ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

মহাবিশ্বের পারমাণবিক পাস্তা ও অন্যান্য

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ১১ অক্টোবর ২০১৯

মহাবিশ্বের পারমাণবিক পাস্তা ও অন্যান্য

মহাবিশ্ব যে ভারি অদ্ভুত ও রহস্যময়তায় ভরা সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বাইরের দিকে তাকালেই দেখা যাবে কত অজস্র রকমের উদ্ভিদ ও প্রাণীর এক বিচিত্র জগত। প্রাণী ও উদ্ভিদের এই জগতটিরও আবার রয়েছে গ্যাসের হাল্কা অবগুণ্ঠনে ঢাকা পাতলা কঠিন খোলসে আবৃত আধাগলিত শিলার এক নীল গোলকের মধ্যে। তার পরও আমাদের এই গ্রহটি গোটা মহাবিশ্বে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত ও বিচিত্র সব বস্তু এবং ঘটনার এক অতি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রতিদিন আমাদের সামনে নিত্য নতুন বিস্ময় মেলে ধরছেন। মহাকাশের সবচেয়ে অদ্ভুত ও বিস্মরকর কয়েকটি বস্তুর কথা নিচে উল্লেখ করা হলো- পারমাণবিক পাস্তা এগুলো হচ্ছে মৃত নক্ষত্রের পরিত্যক্ত অংশ দিয়ে গঠিত মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তু। সিমুলেশনে দেখা গেছে যে একটি নক্ষত্রের কুঞ্চিত খোলসের প্রোটন ও নিউট্রনগুলো এত প্রচ- মাধ্যাকর্ষণ চাপের মধ্যে পড়তে পারে যে সেগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পাস্তার মতো জটবাঁধা বস্তুতে পরিণত হতে পারে। এই বস্তুটি মট করে ভেঙ্গে যেতে পারে- তবে তার জন্য ইস্পাত ভাঙতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন তার ১ হাজার কোটি গুণ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। হাউমিয়ার বলয় নেপচুন গ্রহকে ছাড়িয়ে আরও দূরে যে কুইপার বেল্ট আছে সেখানে কক্ষপথ পরিক্রমণরত বামনগ্রহ হাউমিয়া তো আগে থেকেই এক অদ্ভুত বস্তু হিসেবে পরিচিতিপ্রাপ্ত। এর আকৃতি অদ্ভুত রকমের প্রলম্বিত। এর চাঁদ রয়েছে দুটি এবং এর দিনের স্থায়িত্বকাল মাত্র ৪ ঘণ্টা। তার মানে এটি সৌরজগতের সবচেয়ে দ্রুত পাক খেয়ে চলা এক বৃহৎ বস্তু। কিন্তু এর চেয়েও অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য জানা গেছে ২০১৭ সালে যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটিকে একটি নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন, তারা আরও লক্ষ্য করেন যে, অতিমাত্রায় পাতলা একটি বলয়ের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। দূর অতীতের কোন এক সময় একটা সংঘর্ষ থেকেই এই বলয়ের উৎপত্তি ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চাঁদেরও আবার চাঁদ একটা চাঁদের চারদিকে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে আরেকটা চাঁদ। ইন্টারনেটে এর নাম দেয়া হয়েছে মুনমুন। তবে একে সাবমুন, মুর্নিটো, গ্র্যান্ডমুন, মুনেট ও মুউনও বলা যেতে পারে। এগুলো এখন তাত্ত্বীয় পর্যায়ে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক হিসাব নিকাশে দেখা গেছে যে এগুলো গঠিত হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা হয়ত একদিন এমন একটি চাঁদ আবিষ্কার করবেন। ডার্ক-ম্যাটারহীন নীহারিকা মহাবিশ্বের এক অদ্ভুত জিনিস হলো ডার্ক-ম্যাটার বা কৃষ্ণপদার্থ। এই অজ্ঞাত বস্তুটি মহাবিশ্বের যাবতীয় পদার্থের ৮৫ শতাংশ। গবেষকরা একটা ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত। তা হলো ডার্ক-ম্যাটার সর্বত্রই বিরাজমান। কিন্তু ২০১৮ সালের মার্চে একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী এমন এক অদ্ভুত নীহারিকার সন্ধান পেলেন সেখানে ডার্ক-ম্যাটারের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শুনে অন্য বিজ্ঞানীদের চক্ষু তো চরকগাছ। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে সেই অদ্ভুত নীহারিকাটিতে বস্তুতই ডার্ক-ম্যাটার আছে। গবেষণা থেকে আরেকটা ব্যাপারও ঘটে গেছে। তা হলো বিকল্প এই তত্ত্বটিও বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করেছে যে ডার্ক-ম্যাটারের অস্তিত্বই আসলে নেই। অদ্ভুতুড়ে তারা মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাবেথা বয়াজিয়ান ও তার সহকর্মীরা একটি নক্ষত্র আবিষ্কার করে বিহ্বল হয়ে যান। কেআইসি ৮৪৬২৮৫ নামে এই নক্ষত্রটি যার ডাকনাম দেয়া হয়েছে ট্যাবিস স্টার, অনিয়মিত বিরতিতে সেটির উজ্জ্বলতা নিভু নিভু হয়ে আসে এবং সেটাও আবার অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক সময় ধরে। তারাটি ২২ শতাংশ পর্যন্ত উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে এর নানা রকম ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। অজানা এক মেগাস্ট্র্যাকচার বা অতিকায় কাঠামোর সম্ভাবনার কথা কেউ কেউ বলেছেন। তবে হালে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর ধারণা নক্ষত্রটিকে ঘিরে আছে ধূলিকণার এক অস্বাভাবিক বলয় যার জন্য তারাটিকে নিভু নিভু দেখায়। বিদ্যুত প্রবাহকারী হাইপেরিয়ন সৌরজগতের সবচেয়ে অদ্ভুত চাদের খেতাবটা অনেক মহাজাগতিক বস্তুকেই দেয়া যেতে পারে। যেমন বৃহস্পতির চাঁদ আইও সেখানে অহরহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদ্বিগরণ ঘটে চলেছে। কিংবা নেপচুনের চাঁদ ট্রাইটন সেখানে উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে গরম জলধারা উদগিরণ হচ্ছে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বোধহয় শনির চাঁদ হাইপেরিয়ন। ঝামা পাথরের মতো অনিয়মিত শিলায় গঠিত এই চাঁদের বুকে রয়েছে অসংখ্য জ্বালামুখ বা গর্ত। নাসার ক্যাসিনি নভোযান হাইপেরিয়নের কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেয়েছে এর শরীরটা স্থির বিদ্যুতের চার্জ যুক্ত। এর গা থেকে বিদ্যুতের ছটা মহাশূন্যে প্রবাহিত হচ্ছে। দিশারী নিউট্রিনো ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর অতি এনার্জিসম্পন্ন একক একটি নিউট্রিনো পৃথিবীর বুকে এসে পড়েছিল। ওটা যে নিজ থেকে এসে পড়েনি সেটার মধ্যেই সব অসাধারণত্ব নিহিত। এন্টার্কটিকার আইসকিউব নিউট্রিনো মানমন্দিরের পদার্থবিজ্ঞানীরা মাসে অন্তত একবার একই মাত্রার এনার্জিসম্পন্ন নিউট্রিনো দেখে থাকেন। তবে ২২ সেপ্টেম্বরে নিউট্রিনোর বিশেষত্ব হলো এই প্রথম ওটা তার উৎপত্তি সংক্রান্ত এমন পর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে এসেছিল যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেদিক থেকে ওটার আগমন ঘটে সেদিকে টেলিস্কোপ মেলে ধরেন। তারা বের করতে সক্ষম হন যে চার শ’ কোটি বছর আগে একটি নীহারিকার কেন্দ্রে থাকা অতি বিশাল এক ব্ল্যাকহোল আশপাশের পদার্থবাজিকে গ্রাস করতে থাকা অবস্থায় ওই নিউট্রিনোকে পৃথিবীর দিকে ছুড়ে দিয়েছিল। রহস্যময় বেতার সঙ্কেত ২০০৭ সাল থেকে গবেষকরা অতি শক্তিশালী অতিউজ্জ্বল বেতার সঙ্কেত পেয়ে আসছেন যেগুলোর স্থায়িত্বকাল মাত্র কয়েক মিলি সেকেন্ড। এই প্রহেলিকায় আলোর ঝলকানিকে বলা হয় ফাস্ট রেডিও বার্স্টস (এফআরবি)। এগুলো শত শত কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে আসছে বলে ধরা হয়। জ্যান্ত ফসিল নীহারিকা ডিজিস্যাত্রটি ১ হলো একটি অতি প্রসারিত নীহারিকা। তার অর্থ এটি মিলকি ওয়ের মতোই এক বিশাল নীহারিকা। তবে এর নক্ষত্রগুলো এতই ছড়িয়ে পড়া যে একে প্রায় দেখাই যায় না। তবে ২০১৬ সালে বিজ্ঞানীরা যখন এই ভুতুড়ে ডিজিস্যঠত্রটি-১ নীহারিকাটি দেখেন তারা লক্ষ্য করেন এটি একবারে একাকী বসে আছে যা অন্যান্য অতিপ্রসারিত নীহারিকার মতো নয়। এর বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে ওই নিষ্প্রভ বস্তুটি মহাবিশ্বের এক অতি ভিন্ন অধ্যায়ে যেমন মহাবিস্ফোরণের প্রায় এক শ’ কোটি বছর পর গঠিত হয়েছিল। ডাবল কোয়াসারের ছবি বিশাল বিশাল বস্তু আলোকে বক্র করে ফেলে এবং সেটা এতটাই করে যে আলোর পেছনের বস্তুর ছবি বিকৃত হয়ে যায়। গবেষকরা মহাবিশ্বের প্রথমদিকের একটি কোয়াসারের হদিস বের করার জন্য যখন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছিলেন তারা এটিকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার নির্ণয়ে কাজে লাগিয়েছিলেন। তারা দেখেছিলেন তখন যে হারে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছিল আজ তার চেয়ে বেশি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এখন বিজ্ঞানীদেরই নির্ণয় করতে হবে তাদের ব্যাখ্যা ভুল নাকি অন্য অদ্ভুত কিছু ঘটে চলেছে। ইনফ্রারেডের প্রবাহ নিউট্রন তারা হচ্ছে নিয়মিত নক্ষত্রের মৃত্যুর পর গঠিত অতিমাত্রায় ঘন বস্তু। সাধারণত এরা বেতার তরঙ্গ কিংবা রঞ্জন রশ্মির মতো অতি শক্তিসম্পন্ন তেজষ্ক্রিয় আলো বিকীরণ করে। কিন্তু ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে বিজ্ঞানীরা পৃথিবী থেকে ৮শ’ আলোকবর্ষ দূরের একটি নিউট্রন তারা থেকে আগত ইনফ্রারেড আলোর দীর্ঘ প্রবাহ দেখতে পান যা আগে কখনও দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা নিউট্রন তারার চারপাশে থাকা ধূলিকণার চাকতি থেকে এই প্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে। আলোকচ্ছটাযুক্ত বেয়ারা গ্রহ নীহারিকার মধ্য দিয়ে ভেসে চলে বেয়ারা গ্রহ যেগুলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা জনক তারা থেকে ছিটকে পড়ে। এই শ্রেণীর বস্তুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি গ্রহের আকারের একটি বস্তু যা ২শ’ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং যার চৌম্বক ক্ষেত্র বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে ২শ’ গুণেরও বেশি শক্তিশালী। নিজের বায়ুম-লে আলোকচ্ছটা সৃষ্টি করার জন্য এটা যথেষ্ট শক্তিশালী। এই আলোর দ্যুতি রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা যায়। সূত্র : লাইভ সায়েন্স
×