ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আবু নোমান

প্রদোষকালে বাংলার গ্রাম ও নগর

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৮ নভেম্বর ২০১৯

প্রদোষকালে বাংলার গ্রাম ও নগর

বাংলা সাহিত্যে প্রদোষ শব্দটি সম্ভবত প্রথম শওকত আলীই ব্যবহার করেছেন তাঁর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে। এই প্রদোষ শব্দটি দিয়ে তিনি ঠিক কোন সময়টি বোঝাতে চেয়েছেন তা তাঁর সাহিত্যের সময়কাল বিবেচনা করে সহজেই অনুমান করে নেয়া যায়। প্রদোষ শব্দের অর্থ সন্ধ্যার পূর্বাবস্থা, সূর্যাস্তের কাল, সাঁঝের বেলা বা গোধূলির আলো। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার ঠিক আগের অস্পষ্ট আলো। উপন্যাসটিতে বাঙালীর প্রদোষকালীন সময় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে দ্বাদশ শতকের শেষ পাদে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত সেনবংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালের অন্তিম মুহূর্তটিকে। এই সময়টি মনুষ্য বসবাসের জন্য কোন ঐতিহাসিকই খুব আরামপ্রদ সময় মনে করেন না। এই সময়ের পরেই বাংলায় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির আগমন হয়েছিল। তাঁর আগমনকে সে যুগের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ স্বাগত জানিয়েছিল। বর্তমান ঐতিহাসিকদের অনেকেই সে কথার সাক্ষ্য দিতে কার্পণ্য করেন না। ইতিহাস ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। তাই প্রকৃতি ও ভূগোলের সাথে ইতিহাসের একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। প্রকৃতি হচ্ছে ইতিহাসের ভিত্তি। যুগে যুগে বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ সমকালীন মানুষের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। প্রকৃতি বাংলার ইতিহাসের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলার প্রধান প্রধান নদীগুলো গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে বহু সমৃদ্ধ নগর-বন্দর, রাজধানী ও জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অথবা বিরানভূমিতে হয়েছে পরিণত। নদীর নতুন গতিধারার তীরে নতুন নতুন শহর-বন্দর গড়ে ওঠার তথ্যও কম নেই। এভাবে বাংলার ইতিহাসের গতিধারায়ও পুরনো অধ্যায়ের সমাপ্তি শেষে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন ঘটেছে। যেমন পুন্ড্র নগর, ময়নামতি, দেবপর্বত, বিক্রমপুর ও সোনারগাঁ নগরগুলোর কথা বলা যায়। এসব নগর এক সময় গড়ে উঠেছিল এবং সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। বাংলার একটা বিরাট অংশ এক সময় গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল বলে মনে করা হয়। প্রাচীনকালে সেই সমুদ্রের নাম ছিল আসাম উপসাগর। ভূবিজ্ঞানী ইমুয়েসের মতে গিরিজনি আলোড়নের আঘাতে উত্তর দিকে গতিশীল দাক্ষিণাত্যের উত্তরাংশ অবনমিত হয়। হিমালয় থেকে আসা নদীবাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে এখানে গোলাকার খাতের মতো প্লাবণ সমভূমি গড়ে ওঠে। এটা ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম অবতলভূমি যা বঙ্গখাত হিসেবে পরিচিত ছিল। বঙ্গখাতের উত্তরে শিলং মালভূমি, পশ্চিমে ভারতের সুদৃঢ় ভূমি, পূর্বে নাগালুসাই ভাঁজ পর্বত এবং দক্ষিণ অংশ বঙ্গোপসাগরের গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলা এই বঙ্গোখাতেরই বৃহত্তম অংশ বলে ধারণা করা হয়। বঙ্গখাতের বিভিন্ন জায়গা খুঁড়ে এবং জরিপ করে দেখা গেছে এখানকার সব শিলাই প্রাচীন অথবা নতুন পলল। উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়ী এলাকা বাদে বাকি সম্পূর্ণ অংশ প্লাবণ সমভূমি। প্রায় পঁচিশ কোটি বছর আগে পুরাজীবীয় (পোলিওজোইক) যুগে এখানকার আবহাওয়া আরও উষ্ণ ও আর্দ্র ছিল। তখন এখানে প্রচুর গাছ জন্মে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাণীরও অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা করা যায়। এই সম্পর্কে প্রামাণ্য ঐতিহাসিক কোন তথ্য দৃষ্টিগোচর হয়নি, তাত্ত্বিক বর্ণনায় সীমাবদ্ধ। বাংলা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ যা ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব সন্নিহিত কোণে অবস্থিত। বাংলার উত্তর সীমায় হিমালয়, যার কোল ঘেঁষে নেপালের তাবাই অঞ্চল ও শিলং মালভূমি। দক্ষিণ সীমায় বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি। পূর্বে অবস্থিত ত্রিপুরা, গারো ও লুসাই পর্বতমালা; পশ্চিমে রাজমহল ও ছোট নাগপুরের পার্বত্যভূমি। বাংলার বেশিরভাগ ভূখন্ডই গড়ে উঠেছে নদীবিধৌত পলি দ্বারা। গঙ্গা-ভাগীরথী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদ-নদী এদেশের বুক চিরে প্রবাহিত। এসব নদীর পলি দ্বারা গঠিত সমভূমি অঞ্চলে প্রচুর শস্য উৎপাদিত হয়। এই সমভূমি দক্ষিণ দিকে ক্রমশ ঢালু এবং সাগরের সঙ্গে ক্রমশ মিশে গেছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী নিম্নভূমি মূলত জঙ্গলাকীর্ণ যা সুন্দরবন নামে পরিচিত। