ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগ ও শিল্পবান্ধব হবে ॥ বদলে যাচ্ছে কোম্পানি আইন

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ১৭ অক্টোবর ২০১৯

বিনিয়োগ ও শিল্পবান্ধব হবে ॥ বদলে যাচ্ছে কোম্পানি আইন

এম শাহজাহান ॥ ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে দীর্ঘ ২৫ বছর পর বদলে যাচ্ছে কোম্পানি আইন। আইনটি সংশোধন করে তা বিনিয়োগ ও শিল্পবান্ধব করা হচ্ছে। এই আইন আগামী বছরের শুরুতেই কার্যকর করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে কোম্পানি আইন। আইনটি কার্যকর হলে সংশোধিত আইনে এক ব্যক্তিই কোম্পানি গঠন করতে পারবেন। কোম্পানি নিবন্ধনের ছাড়পত্র পাওয়া যাবে সহজেই। এতে নতুন করে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ কোম্পানি গড়ে উঠার সুযোগ তৈরি হবে। ফলে উৎপাদন বাড়বে, তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থানের। দেশে একটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী তৈরি হবে। নতুন আইন কার্যকর হলে শেয়ার কেনাবেচায় প্রতারণা কমবে, বাজার স্থিতিশীল হবে। কোম্পানি নিবন্ধন থেকে শুরু করে তা পরিচালনাও সহজতর হবে। বিদ্যমান কোম্পানি আইনে নানা কারণে যেমন হাইকোর্টের অনুমতি নেয়ার দরকার হয়, নতুন আইন পাস হলে উদ্যোক্তাদের এত বেশি আদালতনির্ভর হতে হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, কোম্পানি আইনের আধুনিকায়নের দাবি দীর্ঘদিনের। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে দেশে কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। পরিবর্তিত বিশ্বে দীর্ঘ ২৫ বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল বিশ্বে এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চলছে। পঞ্চম শিল্প বিপ্লব উদ্যোক্তাদের দ্বারপ্রান্তে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশেও কোম্পানি আইন সংশোধন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, কোম্পানি গঠনে স্বচ্ছতার অভাব, সার্টিফাইড কপি পেতে দীর্ঘসূত্রতা, পরিপূর্ণ অটোমেশনের অভাব, শেয়ারবদলে অস্বচ্ছতা, অন্যদিকে আইনী বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন বিডা, সিটি কর্পোরেশন, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন আমদানি এবং রফতানি সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় উদ্যোক্তাদের প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এতে অনেক উদ্যোক্তা কোম্পানি গঠনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র দুই বছরের মাথায় কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে আইনটি সংশোধনে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত আট বছরে আইনটি যুগোপযোগী করতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থারও সহযোগিতা নেয়া হয়। সবার মতামতের ভিত্তিতে আইনটি চূড়ান্ত করে আনা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া কোম্পানি আইন চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে আগামী ২০ অক্টোবর বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীনের সভাপতিত্বে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওই সভায় নিবন্ধক যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যানসহ বাণিজ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে আইনটি চূড়ান্ত করণে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (এফটিএ) এ এইচ এম আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৯৪ সালের সংশোধিত কোম্পানি আইন আরও সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হচ্ছে। নতুন আইনটি করতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডার ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, শীঘ্রই আইনটি পাস করানো হবে। তিনি বলেন, নতুন কোম্পানি আইন কার্যকর হলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে। হয়রানিমুক্ত থেকে একজন উদ্যোক্তা অটোমেশনের মাধ্যমে কোম্পানি নিবন্ধন প্রক্রিয়া বা ছাড়পত্র নিতে পারবেন। জানা গেছে, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ তে বড় ধরনের সংশোধনী আনা হচ্ছে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি পরিচালিত হতে হবে পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। এই পর্ষদ বা বোর্ডের পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। তবে প্রস্তাবিত আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘এক ব্যক্তি কোম্পানি’ হলো সেই কোম্পানি, যার বোর্ডে সদস্য থাকবেন কেবল একজন। পরিচালক এবং প্রধান ব্যক্তি একজন থাকেন বলে এ ধরনের কোম্পানি পর্ষদ সভা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নিয়মের ছাড় পাবে। সংশোধিত কোম্পানি আইন-২০১৮ ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ওই সংশোধিত আইনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজীকরণ, এক ব্যক্তি কোম্পানি গঠন, কোম্পানির সাধারণ পাওনাদারদের ও সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণ সমীচীন ও প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে। সংশোধনীতে ১৯৯৪ সালের ১৮ নং আইনের ২ ধারার (১) (ট) (ই) এর শুরুতে ‘এক-ব্যক্তি কোম্পানি ব্যতীত’ শব্দগুলো সংযোজন করা হবে। এছাড়া ১৯৯৪ সালের ১৮ নং আইনের ২ ধারার (১) (ট) (ই) এরপর নতুন উপধারা (ঈ) সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংযোজনে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি কোম্পানি বলতে একজন ব্যক্তি কর্তৃক গঠিত কোম্পানিকে বুঝাবে। কোম্পানি আইনে ১৯৯৪ সালের ১৮ নং আইনের ৫ ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, পাবলিক লিমিটেড গঠনের ক্ষেত্রে সাত বা ততোধিক ব্যক্তি, প্রাইভেট কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি শব্দগুলোর পর ‘এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি’ শব্দগুলো সংযোজন করা হবে। নতুন বছর থেকে কার্যকর ॥ আগামী বছরের শুরু থেকে সংশোধিত কোম্পানি আইনটি কার্যকর করতে চায় সরকার। এলক্ষ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। কোম্পানি (সংশোধনী) আইন, ২০১৮-এর খসড়া চূড়ান্ত করে ভেটিংয়ের জন্য গত মার্চ মাসে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি দ্রুত ভেটিং শেষ করার অনুরোধও জানানো হয়েছিল। কারণ এ আইনের সঙ্গে সহজে ব্যবসা সূচকে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় ভেটিং কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি। তবে শীঘ্রই ভেটিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, সংশোধিত কোম্পানি আইনের বিষয়গুলো অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আশা করছি, শীঘ্রই আইনটির ভেটিং প্রক্রিয়া শেষ করে আনা সম্ভব হবে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, গত মার্চেই আইনটির ভেটিং কার্যক্রম শেষ করে কোম্পানি আইনটি চূড়ান্ত করা হলে ইজি অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স-২০১৯-এ কয়েক ধাপে এগিয়ে যেত বাংলাদেশ। কারণ ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স-২০১৯ চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে গণনা করা হবে। এ ব্যাপারে সব মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করলে ২০২১ সালের মধ্যে ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কে বা কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এছাড়া কোম্পানি আইন সংশোধন হলে দেশী-বিদেশী সব ধরনের বিনিয়োগ বাড়বে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ছোট ছোট উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম। এ সূচকটি বিদেশী বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কে বা কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্য ঠিক করেছে। চলমান বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে আইনটি দ্রুত সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোম্পানি আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এখন ব্যবসার ধরন, পদ্ধতি ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে। এজন্য যুগোপযোগী ও বাস্তবতার নিরিখে কোম্পানি আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বেগবান করা ও নতুন নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নীতিমালার সংস্কার, ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় হ্রাস, মানবসম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে ব্যবসা পরিচালনার সহজাত পরিবেশ তৈরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নতুন ব্যবসা শুরুর জন্য নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা কমানো ও বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ হ্রাসের আহ্বান জানান। প্রস্তাবিত কোম্পানি আইন বাস্তবায়ন হলে অনেক নতুন কোম্পানি কর নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে এবং সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়ে যাবে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী। সময়ের প্রয়োজনে কোম্পানি আইন সংশোধন হচ্ছে ॥ বর্তমান বিশ্বে সময়ের প্রয়োজনে কোম্পানি আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। ব্যবসা-সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে কোম্পানি আইন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ৮০০টি আইন এবং অর্ডিন্যান্স রয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানি আইন অনেক বড় আইনের একটি। প্রায় সব ধরনের ব্যবসায় এ আইনের দরকার পড়ে। ইতোমধ্যে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর তাদের কোম্পানি আইন পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশেও কোম্পানি আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, আইনটি ব্যবসাবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর কোন ধারা যাতে অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় সে বিষয়টিতেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এদিকে নতুন কোম্পানি আইনে শেয়ার বাজারে বাই-ব্যাক পদ্ধতি চালু করার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে। বাই-ব্যাক হলো কোন কোম্পানির বাজারে থাকা শেয়ার একটি নির্দিষ্ট দামে নেমে এলে ওই কোম্পানির উদ্যোক্তা কর্তৃক তা আবার কিনে নেয়। এছাড়া ব্যবসা পরিচালনার চ্যালেঞ্জ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি। মূলধন জোগাড়ে এখন নানা ধরনের নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে অর্থাৎ কে কত সহজ শর্তে মূলধন জোগাড় করে অন্যের চেয়ে প্রতিযোগী হতে পারে, তা কোম্পানি পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব ফিন্যান্সিংয়ের বিভিন্ন সুযোগ নিতে সংশোধিত কোম্পানি আইন যুগোপযোগী করা হয়েছে।
×