ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছিটমহলে উন্নয়নের ছোঁয়া- প্রতিটি পরিবারে সচ্ছলতা

প্রকাশিত: ১০:১৩, ৯ নভেম্বর ২০১৯

 ছিটমহলে উন্নয়নের  ছোঁয়া- প্রতিটি  পরিবারে সচ্ছলতা

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট থেকে ॥ বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র। সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিলুপ্ত ছিটমহলে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। শিশু ও নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছে। পেয়েছে নাগরিক অধিকার ও আইনী সুরক্ষা। চার বছরের মধ্যে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষগুলো দেশের মূল ভূখন্ডের মানুষের মূলধারায় যুক্ত হয়ে গেছে। ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে জেলা সদরের কুলাঘাট ইউনিয়নের ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছালেহা সরকার বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি সরকারী করার দাবি জানিয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী। প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে দাবি উঠেছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার। দাবি উঠেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের ভূমি সংক্রান্ত সকল জটিলতা নিরসন করার। যাতে বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির মালিকরা জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের ভেতরে থাকা ছিটমহলগুলো বিনিময়ের ফলে ৬৮ বছরের পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে মুক্ত হয়ে যায়। মানুষ পেয়েছে স্বাধীনতা। পেয়েছে দেশের নাগরিকত্ব। পেয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার। শিশু ও নারীরা পেয়েছে মর্যাদাপূর্ণ জীবন। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীরা এখন দেশের মূল ভূখন্ডের নাগরিকদের মতো সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। মিশে গেছে দেশের মূল স্রোতধারায়। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের সর্বত্র উন্নয়ন চোখে পড়ে। বিলুপ্ত ছিটমহলে এখন ঝুপড়ি ঘর নেই। কাঁচাপাকা টিনশেড বাড়িঘর চোখে পড়ে। মানুষের আর্থসামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। নারী ও শিশুরা পেয়েছে আইনের সুরক্ষা। শিশু ও নারী অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদের সূত্রে জানা গেছে, বিগত চার বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১ ছিটমলের উন্নয়নে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। লালমনিরহাট জেলা সদরের ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই ও বোয়ালমারী বাঁশপচাঁই সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল দুইটিতে বিগত ৪ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঘটেছে বিলুপ্ত ছিটমহল ভিতরকুটি বাঁশপচাঁইয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন। এই বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় ২২৭ পরিবারের বসবাস। এরমধ্যে চারটি পরিবার রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের। এই বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ ভারতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও কোন মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব নেয়নি। ভারতে যায়নি। ছিটমহলটির আয়তন প্রায় ৮৫ বর্গ একর জমি। এই বিলুপ্ত ছিটমহলের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি ও কৃষি শ্রমিক। বিলুপ্ত ছিটমহলটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধরলা নদী। তাই কিছু মানুষ ধরলা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা মৎসজীবী শ্রমিক। ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই ছিটমহলটিতে বিগত ৪ বছরে শহীদমিনার, মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ মাঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাস্তা পাকা হয়েছে এলজিইডির অধীনে প্রায় ৯ কিলোমিটার। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ বিদ্যুত পৌঁছে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ একশত ওয়াটের সোলার প্যানেল সরকারীভাবে দেয়া হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের প্রতিটি পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা ফিরাতে বিগত দুইবছর সরকারীভাবে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে ভিজিডি কার্ডের মাধ্যকে বিনামূল্যে চাল দেয়া হয়েছিল। সরকারীভাবে ল্যাট্রিন, টিউবয়েল, ভিজিডি কার্ড, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড দেয়া হয়েছে। কৃষকদের সহায়তা করতেও স্বল্পমূল্যে সেচ সুবিধা দিতে একটি সৌরবিদ্যুত চালিত সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলটিতে বিগত চার বছরে প্রায় ৩ শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। ছিটমহল বিনিময়ের পূর্বে ছিটের শিশু ও নারীদের আইনের মাধ্যমে কোন সুরক্ষা ছিলনা। এখানে ছিলনা আইনের শাসন। ছিটমহলের নারীদের বিয়ে হলে কোন নিকাহ রেজিস্ট্রি হতো না। তাই স্বামী দ্বারা তারা নির্যাতন ও তালাকপ্রাপ্ত হলে কোন আইনী সহায়তা পেত না। নারী ও শিশুরা পাচার বা অপহরণ হলে কোন আইনী সহায়তা পেতনা। ছিটমহলের বাসিন্দারা ছিল অবহেলিত। অন্যের জমিতে স্বল্পমূল্যে শ্রম ও দিনমজুরি করে জীবন চলত। সেখানে নির্যাতন হলেও ছিটমহলের অধিবাসী বলে কোন বিচার পেত না। ছিটমহলের কৃষক তার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের কোন ন্যায্যমূল্য পেতনা। ছিটমহলের চাষীরা পুরনো পদ্ধতিতে করত চাষাবাদ। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষেরা আধুনিক কৃষি যন্ত্র ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছে। তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ন্যায়মূল্যে দেশের মূল ভূখন্ডের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ এখন সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। পাচ্ছে দেশের মূল ভূখন্ডে মানুষের মতো সকল সুযোগ সুবিধা। ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহলটি হতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দূরত্ব প্রায় ২/৩ কিলোমিটার। তাই ২০১৫ সালে ভিতরকুটি ছিটমহলে লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোঃ মতিয়ার রহমান ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪৫ শতাংশ জমি কিনে তার মায়ের নামে ছালেহা সরকার বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়টিতে শিশু শ্রেণীতে ৩৫ জন, প্রথম শ্রেণীতে ২০ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২২জন, তৃতীয় শ্রেণীতে ১৫ জন ও চতুর্থ শ্রেণীতে ১০জন শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা, ৪জন নারী সহকারী শিক্ষিকা ও একজন সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। তারা দীর্ঘ ৪ বছর বিনা বেতনে স্কুলটিতে পাঠদান করে আসছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছাঃ শিরিনা খাতুন জানান, বিদ্যালয়টির শিশু শিক্ষার্থীরা কোন সরকারী উপবৃত্তি পায় না। তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। সরকারী উপবৃত্তি পার্শ¦বর্তী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু রয়েছে। সেখানে উপবৃত্তির কারণে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে। ছালেহা সরকার বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি চালু না থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম বলে জানান। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, বই খাতা ও টিফিন বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা দিয়ে থাকেন। বিদ্যালয়ে বেঞ্চ সংখ্যাও কম রয়েছে। বিদ্যালয়টি দ্রুত জাতীয়করণ করে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতের দাবি জানান তারা। বিগত ৪ বছরে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে বিভিন্ন দফতর নানা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ট্রেনিং পেয়েছেন ভিডিপি, আইটি, কৃষি, ব্র্যাক, পশুপালন, মৎস্যচাষ, গরু ছাগল পালন, ভেড়া পালন, হাঁস-মুরগি পালন বিষয়ে কৃষকরা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে আধুনিক চাষাবাদের নানা পরামর্শ পেয়ে থাকেন। বিলুপ্ত বাঁশপচাঁই ছিটমহলের বাসিন্দারা বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের। এছাড়া বেকারদের কর্মসংস্থান ও শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক ও যুবমহিলাদের মেধা ও শিক্ষানুযায়ী চাকরির দাবি জানান। ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, বিলুপ্ত ছিটমহল মুক্ত হওয়ার চার বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ তাদের বাড়িঘর জমির খাজনা দিতে পারছেনা। তাই বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী তাদের কৃষি জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছেনা। জমি ক্রয়-বিক্রয় করা সংক্রান্ত জটিলতার তারা দ্রুত নিষ্পত্তি চান। কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের ধাইরখাতা ও বনগ্রাম মৌজার অভ্যন্তরে ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই ও বয়ালমারী বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহল দু’টির অবস্থান। তাই কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ইদ্রিস আলী জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলে বিগত চারবছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আরও উন্নয়ন হবে। বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষরা দেশের মূল ভূখ-ের মূল স্রোতধারার মিশে গেছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের প্রতিটি পরিবার এখন মোটামুটি আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে পেয়েছেন। ৬৮ বছর নিজ দেশে পরবাসী ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহলের মানুষ। ছিল উন্নয়নবঞ্চিত। ছিলনা কোন দেশের নাগরিক অধিকার। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ছিল অবহেলিত। ছিল না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছিলনা রাস্তাঘাট। ছিলনা ধর্মীয় উপাসনালয়, মসজিদ, মন্দির। ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা ৬৮ বছর ছিল পরিচয়হীন। পরগাছার মতো বেঁচে ছিল। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার হতে ছিল সম্পূর্ণ বঞ্চিত। ছিটমহলে ছিলনা কোন আইন। দু’দেশের কোন দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কোন তদারকি ছিটমহলে ছিল না। তাই ছিটমহলে অপরাধীদের ছিল আশ্রয়স্থল। ছিটমহলের শিশুরা বেড়ে উঠত অপরাধ প্রবণতা নিয়ে। ছিটমহলের নারীরা ছিল প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসীদের ভোগের পাত্রী। ছিটমহলে নারীদের বিয়ে শাদি হলে কোন নিকাহ রেজিস্ট্রি হতো না। তাই নারীরা স্বামীর সংসারের নির্যাতনের শিকার হলে কোন বিচারপ্রার্থী হতে পারতনা। ছিটমহল বিনিময়ে সেইদিন শেষ হয়ে গেছে। এখন নারী ও শিশুরা আইনের দ্বারা সুরক্ষিত। লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব সীমান্ত চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের ভিতরে থাকা ১৬২ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাস্তবায়ন হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার। এগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি এবং নীলফামারী জেলায় ৪টি। যার জমির পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার ১ শত ৬০ একর। জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৪১ হাজার ৪ শত ৪৯ জন। এর মধ্যে ৯৭৯ জন ভারতীয় নাগরিক হয়ে ভারতে চলে গেছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১৯টি ছিটমহলে কোন জনসংখ্যা ছিলনা। শুধু কৃষি জমি ছিল। ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের কোন বাসিন্দা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত হতে বাংলাদেশে আসেনি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের কুচবিহার জেলার ভেতর ছিল। ৫১টি ছিটমহলের জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। জমির পরিমাণ ৭ হাজার একর। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোঃ আবু জাফর জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলের উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর মানুষ দেশের সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের সকল সমস্যা একে একে দূর করা হবে।
×