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম স্রোতজ বন। বাংলার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ী বনাঞ্চল। বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় দিতে গিয়ে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বলেন, ‘এই প্রাকৃতিক সীমা বিস্তৃত ভূমিখন্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাংলার গৌড়- পুন্ড্র-বরেন্দ্রী-রাঢ়- সুহ্ম, তাম্রলিপি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ, ভাগীরথী-করতোয়া-ব্রহ্মপুত্র পদ্মা-মেঘনা এবং আরও অসংখ্য নদ-নদীবিধৌত বাংলার গ্রাম, নগর, প্রান্তর পাহাড়-কান্ডার। এই ভূখন্ডই ঐতিহাসিক কালের বাঙালীর কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নর্ম ভূমি। একদিকে সুউচ্চ পর্বত, দুই দিকে কঠিন শৈলভূমি আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র, মাঝখানে সমভূমির সাম্য এটিই বাঙালীর ভৌগোলিক ভাগ্য।’ সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক প্রাচীন বঙ্গদেশের সিংহভাগই অর্থাৎ পুন্ড্রবর্ধন, প্রাচীন গৌড়, দক্ষিণবঙ্গ, উৎকল এবং হয়ত বঙ্গেরও বেশ কিছু অঞ্চল তাঁর শাসনাধীনে এনে গৌড় নামে একটি একক রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। হর্ষচরিতে শশাঙ্ককে গৌড়েশ্বর নামে অভিহিত করা হয়েছে, এরপর থেকেই বঙ্গদেশ বলতে প্রধানত তিনটি জনপদকে বোঝানো হতো। এগুলো হলো- পৌন্ড্র্র, গৌড় এবং বঙ্গ। ক্রমবিবর্তনে পৌন্ড্র নামটিও গৌড় ও বঙ্গের মধ্যে একীভূত হয়ে যায়। জনপদ হিসেবে বঙ্গ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দীর্ঘদিন ধরে রাখলেও প্রাচীন বঙ্গদেশ গৌড় দেশ নামে একক সত্তায় বিকশিত হয়েছিল। পুন্ড্র্রু থেকে সমতটবাসীর সবার পরিচিতি ছিল গৌড়বাসী বা গৌড়ীয় হিসেবে। পাল ও সেন নৃপতিগণ সমগ্র বঙ্গদেশে শাসন পরিচালনা করলেও নিজেদের গৌড়েশ্বর ভাবতেই বেশি গর্ববোধ করতেন। এমনকি প্রকৃত গৌড় অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়েও পূর্ববঙ্গে একটি সীমিত অঞ্চলে রাজত্বকারী সেন রাজারা গৌড়েশ্বর উপাধি পরিত্যাগ করেননি। কিন্তু পরবর্তীতে বঙ্গ নামটি গৌড়ের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মুসলিম যুগের প্রারম্ভিক স্তরে অর্থাৎ ইখতিয়ার আল-দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের অব্যবহিত পরে মুসলিম বঙ্গের প্রশাসনিক বিভাগ ছিল- বঙ্গ, রাঢ়, বাগঢ়ী ও বরেন্দ্র (বরিন্দ)। উল্লেখ্য, ‘পুন্ড্র জনপদ’ ক্রমশ শাসনতান্ত্রিক বিভাগে পরিণত হয় এবং এর উত্তরোত্তর সীমা বৃদ্ধির ফলে সম্ভবত গুপ্ত আমলেই এর প্রশাসনিক একক হিসেবে নাম হয় পৌন্ড্র্রবর্ধন। প্রাচীন পুন্ড্র জনপদটি ক্রমে পাল আমল থেকে বরেন্দ্রী নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাল আমলে দশম শতাব্দীতে বরেন্দ্র নামক জনপদের উল্লেখ দেখা যায় কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিতাম নামক কাব্যগ্রন্থে। সেখানে কবি প্রশস্তিতে আছে, বসুধা শিরো বরেন্দ্রীমন্ডল চূড়ামনি : কুল স্থানম। শ্রী পৌন্ড্রবর্ধনপুর প্রতিব : পুণ্য ভব্বহদ্বটু। রামচরিত কাব্যে ও কমৌল তাম্রশাসনে বরেন্দ্রীকে পালদের ‘জনকভু’ অর্থাৎ পিতৃভূমি রূপে অভিহিত করা হয়েছে। সেন ও পাল রাজাদের বিভিন্ন তাম্রশাসন ও উৎকীর্ণ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা থেকে মনে হয় যে, বর্তমান দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনার কিয়দংশ নিয়ে প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি গড়ে উঠেছিল। আর মুসলিম শাসনে এই বরেন্দ্রী মধ্যযুগীয় ‘বরেন্দ্র’ জনপদে পরিণত হয়। তাবাকাত-ই-নাসিরীতেও দেখা যাচ্ছে, এমনকি এয়োদশ শতকেও বাংলার বিভাগ হচ্ছে- রাঢ়, বরেন্দ্র, সনকনাট বা সমতট এবং বঙ্গ। মুদ্রায় উৎকীর্ণ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গ বলতে সমগ্র বঙ্গভাষী অঞ্চল নয় একটি আপেক্ষিক সুনির্দিষ্ট অংশকে বোঝানো হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে বিশেষজ্ঞগণের ধারণা এতদঞ্চলে প্রায় চার হাজার পূর্বেও সংগঠিত মানব বসতি ছিল। বাংলায় সংগঠিত মানব সমাজ ও রাজ্য ব্যবস্থার