্সক্ষা’ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির দাবির কোন বিকল্প নেই। প্যারিস চুক্তির ৬.৩ ধারায় এনডিসি বাস্তবায়ন ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে ধনী দেশগুলোকে স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কোন দেশ তার নিজ দেশে অর্জিত প্রশমন কাজের ফলাফল অন্য দেশে স্থানান্তর বা কেনাবেচা করতে পারবে। অর্থাৎ, একটি বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে এনডিসি বাস্তবায়ন ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা করা। বর্তমান যুগে বাজার ব্যবস্থার ধারক-বাহক এবং নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ধনী দেশসমূহ, যারা মূলত দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহ থেকে তাদের বাস্তবায়িত প্রশমন কার্যের ফলাফল ক্রয় করার মাধ্যমে নিজেদের অর্জন বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। এখানে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ধনী দেশগুলো বাজারভিত্তিক এনডিসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এ ধরনের সমঝোতা কৌশল আসলে স্বল্পোন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশসমূহকে তাদের স্বার্থের বাইরে অথবা স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন সব কর্মকা- চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে। যেমন, প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ ২০২০ সালের মধ্যে এনডিসি বাস্তবায়নের কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে, তবে যে সকল কৌশলগত ক্ষেত্রে এখনও কোন ঐকমত্য হয়নি, সে সকল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহকে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে। এই ‘মানিয়ে নেয়ার’ শর্তটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এনডিসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে, উন্নয়নের জন্য জীবাশ্ম-জ¦ালানির ব্যবহার হবে শর্তহীন এবং এখানে মানিয়ে নেয়ার কোন বিষয় নেই। সুতরাং কার্বন কেনাবেচার ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়টিকে বিরোধিতা করার প্রয়োজন রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই একটি বহুপাক্ষিক এবং জাতিসংঘের কাঠামোর প্রক্রিয়ার মধ্যে সুনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব করতে হবে। বৈশি^ক চাহিদা অনুযায়ী প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল প্রদানের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না হয়ে ঐচ্ছিক হওয়ায় ঝুঁকিতে থাকা স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তথ্য ও বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে প্রতিনিয়ত সর্বোচ্চ দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি হতে বের হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অর্থায়নে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। ২০২০ সাল হতে প্রতিবছর প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে অর্থায়নের প্রধান মাধ্যম সবুজ জলবায়ু তহবিলে (জিসিএফ) এ পর্যন্ত মাত্র ১০.৩ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত জিসিএফ হতে সর্বমোট প্রকল্প চাহিদার পরিমাণ ২০.৬ বিলিয়ন ডলার। এ প্রেক্ষিতে কোন্ উৎস হতে, কখন এবং কিভাবে তা প্রদান করা হবে, তার নিশ্চয়তা না থাকায় ক্ষতির মাত্রা যে সামনে বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশসহ ১০টি দেশকে জিসিএফ মাত্র ১.৩ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে অনুমোদিত সর্বমোট তহবিলের মাত্র ০.০৭% (মাত্র ৮৫ মিলিয়ন ডলার)। অথচ ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন অনুসারে শুধু বাংলাদেশের অভিযোজন বাবদ বছরে দরকার ২.৫ বিলিয়ন ডলার। প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু অর্থায়নের সর্বসম্মত সংজ্ঞা নির্ধারণ না করায় ‘নতুন’ এবং ‘অতিরিক্ত’ উন্নয়ন সহায়তা এবং অনুদান অথবা ঋণ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় অর্থায়নের ক্ষেত্রে এ অস্পষ্টতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থায়নের বিষয়ে ধারা ৯ এ অধিকতর আর্থিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত ও বিপদাপন্ন রাষ্ট্রগুলোকে সরকারী অর্থ বা অনুদান দেয়ার কথা বলা হলেও তা নতুন বা অতিরিক্ত হবে কিনা, তা চুক্তিতে স্পষ্ট করা হয়নি। অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রশমনের উদ্দেশ্যে প্রশমন ও অভিযোজন উভয় ক্ষেত্রেই অনুদানভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সবুজ জলবায়ু তহবিলের অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ এমনকি সরকারী-বেসরকারী স্টেক হোল্ডোরদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। সে প্রেক্ষাপটে বিপদাপন্ন দেশসমূূহের জন্য অর্থায়নের উদ্দেশ্যে সবুজ জলবায়ু তহবিলের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রকল্প চূড়ান্তকরণ ও অর্থ ছাড়ের বিষয়সমূহ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, সবুজ জলবায়ু তহবিলের অর্থ বিতরণ কৌশলেও অসাম্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছে প্রশমন এবং অভিযোজন উভয় খাতেই অর্থ বরাদ্দ হতে হবে সমান সমান। অর্থাৎ কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অর্থ অভিযোজন খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য বলছে, গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড এক্ষেত্রে দ্বীমুখী নীতি অনুসরণ করছে। কারণ মোট বরাদ্দের মাত্র ২৪ শতাংশ অর্থ অভিযোজন খাতে ছাড় করা হয়েছে। আর এটা হয়েছে মূলত অভিযোজন কর্মসূচীতে তহবিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কঠিন শর্তের কারণে। এছাড়া প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা স্বল্পোন্নত ও বিপদাপন্ন দেশসমূহের ক্ষেত্রে তহবিলে অংশগ্রহণ কঠিন করে তুলছে। তাই সরকারের এ বিষয়ে কথা বলতে হবে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই। ১৯তম জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজম প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এ কমিটির কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এর পেছনে অবশ্য ধনী দেশগুলোর অব্যাহত বাধার বিষয়টি রয়েছে। তাদের কারণে ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে কোন প্রকার সমঝোতায় আসা সম্ভব হচ্ছে না। বরং ক্ষয়ক্ষতি বিষয়টি নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিসমূহের ব্যবসা ও মুনাফা করার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য ধনী দেশগুলো তথাকথিত বীমা ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য কমিটির মাধ্যমে স্বল্পোন্নত ও বিপদাপন্ন দেশগুলোর ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুতাড়িত দেশগুলোতে এ ধরনের বীমা ব্যবস্থা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, তাদের বীমা প্রদানের কোন আর্থিক সক্ষমতা নেই। আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে এটি নিয়ে কাজ করার এজেন্ডা রয়েছে এবং ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজমের সুযোগ রয়েছে অগ্রগতি পর্যালোচনার। সরকারকে এই সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে পৃথক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি হবে পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়নকারী। অর্থাৎ ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজমের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত ও বিপদাপন্ন দেশসমূহের চাহিদা নিরূপণ, কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, অর্থায়নসহ তত্ত্বাবধানের সকল বিষয় বাস্তবায়ন করা হবে। পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আর্থিকভাবে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে একটি সুনির্দিষ্ট লস এ্যান্ড ডেমেজ ম্যানেজমেন্ট ফান্ড গঠন করতে হবে এবং ধনী দেশসমূহ সেখানে অর্থায়ন করবে। সকল ধনী দেশকে সেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষ বিষয়টি হলো জলবায়ু তাড়িত বাস্তুচ্যুতি। এই ইস্যুটিও বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম ইস্যু জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি (দেশের মধ্যে, সীমানা অতিক্রম করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে) নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করছি। আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তন তাড়িত বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়ে সঠিক এবং সময় উপযোগী বক্তব্য রাখেন। পরবর্তীতে কানকুন ফ্রেমওয়ার্কে মাইগ্রেশনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, জলবায়ু পরিবর্তন তাড়িত বাস্তুচ্যুতি ও মাইগ্রেশন ইস্যুটি যেখানে জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে, সেখানে জলবায়ু আলোচনায় বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতির বিষয়টি আলাদাভাবে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে এবং এটি জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনা করে এই প্রক্রিয়ার আওতাতেই বাস্তুচ্যুত মানুষের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক ক্রস-বর্ডার মাইগ্রেশনের সুযোগ এবং দেশীয় পর্যায়ে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিশ্চিত করার দাবি জানাই। এক্ষেত্রে সরকারকে বিষয়টি জলবায়ু কাঠামোর মধ্যে রেখেই এর বাস্তবায়ন কৌশল নিশ্চিত করতে হবে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×