ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন রোহিঙ্গা পল্লীর সন্ধান

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ১৭ অক্টোবর ২০১৯

তিন রোহিঙ্গা পল্লীর সন্ধান

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ অবাক হবার মতো বিষয় হলেও মিথ্যা নয় মোটেও। মিয়ানমারের মতো রোহিঙ্গাপল্লী গড়ে উঠেছে এদেশেও। উখিয়া টেকনাফে ৩২টি আশ্রয় শিবির রয়েছে। তবে স্থায়ীভাবে বসতি ও বাংলাদেশী দাবিদার শত শত রোহিঙ্গার তিনটি পল্লী রয়েছে রামু ও কক্সবাজারে। কয়েকজন চিহ্নিত জনপ্রতিনিধি তাদের ভোট ব্যাংকের জন্য রোহিঙ্গাদের কৌশলে বাংলাদেশী বানিয়েছে। তাদের নাম লিখিয়েছে ভোটার তালিকায়। এ ধরনের তিন রোহিঙ্গা পল্লীর সন্ধান মিলেছে। যেখানে শতকরা ৯০ ভাগই রোহিঙ্গা। তাদের কাছে রয়েছে জাতীয় সনদ। অনেকের কাছে রয়েছে ডিজিটাল পাসপোর্টও। সরকার রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে অত্যন্ত কড়াকড়ি আরোপ করলেও ভোটার তালিকায় নাম লেখাতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে রোহিঙ্গারা। জানা যায়, কিছু সংখ্যক জনপ্রতিনিধি এবং দালাল মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে এবং আইডি কার্ড পেতে ক্ষেত্র বিশেষে স্মার্ট কার্ড পেতেও সহযোগিতা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গা তথা মিয়ানমারে যাদের জন্ম, তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে এদেশে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভোটার হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় সনদ সংগ্রহ করে বাংলাদেশী বনে গেছে। মিয়ানমারের ন্যায় কক্সবাজারে যে তিনটি রোহিঙ্গা পল্লী রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- রামু মিঠাছড়ি ইউপির নিজেরপাড়া, কক্সবাজার শহরের ৭নং ওয়ার্ডের জিয়া নগর-পাহাড়তলী ও হালিমাপাড়া। এ তিনটি পাড়া ছাড়াও তারাবনিয়াছড়ায় বসবাস করছে আরএসও জঙ্গী মৌলবি আয়াছের ভাই-বোন। মুহুরিপাড়ায় রয়েছে হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, হলিডে মোড়ে আবাসিক হোটেল খুলে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা নেতা নুরুল ইসলাম। নতুন করে রোহিঙ্গার স্রোত আসার পর ক্যাম্পে কন্ট্রাক্টার বনে গেছে। সে কলাতলির ঝির ঝিরি কুয়াতে থাকে। রোহিঙ্গা নেতা ও সাবেক আরএসও পুতু তার মালিকানাধীন আবাসিক হোটেলটি ভাড়া দিয়েছেন জামায়াত-বিএনপি নেতাদের। এখন রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দাবি করছে। যেটা এদেশের ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বড়ই লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রশিদ উল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দাবি করে মিঠাছড়ি তাঁতী লীগের সভাপতিও বনে গেছে। ইতিপূর্বে রোহিঙ্গা রশিদ উল্লাহ কিছু অসাধু স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহযোগিতায় মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কাগজপত্র জোগাড় ও বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার প্রমাণস্বরূপ এনআইডি হাতিয়ে নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সাগর পথে মানবপাচারের। সে টেকনাফ থেকে সাগর পথে মানবপাচার করে কোটি কোটি আয় করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ সে অসাধু কিছু বনকর্মকর্তার হাতে মোটা অঙ্কের টাকা ধরিয়ে দিয়ে অনেক সরকারী জায়গা দখল করে নিয়েছে। আর এই দখলকৃত সরকারী জায়গার কিছু অংশ তার আত্মীয়স্বজনদের বিক্রি করে তাদের বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে কিছু কিছু অসাধু অর্থলোভী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা অর্থের লোভে রোহিঙ্গাদের মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। রোহিঙ্গারা তাদের স্বার্থ আদায় করে নেয়। এমন অপরাধের চিত্র উঠে এসেছে রামু মিঠাছড়ি নিজেরপাড়ায় বসবাস করা পুরাতন রোহিঙ্গা রশিদ উল্লাহ মাঝির। জানা যায়, রশিদ উল্লাহ মানুষের কাছে পরিচয় দিয়ে থাকে, সে নাকি বাংলাদেশ আওয়ামী তাঁতী লীগের রামু মিঠাছড়ি ইউনিয়ন সভাপতি। সচেতন মহলের দাবি, একজন রোহিঙ্গা নাগরিক কিভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পায়? তা খতিয়ে দেখার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এলাকাবাসী। এ বিষয়ে রশিদ উল্লাহ জানান, তার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার বিরুদ্ধে কিছু ব্যক্তি শত্রুতা করছে। সে মিঠাছড়ি তাঁতী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছে। তার দাবি সে মিঠাছড়ি ইউনিয়নের সন্তান অথচ তার এনআইডি পটিয়ার। সূত্র জানিয়েছে, রামু মিঠাছড়ি ইউনিয়নে একটি রোহিঙ্গা পল্লীর সন্ধান পাওয়া গেছে। ওইখানে শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবার বনবিভাগের জমি দখল করে গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গা বস্তি। আর এসব রোহিঙ্গা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় নাম তালিকাভুক্ত করেছে ভোটার তালিকায়। জানা গেছে, রামু মিঠাছড়ি পানেরছড়া ওয়ার্ডে বনবিভাগের জমি দখল করে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল রোহিঙ্গা বস্তি। এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে কেউ আগে এসেছে এবং কেউ ২০১৭ সালে পালিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা এখন আস্তে আস্তে ওই জায়গায় এসে রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে তোলেছে। তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় কৌশলে নাম লিখিয়েছে। পানের ছড়া বনবিটের সোজা পশ্চিম দিকে বনবিভাগের পাহাড়ে শতাধিক ঘর (বস্তি) গড়ে তোলেছে এসব রোহিঙ্গা। এখানে প্রতিদিন বাড়ছে ঘরের সংখ্যা। ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ইং প্রকাশিত ভোটার তালিকায় দেখা গেছে, দক্ষিণ মিঠাছড়ি শিয়া পাড়া রামু-কক্সবাজারের ঠিকানায় ১৭ নম্বর ভোটারের নাম লাল ফকির, পিতা-আলী আহম্মদ, মাতা নুর আহম্মদ তার ভোটার নং লেখা হয়েছে ২২১৬১৪৫০৪৪৪৬। তার জন্ম তারিখ লেখা হয়েছে ১৯৬৮ ইংরেজী। জানা গেছে, সে একজন চিহ্নিত ডাকাত এবং রোহিঙ্গা আরএসও নেতা। তার বাড়ি আরাকানের বুচিদং এলাকায়। তার ৩ ছেলে এবং ৭ মেয়ে রয়েছে। তারা সবাই এখন ভোটার তালিকায় নাম তোলেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে। ওই ভোটার তালিকায় লাল ফকিরের এক ছেলে নুরুল আলমের নাম উল্লেখ রয়েছে ১১০ নম্বর সিরিয়ালে। তার ভোটার নং লেখা হয়েছে ২২১৬১৪০০০০০২। তার জন্ম তারিখ লেখা হয়েছে ১৯৮৮ ইংরেজী। ঠিকানা লেখা হয়েছে লাল ফকির বাড়ি শিয়া পাড়া দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রামু কক্সবাজার। লাল ফকিরের অপর ছেলে আবু আহমদ, পিতা ফকির মোহাম্মদ উল্লেখ রয়েছে। ভোটার তালিকায় ০০৩ সিরিয়ালে। তার জন্ম দেখানো হয়েছে ৭/৮/১৯৮১ ইং, ভোটার নং ২২১৬১৪৫০৪৪০৭। ঠিকানা একই শিয়া পাড়া দক্ষিণ মিঠাছড়িতে। একইভাবে ভোটার তালিকায় ০০১ সিরিয়ালের নুরুল আলম, পিতা আব্দুল জব্বার, ০০৪ সিরিয়ালের আবুল কালাম পিতা জহির আহমদ, ০০৫ সিরিয়ালের দিদার আলম পিতা ফকির আহমদ, ০০৯ সিরিয়ালের গোলো হোছন পিতা মোঃ কালু, ০১২ সিরিয়ালের শামসুল আলম পিতা আব্দু জব্বার, ০১৩ সিরিয়ালের নুরুল ইসলাম পিতা নজির হোছন, ০১৫ সিরিয়ালের আব্দু গফুর পিতা ফকির আহম্মদ, ০২০ সিরয়ালের আব্দুর রহিম পিতা ফকির মোহাম্মদ, ০২৫ সিরিয়ালের জহির আহমদ পিতা মোহাম্মদ কালু, ০২৬ সিরিয়ালে আব্দুল গফ্ফার পিতা ফকির মোহাম্মদ, ০২৮ সিরিয়ালের মুহাম্মদুল হক পিতা মিয়া হোছন, ০২৯ সিরিয়ালের আব্দুর রহিম পিতা ফকির মোহাম্মদ, ০১৮ সিরিয়ালের আলী জুহার পিতা দরবেশ আলী, ০২৭ সিরিয়ালের আব্দুল জব্বার পিতা ফকির মোহাম্মদ, ১০৩ সিরিয়ালের নুরুল হক পিতা নুর মোহাম্মদ, ১১৩ সিরয়ালের জসীম উদ্দিন, পিতা আলী জুহার, ১২৮ সিরিয়ালের ওয়াসিম মিয়া পিতা আলী জুহার, ১৩১ সিরিয়ালের হোছন আহমদ, পিতা কবির আহমদ, ১৪০ সিরিয়ালের মনিরুল আলম, পিতা ফকির আহমদ ও ১৪১ সিরিয়ালের নুর মোহাম্মদ পিতা ফকির আহমদ। এরা সবাই রোহিঙ্গা। আরএসও নেতা ডাকাত লাল ফকিরের আত্মীয় স্বজন পরিচয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গোপনে এরা দক্ষিণ মিঠাছড়ির শিয়া পাহাড়ে এসে বসতি গড়ে তোলেছে। জনপ্রতিনিধিদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তারা ভোটার হয়েছে। এসব রোহিঙ্গা মোটা অঙ্কের বিনিময়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও কতিপয় নির্বাচন কর্মকর্তার সহযোগিতায় জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় সনদ নিয়ে ভোটার হয়েছে। এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের এনআইডি বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
×