উদ্ভব উত্তর ভারতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠার পরে হওয়া স্বাভাবিক হলেও বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্যে বঙ্গসহ এতদঞ্চলের উল্লেখ এবং এর অধিবাসীদের প্রতি তার বিদ্বেষ থেকে ধারণা করা অসঙ্গতিপূর্ণ হবে না যে, সমসাময়িককালে বাংলাদেশে সমাজবদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য সভ্যতার অধিকারী মানুষের অধিবাস ছিল এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতায় তাঁদের কাছাকাছি উন্নত পর্যায়ে থাকায় এদের প্রতি তাঁরা শত্রু ভাবাপন্নও ছিল। অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে প্রায় মধ্যযুগ পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ কোন একক নামে পরিচিত ছিল না। এর বিভিন্ন এলাকা ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে সর্বপ্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ দেখা যায়। প্রাচীনকাল থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচীন বঙ্গভূমি বঙ্গ, পুন্ড্র, গৌড় রাঢ়, সুহ্ম, তাম্রলিপ্তি, সমতট প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত ছিল। উক্ত জনপদগুলোর প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দুকে শহর বা নগর উল্লেখ করা যেতে পারে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্ক কর্তৃক জনপদগুলোকে একত্রিত করে গৌড় নাম দেয়া হয়। শশাঙ্কের পর হতে পুন্ড্র, গৌড় ও বঙ্গ এই তিনটি জনপদ মিলিতভাবে বঙ্গ বা বাংলা অঞ্চল হিসেবে মনে করা যায়। প্রাক মুসলিম আমলে মৌর্য ও গুপ্তদের অধীনতা মেনে নিলেও অন্য সময় বাংলা স্বাধীন ছিল। মুসলমান আমলে সমগ্র বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়, যা প্রায় তিন শ’ বছর অক্ষুণ্ণ থাকে। এই স্বাধীনতার যুগগুলোতে বাঙালীর জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হয়েছে। বাংলা দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষের একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল। প্রাকৃতিক কারণেই ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাংলা আলাদা, তবে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। ভারতের হিমালয় পর্বত হতে উৎপন্ন নদ-নদী বাংলার বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তর ভারতের বহু মানুষ এদেশে বসতি স্থাপন করেছে। উত্তর ভারতের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি এদেশকে প্রভাবিত করেছে। এতদসত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে এদেশের স্বতন্ত্র সত্তা বিলীন হয়নি। প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু যেগুলো শহর হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য কয়েকটি বিশেষ উপাদান থাকার কথা জানা যায়, সেগুলো হচ্ছে- প্রশাসক বা অঞ্চল প্রধান ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার অফিস ও তাঁদের বাসভবন, প্রধান সামরিক অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট কার্যালয়, সরকারী আদালত, সরকারী খাজাঞ্চীখানা, টাকশাল প্রভৃতি। এ ধরনের শহর বা নগর অন্তত তিন হাজার বছর অথবা তারও পূর্বে প্রাচীন বাংলায় গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলায় প্রাপ্ত নগরের কেন্দ্রবিন্দু ব্যতিরেকে যে পরিসীমার ব্যাপ্তি এবং সাধারণত সমকালীন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা যেখানে অনুপস্থিত, এ ধরনের অঞ্চলগুলোকে গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। নিম্নে প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ ও নগর জীবনের একটি চিত্র তুলে ধরার প্রয়াশ চালানো হলো। প্রদোষকালে বাংলার গ্রামীণ জীবন ছিল একান্তই কৃষিভিত্তিক। এ সময়ের বাংলার গ্রামগুলো ছিল কৃষিনির্ভর এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পনির্ভর। এগুলোর সংখ্যা খুব বেশি ছিল না এবং আয়তনেও এগুলো ছিল ছোট। কৃষিজীবী গ্রামীণ মানুষের চাহিদাও অনেক কম ছিল। এদের উৎপাদনের জন্য সুপ্রচুর ভূমি থাকলেও খুব বেশি প্রয়োজন গ্রামবাসীর ছিল না। পক্ষান্তরে শহরের প্রয়োজন মেটাবার মতো সাধারণত সুবিশাল আয়তনের কৃষিক্ষেত্র থাকে না। প্রদোষকালীন বাংলায় শহরের আওতার বাইরে বৃহত্তর জনপদবিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র ছিল। সেই কৃষিক্ষেত্রকে আশ্রয় করে গ্রামীণ মানুষদের নিকটেই বসতি গড়ে নিতে হতো। এগুলোই গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত হতো। তাই কৃষিনির্ভর সভ্যতাকে গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। কৃষিকর্মের জন্য প্রধান ও প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে পানি। প্রদোষকালে বাংলায় দেখা গেছে যেখানে নদী-নালা, খাল-বিল অর্থাৎ পানি সহজলভ্য সেখানেই সমৃদ্ধ গ্রাম গড়ে উঠেছে। এই কারণেই কৃষি সভ্যতার বিকাশ হয়েছে নদী-নালা, খাল-বিল অর্থাৎ পানিকে আশ্রয় করে। শহরবাসী-গ্রামবাসী সকলের জন্যই পানির প্রয়োজন। গ্রামবাসীর জন্য পানি যেভাবে প্রয়োজন শহরবাসীর জন্য পানির প্রয়োজন তা থেকে ভিন্ন রকমের। তা ছাড়া শহরবাসীর ক্ষেত্রে পানি সংগ্রহের বিকল্প অনেক পদ্ধতি থাকা যতটা সহজ গ্রামবাসীর ক্ষেত্রে ততটা নয়। যেমন কূপ খনন করে এ সময়ের মানুষ শহরে খুব সহজেই পানি সংগ্রহ করতে পারত যা গ্রামে সহজে সম্ভব হতো না। সকল শহর একই ধরনের ছিল না। শহর প্রতিষ্ঠার কোন একটি মাত্র চিহ্নিত কারণও ছিল না। প্রাচীনকালে বাংলার নগরকেন্দ্রিক শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বাংলায়ও শহর গড়ে উঠেছিল প্রদোষকালেও তা অব্যাহত ছিল। বাংলায় সংশ্লিষ্ট নগরের রাজ কর্মচারীরা এই শহরে বাস করতেন। রাজকার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ সেখানে যাওয়া-আসা করতেন। এসব বসতি ও যাতায়াতের পথকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল হাটবাজার। যাতায়াত, গমণ-নির্গমন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য এসব শহর-নগর ও নদীকে কেন্দ্র করেই সাধারণত গড়ে উঠেছিল। আর শহর-নগরকে কেন্দ্র করে যে হাটবাজার গড়ে উঠেছিল তা সাধারণত এসব নদীর তীরে অথবা যাতায়াতের সুপ্রশস্ত রাজপথের পাশে কিংবা উভয় সুবিধাসংবলিত স্থানে। এ প্রসঙ্গে রাজা-মহারাজাদের রাজধানী এবং জয়স্কন্দাবারের দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। এগুলো গড়ে উঠেছিল নদী অথবা রাজপথকে উপলক্ষ করে। সৈন্য পরিচালনা এবং সামরিক কার্যক্রমও শহরে পরিচালিত হতো। এ ছাড়াও এক ধরনের শহরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনে। বিশেষ করে নৌ শিল্প, বস্ত্র শিল্প, এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এ ধরনের শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য হয় প্রশস্ত স্থলপথের প্রয়োজন অথবা জলপথ বা উভয় পথ। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে উভয় পথের (জল ও স্থল পথের) সঙ্গমস্থলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা থাকায় সেখানেও হাটবাজার এমনকি শহর-নগর গড়ে উঠেছে। প্রাচীন বাংলার শহরগুলো সাধারণত এভাবেই গড়ে উঠেছিল। প্রদোষকালেও সেগুলো সে ধরনেরই ছিল হয়ত কিছুটা উন্নত হয়েছিল। কখনও কখনও সমুদ্রকে কেন্দ্র করেও শহর-নগর গড়ে উঠেছিল। এ ছাড়াও তীর্থস্থান, বৃহৎ শিক্ষাকেন্দ্র বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র ইত্যাদিকে উপলক্ষ করেও শহর বা নগরের পত্তন হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যেমন শহর বিজড়িত, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা শিল্পের উন্নতি অবনতির ওপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট শহরের উন্নতি অবনতি। অনুরূপ কৃষিকে কেন্দ্র করে যেহেতু গ্রামের উন্নতি অবনতি তাই কৃষির ওপরই গ্রামের উন্নতি অবনতি নির্ভর করত। কারণ গ্রামসভ্যতা হচ্ছে কৃষিনির্ভর অপরদিকে নগর সভ্যতা হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যনির্ভর। প্রদোষকালে বাংলার গ্রাম ও নগর সভ্যতায় আকৃতিগত পার্থক্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রকৃতিগত পার্থক্য। সে সময়ে যারা গ্রামে বাস করত তারা সাধারণত কৃষিনির্ভর ভূম্যধিকারী, কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকের সংখ্যাই প্রধান। এদের জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা, কামনা-বাসনা, ধ্যান-ধারণা সমস্ত কিছুই ছিল কৃষি ও এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলীকে আশ্রয় করে। পক্ষান্তরে নগরবাসীর অধিকাংশই ছিল সামন্তশ্রেণী, রাজ কর্মচারী, শিল্পী, ব্যবসায়ী-বণিক বা সওদাগর প্রভৃতি। উপরোক্ত নগরবাসীর দৈনন্দিন প্রভূতকর্মে প্রয়োজন হতো শ্রমিকদের। সুতরাং এ ধরনের শ্রমিকও নগরে বসবাস করতে হতো। গ্রামে উৎপাদিত দ্রব্যাদি, কৃষিজাত বা শিল্পদ্রব্য ইত্যাদি ক্রয় বিক্রয়ের জন্য শহরে আনা হতো। সুতরাং শহর বা নগর একদিকে যেমন শাসনকেন্দ্র ছিল তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রও ছিল শহর। ফলে সামগ্রিক কারণেই শহরের অধিবাসীরা গ্রামের অধিবাসীদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ও