ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের সরকারী কলেজের আবাসিক হলে থাকেন না সুপাররা

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২০ অক্টোবর ২০১৯

বরিশালের সরকারী কলেজের আবাসিক হলে থাকেন না সুপাররা

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলো। কম খরচে থাকার সুযোগের পাশাপাশি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদের হোস্টেলজীবনই বেঁছে নিতে হয়। তবে সম্প্রতি সময়ে সেই জীবনটাই নানাভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে বরিশালের সরকারী কলেজগুলোর সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল সরকারী ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সৈয়দ হাতেম আলী সরকারী কলেজ, বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ অন্য কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য ২০ হোস্টেল রয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ হোস্টেলই পুরনো হওয়ায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তার ওপর ক্যাম্পাস অরক্ষিত থাকায় হোস্টেলগুলোতে বহিরাগতদের অবাধ আনাগোনাসহ মাদকের আড্ডা বসার বিস্তার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এসব হোস্টেলের দেখভালের দায়িত্ব থাকা কোনো সুপারই সেখানে থাকেন না। বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের কলেজে হোস্টেলের ভেতর রুম দখল করে শিক্ষার্থী নির্যাতন বা মারধরের ঘটনা না ঘটলেও রাজনৈতিক দলের বড় ভাইদের কারণে অনেকেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অতিসম্প্রতি এ সমস্যাটি কমে আসলেও কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে নিয়মিত বসে মাদকের আড্ডা। বিশেষ করে ডিগ্রি হলখ্যাত অশ্বিনী কুমার হলটি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের দখলে রয়েছে। ওই হলের কমপক্ষে ছয়টি রুমে সন্ধ্যার পরপরই বসে মাদকের আসর। শুধু তাই নয়, এ হলে ছাত্রনেতারা তাদের হাতিয়ারও সংরক্ষণে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিএম কলেজের হিন্দু হলখ্যাত জীবনানন্দ দাশ হলের প্রায় সাতটি রুমে বসে মাদকের আসর। এ আসরে শুধু কলেজের সিনিয়ররাই নয়; সাবেক ছাত্র ও বহিরাগতরাও বসছেন নিয়মিত। সহজে আসা যাওয়ার বেশ কিছু পথ থাকায় এ ক্যাম্পাসে মাদক বিক্রি হচ্ছে হরহামেশা। হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা জানান, সন্ধ্যার পর কলেজ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের মোটরসাইকেলের আনাগোনাই জানান দেয় এরা কতটা ঐক্যবদ্ধ। রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা ভয়ে কেউ এর প্রতিবাদ করতে চায়না। আর হোস্টেলগুলোতে কাগজে কলমে সুপারের পদে কোনো না কোনো শিক্ষক থাকলেও তারা কেউই আসেন না। ফলে হলগুলোতে ইচ্ছেমতো চলাফেরা করে ছাত্ররা। কেউ মধ্যরাতে হলে আসলেও কারও কিছু যায় আসেনা। কলেজের বনমালী গাঙ্গুলী ছাত্রী হোস্টেলে বাকি সব ঠিকঠাক থাকলেও রয়েছে অবৈধ রুম দখলের অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের দাবি সাদিয়া আক্তার সাবিহা নামের এক শিক্ষার্থী প্রায় দুই বছর আগে পড়াশোনা শেষ করলেও তিনি ১ নম্বর বিল্ডিংয়ের ২০৮ নম্বর রুম এখনো দখল করে রেখেছেন। হোস্টেলে তার কাছের লোকজনও বেশ ক্ষমতাধর। তবে হোস্টেলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য বর্তমানে মল্লিকা নামে কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক নিয়মিত থাকছেন। অপরদিকে বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে দুই বছর আগ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এখন সেটি বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তবে এ কলেজের ১ নম্বর হোস্টেলখ্যাত হাবিবুর রহমান ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলার বেশ কয়েকটি রুমে সন্ধ্যার পরে মাদকের আসর বসার অভিযোগ রয়েছে। আর হাবিবুর রহমান, জামিলুর রহমান ও মঈনুল হায়দার নামের ছাত্রদের তিনটি হোস্টেলেই বহিরাগতদের আনাগোনা থাকে সবসময়। গোটা ক্যাম্পাসজুড়ে বহিরাগতদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। তারা মাদক সেবনের পাশাপাশি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে অহরহ। এছাড়া শেবাচিম হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এফএম নূর উর রফী হোস্টেলেও নিয়মিত মাদকের আসর বসে বলে অভিযোগ রয়েছে। সবশেষ গত ১৭ অক্টোবর এ হোস্টেলের তৃতীয় তলার ৩০৩ নম্বর রুম থেকে রিফাতুল ইসলাম রন্টি নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে ৫২০ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। এছাড়া হোস্টেলের দ্বিতীয় তলার ২০৯, ২১২, চতুর্থ তলার ৪০৪সহ কমপক্ষে আটটি রুম বহিরাগত বা সাবেক ছাত্রনেতাদের দখলে রয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদেরসহ কোনো হোস্টেলেই সুপার বা আবাসিক শিক্ষকরা থাকেন না। যে কারণে সব শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করছেন। বরিশাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি, বরিশাল সরকারী পলিটেকনিক ও সৈয়দ সরকারী হাতেম আলী কলেজসহ বেশ কিছু সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হোস্টেল রয়েছে। সেসব হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের দেখভালের জন্য হল সুপার কাগজে কলমে নিয়োগ দেওয়া থাকলেও তাদের কেহই ক্যাম্পাসে থাকেন না। আর এসব কলেজের হোস্টেলগুলোতে প্রতিনিয়ত বহিরাগতদের আনাগোনা, মাদক সেবনসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি অভিভাবকহীন অবস্থায় হোস্টেলগুলোতে স্বাধীন জীবনযাপনের সুযোগ পাওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এর প্রতিবাদ করছে না। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হল সুপাররা বলছেন, হলগুলোতে ছেলেরা এমনভাবে চলাফেরা বা বসবাস করে, একজন শিক্ষক হয়ে তাদের সাথে সম্মান বজায় রেখে থাকাটা কষ্টকর। সেদিক থেকে হোস্টেলের পাশে আলাদা আবাসন ব্যবস্থা থাকলে সুবিধা হতো। কিন্তু কোনো ক্যাম্পাসেই তা নেই। আর ছাত্রী হোস্টেলে পুরুষ সুপার নিয়োগ নিয়েও রয়েছে মতবিরোধ। আবার যদি নারী সুপার দেওয়াও হয়, তিনি মনের মতো না হলে মানতে চান না ছাত্রী নেতারা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট রাহাত হোসেন ফয়সাল বলেন, হলের মধ্যেই ‘অভিযোগ বক্স’ রয়েছে। সেখানে বেনামে অভিযোগ দেওয়া যায়। এখনও মাদক সেবনসহ অন্যান্য কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বরিশাল সরকারী সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল বলেন, আমাদের হোস্টেলে বহিরাগতদের বসবাস নেই। তবে কিছুটা তাদের উৎপাত আছে। এ বিষয়ে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। বরিশাল সরকারী ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শফিকুর রহমান সিকদার বলেন, আমরা সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে হোস্টেলগুলোকে ঢেলে সাজাতে চাই। এবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কারণে সবাই যেভাবে এগিয়ে এসেছে, সেভাবে সবাইকে সবসময়ই আসা উচিত। কিছু কিছু কাজ একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, হল সুপারদের ডাকা হয়েছে, তাদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে, কোন রুমে কি সমস্যা হচ্ছে। বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে যে দলেরই হোক না কেন, ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্ট করতে দেওয়া হবেনা। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঞা বলেন, বরিশালের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস বা হলগুলোতে পুলিশের বিশেষ নজরদারি রয়েছে।
×