ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবাসিক হলের কক্ষ ॥ হাজারো আনন্দ-বেদনার সাক্ষী

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৩ নভেম্বর ২০১৯

আবাসিক হলের কক্ষ ॥ হাজারো আনন্দ-বেদনার সাক্ষী

অনেকেই ভাববেন রুমের জন্য মায়া হয় নাকি! মানুষের জন্য মানুষের মায়া হতে পারে বা কোন পোষ্য প্রাণীর জন্য মায়া হতে পারে তবে রুমের জন্য কারও মায়া হয়েছে এটি মনে হয় বেশিরভাগ মানুষের অজানা। তবে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আবাসিক হলে অবস্থান করছেন বা দীর্ঘদিন হলে থেকেছেন কেবল তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন রুমের জন্যও মনে এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে। এমন অনেকেই আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। তারা কোন এক অবসরে কিংবা সমাবর্তনে ঘুরতে আসে সেই চিরচেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসে এসেছে আর তাদের সেই হলের রুমটিতে প্রবেশ না করেই চলে গেছে এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন এমন অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। বলতে শুনেছি এই হলের এই কক্ষে আমি ছিলাম। আজ থেকে পনেরো বা বিশ বছর আগে। আমি অমুক বিভাগে এত তম শিক্ষার্থী ছিলাম। তারা বলে বিশ^বিদ্যালয়ে ঘুরতে আসছি তাই ভাবলাম আমার রুমটা এক পলক দেখে যাই। কেমন আছে রুমটা আর কে কে বা আছে। এমনই এক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমি থাকি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের ১২৯ নম্বর রুমে। সেদিন রুমেই রান্না হয়েছিল, আমরা তখন খাচ্ছিলাম। এমন সময় একজন দরজা নক করছে আর বলছে ‘ভেতরে কেউ আছেন নাকি, ভেতরে কেউ আছেন? আমি সায় দিলাম। ‘হুম, কে আপনি? ভেতরে (রুমের) আসেন।’ লোকটি আসল। ভাই, ‘আপনারা কেমন আছেন?’ জি, ভাল, তবে আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। ‘ও হ্যাঁ, আমি রফিক (ছদ্মনাম), এই রুমেই ছিলাম দশ বছর আগে। এখন দিনাজপুরে ডিসির দায়িত্বে আছি। আমি এখানে দর্শনে পড়তাম।’ ও আচ্ছা। ‘আমাদের এ্যালামনাই হচ্ছে তো তাই ভাবলাম একটু দেখে যাই রুমটা। অনেক দিন দেখিনি।’ এমন আর একটি ঘটনার কথা শুনেছি আমার বিশ^বিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মোঃ হাবিবুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা ছেলেদের হলে আসতে পারত। সেই সুবাদে প্রেমিকারাও তাদের প্রেমিকদের রুমে আসত। যেখানে তাদের অনেক রোমান্টিক ঘটনাও ঘটত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে এক গণমাধ্যমে খবর এসেছিল- এক বড় ভাই আমির আলী হলে ছিল। সে প্রেম করত এক ছোট বোনের সঙ্গে। তারপর তারা বিয়ে করে সংসার করেছেন। অনেকদিন সংসার করার পর কোন এক কারনে তার স্বামী মারা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি তার সাত-আট বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন। স্বভাবতই তার ওই রুমটার কথা মনে পড়ে যায়। যে রুমে তিনি তার প্রেমিকের সঙ্গে অনেক সময় ব্যয় করেছেন। তাই তিনি তার বাচ্চাকে নিয়ে ওই হলের রুমে যান এবং রুমের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। সে সময় ওই শিক্ষার্থীদের ভাত খাওয়া প্রায় শেষ। তিনি দেখেন সেখানে মাটিতে কিছু ভাত পড়ে আছে। তখন তিনি কয়েকটা ভাত মাটি থেকে তুলে তার বাচ্চাকে খাইয়ে দেয় আর বলে যে, এই রুমে তোমার বাবা আমাকে অনেকবার এভাবে খাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ তোমার বাবা নেই।’ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দীর্ঘ ৪ বছর আবাসিক হলে থাকার সুযোগ হয়েছে আমার। প্রথম যখন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি; তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলে উঠেছিলাম দূর সম্পর্কের এক বড় ভাইয়ের কাছে। তার নাম লাইলাক মেহনাজ (ছদ্মনাম) সেখানে আমার মতো অনেকেই ভর্তিচ্ছু পরীক্ষা দিতে আমাদের ওই রুমে থেকেছেন। প্রথম দিন থাকাতে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি। তবে পরের দিন রুমে একটু ভর্তিচ্ছু সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রুমের আবাসিক ভাইয়েরা আমাদের কোন কোন ভর্তিচ্ছুকে অন্যরুমে যাওয়ার জন্য বলে। তবে আমরা আর ওই রুম ছাড়তে নারাজ। আমাদের যেন রুমটি মনে গেঁথে গেছে। অন্য রুমে একদম যেতে মন চাচ্ছে না। তার পরও একজনকে এক রকম জোর করেই অন্য রুমে দিয়ে আসল এক বড় দাদা। পরক্ষণেই সেখানে আরও তিনজন ভর্তিচ্ছু আসল দেশের অন্য এক প্রান্ত থেকে। ফলে সেখানে জায়গার সঙ্কুুলান আরও দেখা দিল। যার দরুন কাউকে অন্য রুমে স্থানান্তর হতে হবে বাধ্যতামূলক। রুমের এক বড় ভাই আসলেন, ‘তোমাদের মধ্যে তিনজনকে অন্য রুমে যেতে হবে এখানে তো এতজন থাকতে পারব না। তবে কারা যেতে চাও।’ যারা দুইদিন বা একদিন থেকে অবস্থান করছেন তারা কোনভাবেই যেতে রাজি হলো না। তাই এক ভাই বলেই ফেললেন, ‘যারা কয়েকদিন রুমে আছে তাদের তো অন্য রুমে যেতে মন চাইবে না। যারা নতুন আছে তাদের অন্য রুমে দিয়ে এসো।’ আমিও একজন পুরনো ভর্তিচ্ছু কারণ আমি দুইদিন থেকে ওই রুমে অবস্থান করে আছি। আমাকেও যেন অন্য রুমে যেতে মন চাইছে না। মনে মনে শুধু ভাবছি এই রুমে মাত্র দুই দিন অবস্থান করেছি তাতেই রুমের মায়ায় পড়তে হলো। কি ব্যাপার-বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে কি তাহলে সত্যিই মায়া আছে নাকি! কেন এত খারাপ লাগে? তবে সত্যি সত্যিই খারাপ লাগে তা ভাল করেই বুঝলাম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এক আবাসিক হলে উঠলাম। তখনই বুঝেছি যে, হলে এক রুমে থাকলে আর অন্য রুমে যেতে মন সায় দেয় না। রাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠন তাদের দলীয় সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য এবং হলে ‘পলিটিক্যালব্লক’ করার জন্য হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের অন্য রুমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানেও দেখেছি যে, মায়ার বন্ধন ত্যাগ করে কেউ নিজের রুম ছেড়ে চলে যেতে চায় না অন্য কোনরুমে। যারা রুম ছেড়ে যেতে চায় না বা যাদের অন্য রুমে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল তাদের অনেককেই জিজ্ঞাস করেছিলাম- ‘আপনারা কেন রুম ছেড়ে যেতে চান না। আপনাদের তো হলে থাকলেই হলো। একটি রুম হলেই হলো।’ তাদের মুখে যেন একটাই কথা হলে প্রথম যে রুমে ওঠা হয় সেই রুমের জন্য অনেক মায়া কাজ করে। একটি রুমে একদিন থাকলেই সেই রুমের জন্য ওই শিক্ষার্থীর মনে রুমটির মায়া মনে গেঁথে যায়। আর বড় কথা হলো যে, একটি রুমে নতুন গেলে সেখানে সংযুক্ত হতে অনেক সময় লাগে। যার জন্য সহজেই কেউ রুম ছাড়তে চায় না। এমনই বিভিন্ন ছাত্রের কাছে তাদের প্রথম রুমের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। যারা তাদের প্রথম রুম ছাড়ার কষ্টের কথা শেয়ার করেছেন। এক রুমে বিশ^বিদ্যালয় জীবন শেষ করতেই যেন তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এক রুমে থেকেই শেষ করতে চান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবন। আর তাই মায়ার টানেপোড়েন তাদের সেই প্রথম রুমের। রুমের জন্য যেন তাদের অগাধ ভালবাসা। এ ভালবাসা কখনও ভুলবার নয়।
×