সুখ করতে পারত। প্রাচীন এবং তৎপরবর্তী প্রদোষকালের বাংলায় অসংখ্য গ্রামের নাম পাওয়া যায়। এ সমস্ত গ্রামের আয়তন বা লোকসংখ্যা সমান ছিল না। ছোট ছোট গ্রামকে বলা হতো বাটক বা পাটক বা পাড়া। প্রাচীন লিপিমালার বৈগ্রাম পাট্টোলীতে বায়িগ্রামের দুটি ভাগ ছিল যার একটির নাম ছিল ত্রিবৃতা ও অন্যটি ছিল শ্রীগোহলী। এ ছাড়াও মলসারুল লিপিতে নিবৃত-বাটক, কপিস্থ-বাটক, শাল্মলী-বাটক, মধু-বাটক ইত্যাদি নামেও কয়েকটি গ্রাম বা পাড়া পাওয়া যায়। গ্রামের মধ্যেও কম গুরুত্বপূর্ণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতো গ্রামের অবস্থান ও সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে। যে সকল গ্রামের অবস্থান জলাভূমি ও স্থলপথের ওপর, লোকালয় ও কৃষিজ ভূমি যেখানে সহজপ্রাপ্য ও প্রচুর কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ যেখানে রয়েছে, শিল্পোৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে অথবা শাসনকার্য পরিচালনার কোন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত থাকত এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি বা ধর্মকর্মের কেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিতি পেত এই সমস্ত গ্রামগুলোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেত। এসব গ্রামে লোকসংখ্যা বেশি থাকত, আয়তন বেড়ে যেত এবং মর্যাদার দিক দিয়েও এই সকল সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের চেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে পরিগণিত হতো। এই রকম কিছু কিছু গ্রামের খবর লিপিমালা ও সমসাময়িক সাহিত্যে পাওয়া যায়। বলাল সেনের নৈহাটি লিপিতে দেখা যায়, বালহিটঠা একটি এ রকম বৃহৎ গ্রাম। এটি ছিল বর্ধমানভুক্তির উত্তরাঢ় ম-লের স্বল্প দক্ষিণবীথির অন্তর্ভুক্ত। লক্ষণসেনের গোবিন্দপুর লিপিতে বর্ধমানভুক্তির পশ্চিম খাটিকার অন্তর্ভুক্ত বেতট্টচতুরকের অন্তর্গত বিড্ডারশাসন গ্রাম। লক্ষ্মণসেনেরই তর্পণদীঘিলিপিতে উল্লিখিত অন্য গ্রামটি হচ্ছে বিক্রমপুরের অন্তর্গত বেলহিষ্ঠী গ্রাম। এই তিনটি গ্রাম বিভিন্ন আয়তনের এবং বিভিন্ন বিশেষণবিজড়িত। এভাবে দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন বাংলার এই গ্রামগুলোতে ঊষরভূমি, মালভূমি, গর্ত, গোচারণভূমি, খাল-বিল, পুষ্করিণী, নদী, নদীর খাত ইত্যাদি রয়েছে। এ গ্রামগুলোর মানুষ বন-জঙ্গল হতে জ্বালানি কাঠ, ঘরবাড়ি নির্মাণ করার জন্য বাঁশ, খুঁটি ইত্যাদি সংগ্রহ করত। আগেই বলেছি প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ সমাজ কৃষিপ্রধান সমাজ। প্রদোষকালেও তাই। গ্রামকে কেন্দ্র করে বিশেষ বিশেষ শিল্পীরা বসবাস করত। বাঁশ ও বেতের শিল্প, কাষ্ঠশিল্প, মৃৎ শিল্প, কার্পাস ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্প, লৌহ শিল্প ইত্যাদির কেন্দ্রও গ্রামে ছিল বলে অনুমান করা যায়। কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বেতের নানা প্রকার পাত্র, ঘরবাড়ি, নৌকা, মাটি নির্মিত হাঁড়িপাতিল, লোহার দা-কুড়াল, কোদাল, লাঙ্গলের ফলা, খন্তা ইত্যাদি নিত্য ব্যবহার্য কৃষি যন্ত্রাদির প্রয়োজন ছিল গ্রামে। কার্পাস ফুল ও বিচি, তাঁত, তুলা, তুলাধুনো ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রামেই বেশি ছিল যা সহজেই ধারণা করা যায়। সুতাকাটা দরিদ্র ব্রাহ্মণ গৃহস্থবাড়ির মেয়েদেরও কর্ম ছিল। তাঁরা কাপড় বুনত। গোবিন্দকেশবের লিপি হতে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় কাঁসারি শিল্প ও হাতির দাঁতের শিল্প গ্রামে বেশ চালু ছিল। এই সকল কার্যক্রমের সূত্রে কোন কোন ব্যবসায়ীরাও গ্রামে বসবাস করতেন। তাঁরা শহরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে মধ্যসত্তার দায়িত্ব পালন করতেন। গ্রামে বসবাসকারী প্রধান প্রধান পেশাজীবী ও শ্রেণীর মধ্যে ছিল ব্রাহ্মহ্মণ, ভূমির মালিকগণ, ক্ষেত্রকর, ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক, কর্মকার, কুম্ভকার, মালাকার, চিত্রকর, তৈলকার, সূত্রধর প্রভৃতি শিল্পীরা। এ ছাড়া কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং গোপ, নাপিত, রজক, নর্তক-নর্তকী ইত্যাদি এবং এ ছাড়াও নিম্নশ্রেণীর মানুষ। কৃষিপ্রধান প্রাচীন ও প্রদোষকালীন সভ্যতা এবং সংস্কৃতি যেমন বাংলার গ্রামীণ জীবনকে প্রভাবিত করেছে তেমনি নাগরিক সভ্যতাকেও করেছে চাকচিক্য ও বৈচিত্র্যময়। গ্রামীণ সমাজ বহুলাংশে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিবাসীদের দানকে স্বীকার করে অপরপক্ষে নাগরিক সভ্যতায় দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষের