ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জ্ঞানের সন্ধানে খুদে শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ৫ অক্টোবর ২০১৯

 চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জ্ঞানের সন্ধানে খুদে শিক্ষার্থীরা

খুদে শিক্ষার্থীরাই নৌকার মাঝিমাল্লা। বৈঠা হাতে, হাল ধরে নৌকা চালিয়ে স্কুলে যায়। বছরের সাড়ে তিন মাস যাতায়াত করে নৌকায়। বাকি সময় বাঁশের সাঁকো এবং ধু ধু বালিয়াড়ির এবড়োথেবড়ো মেঠোপথ। অনেক চড়াই-উতরাই এবং বৈরী পরিবেশ উপেক্ষা করে যমুনার দুর্গম চরের খুদে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাতায়াত করে। কখনও রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, আবার কখনওবা যমুনার উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে নৌকায় যেতে হয় স্কুলে। প্রতিটি নৌকায় ২০/২২ জনকে উঠতে হয় দলবেঁধে। দুর্গম চৌহালী উপজেলার সদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের বোয়ালকান্দি এলাকায় যমুনার শাখা নদীর পাশে প্রতিষ্ঠিত বোয়ালকান্দি দাখিল মাদ্রাসা, চরবোয়ালকান্দি ও রেহাইমৌশা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় যমুনার ভাঙ্গনে বিপর্যস্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ৪শ’ শিক্ষার্থীর ক্যানেল পারাপার হয়ে যাতায়াতে নৌকাই এখন একমাত্র ভরসা। বর্ষার সময় নৌকা উল্টে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে কয়েক শিক্ষার্থী। এছাড়া প্রতিনিয়তই থাকে প্রাণহানির আশঙ্কা। এমন চড়াই-উতরাই উপেক্ষা করেই যুগযুগ ধরে জ্ঞানের আলো আহরণে যমুনা চরের এসব শিশু বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নানা শঙ্কার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের প্রায় সাড়ে তিন মাসই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করে। কখনও কখনও ঢেউয়ের কারণে নৌকা উল্টে যাওয়ার শঙ্কার সঙ্গে জীবন হারানোর ভয় তো আছেই। তবু ঝুঁকি নিয়েই তারা পৌঁছে নিজের বিদ্যালয়ে। এ বিষয়ে চরবোয়ালকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যলয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রোজিনা, আসলাম ও ৩য় শ্রেণীর শিক্ষার্থী রেজোয়ান ও আসিফ জানান, প্রতিদিন সকালে বিদ্যালয়ে যাবার প্রথম প্রস্তুতি নৌকা আর বৈঠার খোঁজ। এরপর স্কুলের নির্ধারিত পোশাক পরে বই-খাতা নিয়ে পান্তা খেয়ে আবার কখনওবা গরম ভাত খেয়ে নৌকায় ভেসে বিদ্যালয়ে যাই। মাঝি পাইনা অনেক সময়। এজন্য বহু দিন ক্লাস ধরতে পারিনি। তাই এখন বাধ্য হয়ে নিজেরাই নৌকা চালানো শিখেছি। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নৌকায় চড়ে আর শুকনো মৌসুমে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করি। স্থানীয় কয়েক অভিভাবক জানান, উপজেলার সীমান্তবর্তী সাদিয়া চাঁদপুর ইউপির যমুনার পূর্বপাড়সহ উপজেলার প্রায় ২৫টি বিদ্যালয়ে যাতায়াতে কয়েক যুগ আগে থেকেই এ দুরবস্থা। বৃষ্টি ও রোদ উপেক্ষা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় নিয়েই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হয়। কখনও ছোট খাল, ডিঙ্গী নৌকা অথবা বাঁশের সাঁকো পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। তবে সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে একটি বড় নৌকার ব্যবস্থা করলে বর্ষার শুরু থেকে পানি শুকানো পর্যন্ত শিশু শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে সুবিধা হবে। এদিকে শীতকালে শুকনো মৌসুমে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। তখন পড়তে হয় ভিন্ন সমস্যায়। এ সময় কোন বাহনই চলে না। তখন শিক্ষার্থীদের হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতে হয় । এ জন্য স্কুলের সময়সূচী পরিবর্তন করে দিতে হয়। চরের শিক্ষকরা বলেন, এখানে একটি কথার প্রচলন আছে ‘বর্ষায় নাও (নৌকা), শুকনো মৌসুমে পাও (পা)’। বন্যার পানি কমে গেলেও যমুনার চরাঞ্চলের খালে পানি থাকে। বছরের প্রায় সাড়ে তিন মাস শিক্ষার্থীসহ সবাইকে নৌকায় পারাপার হতে হয়। পাশাপাশি শহরের খুদে শিক্ষার্থীরা সকালে ঘুম থেকে জেগে রুটি কিংবা পরাটা, ডিম, মাংস খেয়ে মায়ের আঁচলের নিচে রিক্সায় কিংবা মোটরগাড়িতে চড়ে স্কুলে যায়। স্কুল চলাকালীন পর্যন্ত মা কিংবা বাবা থাকেন সন্তানের পাহারায়। কিন্তু চরের শিক্ষার্থীদের এসব কোন সুবিধাই নেই। চৌহালীর চরবোয়ালকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আহাম্মদ উল্লাহ জানান, যমুনা নদী ভাঙ্গনের কারণে চরাঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। বর্ষা মৌসুমে সমগ্র চরাঞ্চল ডুবে থাকে। যমুনা নদী থেকে বর্ষার পানি কমলেও খাল-বিল ও শাখা নদীতে পানি না কমায় বছরের অধিকাংশ সময় নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোন উপায় থাকে না। নৌকায় চরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে খুদে শিক্ষার্থীরা। এ কারণে অনেক শিশু এসময় স্কুলে আসতে চায় না বা তাদের অভিভাবকরাও তাদের পাঠাতে চান না।জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে সিরাজগঞ্জের পাঁচ উপজেলার যমুনা নদী তীরবর্তী দুর্গম চরে কতটি সরকারী বা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে তার পৃথক কোন হিসাব নেই। কতজনইবা শিক্ষার্থী তাও পৃথকভাবে বলতে পারছে না। তবে এতটুকু সত্য, শহরের তুলনায় অনেক বেশি বৈরী পরিবেশে চরের খুদে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করে। তুলনামূলক ফল অর্জন করে। -বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে
×