ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে

জিসানকে ভারত হয়ে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে

প্রকাশিত: ১১:১২, ২০ অক্টোবর ২০১৯

জিসানকে ভারত হয়ে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দুবাইয়ে গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে প্রথমে ভারতের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে। এরপর তাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। ভুয়া ভারতীয় নাগরিক সেজে দুবাইতে অবস্থান করার কারণে আইনী জটিলতায় তাকে সরাসরি বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জিসানকে ফেরত পেতে ভারত ও দুবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এদিকে ঢাকায় জিসানের দশ জনের একটি শূটার গ্রুপ থাকার তথ্য মিলেছে। তাদের নাম ঠিকানাও পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যেই জিসানের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী গ্রেফতার হয়েছে। তবে তারা শূটার গ্রুপের সদস্য নয়। জিসানে শূটার গ্রুপটির কাছে ৩৫টি অত্যাধুনিক পিস্তল ও রিভলবার থাকার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। সশস্ত্র গ্রুপটির কাছে কোন ভারি আগ্নেয়াস্ত্র থাকার তথ্য মেলেনি। প্রথমে একটি গ্রুপ জিসানের নামে টার্গেটকৃত ব্যক্তির কাছে চাঁদা দাবি করে। বনিবনা না হলে শূটার গ্রুপের সদস্যরা টার্গেটকৃত ব্যক্তি বা সহযোগিদের হত্যা বা ভয় দেখানোর জন্য গুলি চালায়। জিসানকে দেশে ফেরত আনা সম্ভব হলে বহু হত্যা মামলার জট খুলবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের বিরুদ্ধে কম করে হলেও ১০টি খুনের মামলা আছে। যার মধ্যে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে গুলি করে হত্যার ঘটনা অন্যতম। আদালতের তাগাদা সত্ত্বেও মামলাগুলোর চূড়ান্ত সুরাহা হচ্ছিল না। এজন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল। পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মহিউল ইসলাম জানান, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) তথ্য মোতাবেক আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল জিসানের পিছু নেয়। সর্বশেষ ইন্টারপোলের সহায়তায় গত ২ অক্টোবর দিবাগত রাত তিনটার দিকে দুবাইয়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুবাই থেকেই জিসানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। সূত্র বলছে, বহু বছর ধরে দুবাই পলাতক থাকা জিসানকে টাকা দিয়ে আসছিল ক্যাসিনো চালানোর দায়ে গ্রেফতারহ হওয়া বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। জিসান মূলত দুই জন লোকের মাধ্যমে দুবাইতে টাকা নিত। ওই দুই ব্যক্তি যেসব নম্বরে টাকা পাঠাত, সেইসব নম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে চলে আসে। এরপরই জিসানকে গ্রেফতারের পথ খুলে। সেই যোগাযোগের প্রেক্ষিতেই ডিবি পুলিশ সর্বশেষ জিসানের ছবি পাঠায় দুবাইতে। সেই ছবি দেখে নিশ্চিত হয়েই জিসানকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। গ্রেফতারের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও পিছু হটেছিল দুবাইয়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারণ দেখা যায়, জিসানের যে পাসপোর্ট তাতে তার নাম লেখা আলী আকবর চৌধুরী। তিনি এ নামেই দুবাইতে অবস্থান করছিলেন। পাসপোর্ট মোতাবেক তিনি ভারতীয় নাগরিক। এরপর ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুবাই পুলিশ। এ নামে এবং নামের বিপরীতে থাকা তথ্য না মেলায় শেষ পর্যন্ত দুবাই পুলিশ জিসানকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে দেখা যায়, জিসান ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। ডমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। তারা আকবর আলী নামে কোন পাসপোর্ট নেই বলে জানানোর পরই চূড়ান্তভাবে গ্রেফতার করা হয় জিসানকে। পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটে কর্মরত এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও তার বাহিনী এবং জিসান বাহিনীর নানা অপরাধ নিয়ে তিনি টানা তিন বছর কাজ করেছেন। দুই বছর আগেও জিসান বাহিনীর দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। জিসানের দশ জন দক্ষ শূটার থাকার তথ্য আছে। তাদের নাম ঠিকানাও আছে। তাদের সবাই এখন পলাতক। শূটার গ্রুপটির কাছে অত্যাধুনিক পিস্তল ও রিভলবার মিলিয়ে ৩৫টি আগ্নেয়াস্ত্র থাকার তথ্য জানা গেছে। এরমধ্যে তুলনামূলক ব্যবহারে সহজ হওয়ায় পিস্তলের সংখ্যাই বেশি। এসব অস্ত্রের মধ্যে কমপক্ষে ২৮টি অত্যাধুনিক পিস্তল। এই কর্মকর্তা বলছেন, জিসানকে ফেরত আনতে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে আইনী জটিলতার কারণে তাকে সরাসরি বাংলাদেশে ফেরত আনা যাচ্ছে না। তাকে প্রথমে ভারতের কাছে হস্তান্তর করবে দুবাই সরকার। এরপর ভারত থেকে তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, জিসানকে দেশে আনা সম্ভব হলে কমপক্ষে দশটি খুনের মামলার রহস্যের জট খুলবে। আরও অনেক খুনের মামলার আদ্যোপান্ত জানা যাবে। এসব হত্যাকা-ে কাদের নির্দেশে হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে। পাশাপাশি দেশে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং সন্ত্রাসীদের অবৈধ অস্ত্রগোলাবরুদ সরবরাহকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য মিলবে। এদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতাদেরও নাম জানা গেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ক্যাসিনো কালচার এবং ক্যাসিনোর টাকা কোন কোন দেশে পাচার হয়েছে, কারা কারা দেশে ও বিদেশে বসে কত টাকা ভাগ পেয়েছে তারও ফিরিস্তি বেরিয়ে আসবে। এই কর্মকর্তা বলছেন, দীর্ঘ তেরো বছর পলাতক থাকার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহর থেকে গ্রেফতার হয় এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। জিসানকে দীর্ঘ দিন ধরেই নিয়মিত টাকা দিয়ে আসছিল ক্যাসিনো সম্রাট খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগে পদ পদবি বাগিয়ে নেয়ার পর জিসানকে আর নিয়মিত টাকা দিচ্ছিল না খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এ নিয়ে ক্যাসিনো সম্রাট খালেদের সঙ্গে জিসানের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল। ক্যাসিনো সম্রাট খালেদ মাহমুদ আর টেন্ডার কিং জি কে শামীম জিসানের শূটারদের টেন্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগাত। জিসানের শূটার গ্রুপ ক্যাসিনো সম্রাট খালেদ ও জি কে শামীমের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ করত। টাকার একটি ভাগ জিসানের সহযোগীরা পেত। আরেকটি ভাগ চলে যেত জিসানের কাছে।
×