অবদান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলার নগর ও নাগরিক সভ্যতার কয়েকটি দিক আলোচিত হলো। গ্রামপ্রধান হলেও বাংলায় নগর জীবনের গুরুত্বও কম নয়। প্রাচীন বাংলায় শহর বা নগর হিসেবে পুন্ড্র-মহাস্থান, কোটীবর্ষ-দেবকোট, তাম্রলিপ্তি প্রভৃতি নগর ভারত উপমহাদেশে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। সমসাময়িক লিপিমালায় এবং সাহিত্যে বাংলার অনেক নগরের উল্লেখ এবং বিবরণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের খননকার্য এবং বাংলায় প্রাপ্ত স্থাপত্য, পোড়া মাটির ফলক ইত্যাদি থেকেও কোন কোন নগরের অবস্থিতি ও বিন্যাস সম্বন্ধে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। গ্রাম ও শহরের পার্থক্য পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতোই বাংলায়ও লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত দেখা যায় গ্রামগুলো প্রধানত ভূমি ও কৃষিনির্ভর, কিন্তু নগর নানা প্রয়োজনে গড়ে ওঠে এবং শহরের অর্থনৈতিক নির্ভরতায় কৃষি কিছুটা ভূমিকা রাখলেও শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিই নগর বা শহরের প্রধান নির্ভরতা। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। বাংলার শহর গড়ে উঠেছে নানা প্রয়োজনে। কোথাও একটিমাত্র কোথাও একাধিক প্রয়োজন। সাধারণত বড় বড় শহরগুলো নানারূপ প্রয়োজনে বড় শহরে পরিণত হয়েছে। যেমন পুন্ড্র্র বা পুন্ড্র্রবর্ধনের মতো শহরের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এই শহরের পাদদেশে করতোয়া নদী এবং নদী তীরবর্তী একটি প্রখ্যাত তীর্থ ছিল। এ ছাড়া আবহমানকাল ধরে এই শহর বৃহৎ এক রাজ্য ও জনপদ বিভাগের রাজধানী ও প্রধান শাসনকেন্দ্র ছিল। এ শহর সর্বভারতীয় এবং আন্তঃদেশিক বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল যেখানে একাধিক স্থলপথ এবং প্রশস্ত করতোয়ার জলপথ এই কেন্দ্রে মিলিত হতো। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একাধিক কারণেই গড়ে উঠেছে পুন্ড্র বা পুন্ড্রবর্ধন। তাম্রলিপ্তিও একাধিক প্রয়োজনেই গড়ে উঠেছে। প্রথমত তাম্রলিপ্তি ভারতের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ সামুদ্রিক বন্দর যার একদিকে সমুদ্রপথ এবং অন্যদিকে ভাগীরথীর জলপথের এবং অন্যদিকে আন্তঃভারতীয় ও আন্তঃদেশিক স্থলপথের কেন্দ্র ছিল এই শহর। এই কারণেই তাম্রলিপ্তি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাণিজ্যের বৃহত্তম কেন্দ্র হিসেবে ভারতে এমনকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্থান লাভ করেছিল। তাম্রলিপ্তি প্রখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ এখানে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। তাম্রলিপ্তি রাষ্ট্রীয় শাসনকেন্দ্র হিসেবে যত পরিচিত তার চেয়ে বেশি পরিচিত বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে। কোটীবর্ষ শাসনকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। কয়েকটি কারণে স্থানটি শহর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। স্থানটির ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব ছিল বলে মনে হয়। ফলে সামরিকভাবে এর গুরুত্বও অপরিহার্য ছিল। সম্ভবত এই কারণেই স্থানটি বহুকাল ধরে শাসনকেন্দ্র হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। পরবর্তীতে দেবীকোট, দেওকোট, দেবকোট ইত্যাদি নামে সুপরিচিত হয়েছে। বিক্রমপুর শহর শুধু শাসনকেন্দ্র হিসেবে নয় সামরিক কারণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে গড়ে ওঠার কারণ সেন শাসনামলের একাধিক রাজার শাসনকালে এখানে জয়স্কান্দাবার প্রতিষ্ঠিত ছিল। লক্ষ্মণসেনের পরাজয় এবং ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজির লাখণাবতী অধিকারের পর এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তা ছাড়া শহরটির পাদদেশে একাধিক নদ-নদী এবং নৌ যাতায়াত পথ থাকায় এর বাণিজ্যিক গুরুত্বও ছিল বেশি। এ ছাড়াও নবম শতক হতে বৌদ্ধ ব্রাহ্মহ্মণ্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটি বড় কেন্দ্র ছিল এখানে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বা সামরিক প্রয়োজনে, কিংবা শুধু ধর্মকেন্দ্র হিসেবেও একাধিক শহর প্রাচীন বাংলায় গড়ে উঠেছিল। সেন রাজাদের প্রতিষ্ঠিত শহর রামপাল, রামাবতী, লাখণাবতী, শশাঙ্ক ও জয়নাগের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ প্রভৃতি শহর প্রধান রাষ্ট্রীয় ও সামরিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। সোমপুর (বর্তমান পাহাড়পুর) ত্রিবেণী প্রভৃতি শহর গড়ে ওঠেছিল ধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে। তবে এ কথা সর্বজন স্বীকার্য যে, শহরগুলো যে প্রয়োজন ও কারণেই গড়ে উঠুক না কেন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রেরণা ছিল সর্বত্রই। প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক অবস্থিত বিশেষণ করলে দেখা যায় প্রত্যেকটি শহর প্রশস্ত ও প্রচলিত স্থল ও জলপথের ওপর বা সংযোগকেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। প্রাচীন বাংলার শহরে বসবাসকারী যাঁরা ছিলেন তাঁদের সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। যে সব শহর প্রধানত রাষ্ট্রীয় বা সামরিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছিল এবং যেখানে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেখানে সাধারণত রাষ্ট্রীয় ও সামরিক কর্মচারী যাঁরা চাকরিজীবী তাঁরা বাস করতেন। এই ধরনের শহরের অধিবাসী ছিলেন রাজা, মহারাজা, সৈন্য-সামন্ত। তীর্থস্থান বা শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে যে সব নগর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও শিক্ষার গুরু, আচার্য, পুরোহিত প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বৃত্তিধারী লোকেরা, তাঁদের শিষ্য, ছাত্র প্রমুখরাও বসবাস করতেন। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মহ্মবৈবর্তপুরাণে যে সব শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের তালিকা আছে তাঁদের মধ্যে কর্মকার, কাংসকার, শাঙ্খিক-শঙ্খাকার, মালাকার, তক্ষক-সূত্রধার, শেন্ডিক, তন্তুবায়-কুবিন্দক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের অনেকেই শহরে বাস করতেন বলে মনে হয়। স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, অট্টালিকাকার, কোটক, অন্যান্য ছোট-বড় শিল্পী ও বণিকেরা একান্তই শহরে বাস করতেন বলে ধারণা। এরা ছাড়াও এদের সেবার জন্য রজক, নাপিত, গোপ প্রভৃতির মতো সমাজসেবকও শহরে বাস করত বলে অনুমান করা যেতে পারে। নিম্ন শ্রেণীর ও অন্ত্যজ পর্যায়ের কিছু সমাজশ্রমিকও শহরে বাস করত। যেমন ডোম, চন্ডাল, ভোলাবাহী, চর্মকার, কশাই ইত্যাদি। তবে এরা সাধারণত শহরের বাইরে বা উপকণ্ঠে বাস করত। চর্যাগীতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘ডোম্বীর কুড়িয়া’ নগরের বাইরে। এসব সমাজসেবক ও সমাজশ্রমিকেরা নগরবাসী বটে কিন্তু যথাযথভাবে এরা নাগরিক মর্যাদার অধিকারী ছিল না। তৎকালে নাগরিক বলা হতো প্রধানত শ্রেষ্ঠী, শিল্পী, বণিক, নগরবাসী রাজা ও মহারাজা সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিত্তবান ব্রাহ্মণদের। এরাই ছিলেন শহরের প্রধান হর্তাকর্তা ব্যক্তি। শহর ছিল তৎকালে সম্পদ বণ্টনের প্রধান কেন্দ্র। সপ্তম-অষ্টম শতকে দেখা গেছে বাংলার সামাজিক সম্পদ এবং ঐশ্বর্য, বিলাসিতা, আড়ম্বরিতার কেন্দ্রস্থল ছিল শহর। এমনকি গ্রাম কৃষি ও গৃহশিল্প সম্পদ উৎপাদনের উৎস হলেও নগরগুলোই ছিল মূলত ঐশ্বর্য বিলাসিতার মূল পাদপীঠ। রামচরিত, পবনদূত প্রভৃতি কাব্য, সদুক্তিকর্নামৃতধৃত বিচ্ছিন্ন শোকাবলি এবং সমসাময়িক লিপিগুলো বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায় যে, গ্রাম ও নগরের প্রধান পার্থক্য ছিল সম্পদ ও ঐশ্বর্যের তারতম্য দ্বারা রচিত। তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎসায়ন হতে আরম্ভ করে একাদশ-দ্বাদশ শতকের প্রদোষকালে কাব্য ও প্রশস্তিগুলোতে সর্বত্র শহরে ছিল শ্রেণিবদ্ধ প্রাসাদ, নর-নারীর প্রসাধন ও অলংকারের প্রাচুর্য, বারাঙ্গনাদের উৎপাত, নানা প্রকার বিলাসী উপকরণ এবং ঐশ্বর্যের নানা সামগ্রী পক্ষান্তরে পাশাপাশি গ্রামবাসীদের সহজ-সরল দৈনন্দিন জীবন-যাপন, কখনো দারিদ্রের সকরুণ জরাজীর্ণ চিত্র। অথচ, এইসব চিত্র যে যুগের সেই যুগে গ্রামের কৃষি এবং গ্রামীণ গৃহশিল্পলব্ধ সম্পদই ছিল প্রধানত সামাজিক সম্পদ। মূলত সম্পদের প্রধান অংশ গ্রামীণ উৎপাদিত হলেও ভোগের অধিকার তাদের ছিল না বললেই চলে। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বাংলার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ভেতরে ভেতরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল। সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ এ সময় বাংলার শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এই বিরোধ তাদের মধ্যে অবিশ্বাস, ঘৃণা এবং অপমানের ধোঁয়া বাংলার সমাজ জীবনকে ঘোলাটে করে তুলেছিল। শাসক ও ব্রাহ্মণ শ্রেণীর অপরিমেয় ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সমাজে নানা কদাচার ও নৈতিক অধঃপতন বলা যায় তাদের নেতৃত্বেই হয়েছিল। সামাজিক গোঁড়ামি, ঐশ্বর্য বিলাস এবং কামনা বাসনার প্রতি অতি উৎসাহী সে সময়ের কাব্য সাহিত্যকে জরাক্রান্ত করে তুলেছিল। সে সময়ের অধিকাংশ কবিতা গুলোতেই যৌন কামনায় মদির এবং মধুর; রাজসভার চরিত্র ও আবহাওয়া চূড়ান্ত লাম্পট্য, চারিত্রিক অবনতি, তরল রুচি ও দেহগত বিলাস এবং ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত দুর্নীতির কলঙ্কে মলিন। আর অন্যদিকে নিদারুন দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব, পীড়ন, শোষণ, বর্জন, যন্ত্রণা ও মৃত্যু বাংলার আকাশকে তখন দুর্বিষহ করে তুলেছে। অধ্যাপক অতীন্দ্র মজুমদার তাঁর প্রবন্ধে এই অবস্থাকে তুরে ধরেছেন এভাবে। এই নিñিদ্র সর্বব্যাপী সুগভীর অন্ধকারের বেড়াজালে চর্যাপদের সমকালীন বাংলাদেশ অসহ্য আত্ম সন্তুষ্টি, দুর্বল আত্মশক্তি এবং দুরপনেয় চারিত্রিক কলঙ্কের ক্রমবর্ধমান অভিশাপে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে কোথাও তার আশা নেই, নিপীড়নের যন্ত্রণা প্রকাশের নেই ভাষা, মানব বসে নেই ক্ষীণতম বিশ্বাস। সমস্ত বাংলাদেশই যেন বই অন্ধকারের সুকঠোর পেষণে মৃত্যু যন্ত্রণার অভাব দৈন্যপীড়িত পার্বতীর মতো করুণকণ্ঠে ক্রন্দন করছে। নীহারবঞ্জন রায় তাঁর বাঙালীর ইতিহাসগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ‘একটা বৃহৎ গভীর ব্যাপক সামাজিক বিপ্লবের ভূমি পড়েই ছিল। কিন্তু কেউ তার সুযোগ গ্রহণ করেনি। মুসলমানরা না আসলে কিভাবে কী উপায়ে কী হতো বলার উপায় নেই।’ এমনই এক প্রেক্ষাপটে তুর্কী সৈনিক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলায় আগমণ করেন এবং বাংলা বিজয় করেন। আর মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয় দীর্ঘ পাল ও সেন শাসনের কুশাসন ও সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে। নীহার রঞ্জন রায় বলেছেন, বখতিয়ারের নবদ্বীপ বিজয় এবং একশ’ বছরের মধ্যে সারা বাংলাদেশ জুড়ে মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা মোটেই আকশ্মিক ঘটনা নয় সেন আমলে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতিরই পরিণাম।’ আর এর মাধ্যমেই বাংলায় শান্তির সকালের আগমন ঘটেছিল বলেই সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকদের অভিমত। এ সময়কালকে বাংলার প্রদোষকাল হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের শক্তিমান কথাশিল্পী শওকত আলী তাঁর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের ঘটনা পরিক্রমণ করেছেন। পৌন্ড্র-বরেন্দ্র, গৌড়-কর্ণসুবর্ণ, রাঢ়-সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি, বঙ্গ-সমতট হরিকেল- এই সব জনপদ সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল অতীতের বঙ্গভূমি। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলায় আগমনের পথ ধরে পরবর্তীতে শক্তিমান মুসলিম শাসকদের আগমনে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিচিতি সমৃদ্ধ হয়। ধীরে ধীরে বাংলা সমৃদ্ধ অঞ্চলের মর্যাদা পায়। বাঙালীরা একটি সুসভ্য জাতি হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত হয়। সমস্ত বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র জনপদ ইলিয়াস শাহী আমলে বাঙ্গালা নাম ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় মুঘল আমলে আকবরের শাসনামলে প্রাচীন গৌড়বঙ্গ দেশ পরিণত হল সুবে বাঙ্গালা নামে মুঘল সাম্রাজ্যের একটি একক প্রশাসনিক সত্তায়। আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাঙ্গালা বা বাঙালী শব্দের উৎপত্তির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা হলো-প্রাচীন বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আল শব্দ যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে বঙ্গাল, বা বাঙ্গালা এবং বাঙালী; এখন আমরা বাঙালী লিখি। এ বিষয়ে সুকুমার সেনের অভিমত হলো প্রথমে বঙ্গ থেকে বাঙ্গালা বা বাঙ্গালাহর নাম সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম শাসনামলে, অতঃপর পারসিক বঙ্গালহ উচ্চারণ থেকে পর্তুগীজরা বানিয়েছে ‘বেঙ্গলা’ এবং ইংরেজদের মুখে বঙ্গ পরিণত হয়েছে বেঙ্গল-এ। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে আজ তা বাংলা। ১৯৭১ খিস্টাব্দে এর একটি অংশ স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়ে আজ তা বাংলাদেশ। চতুর্দিকে সবুজ রঙের মধ্যে লালবৃত্ত সূর্যের আকৃতির পতাকায় দেশটির নাম যুগে যুগে এভাবেই বিকশিত হয়েছে।
×