ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশের সাথে চার হাজার কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারত

প্রকাশিত: ০১:০৯, ৩ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশের সাথে চার হাজার কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারত

অনলাইন ডেস্ক ॥ কুমিল্লার ডিমাতলী গ্রামে ভারতীয় সীমান্তের সাথে একদম গা ঘেঁষা বাড়িতে থাকেন পারভীন আক্তার। বছর তের আগে যখন হঠাৎ শুনলেন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তার গ্রাম দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে তখন তার স্বামী এপারে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ওপাশে রয়ে গেছে শশুর বাড়ির আত্মীয়রা। এপাশ থেকে শশুড়বাড়ির টিনের চালের ঘর তিনি দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। একটা ফুটবল খেলার মাঠের মতো দূরত্বে টিনের চাল সেটি তিনি বাড়ি থেকে বের হলেই দেখতে পান। বিয়ের পর তিনি ওপারেই থাকতেন। তিনি বলছেন, "তারকাঁটার বেড়া হওয়ার কথা যখন শুনছি, আমার শাশুড়ি কইছে আমরা বাংলাদেশে যাবো। এখন ওইপাশে আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাত হয় তারকাঁটার কাছে গেলে।" এই কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে গেলে ওপাশে ভাগ হয়ে যাওয়া গ্রামের নাম এখনো ডিমাতলী। সেখানে প্রথম যে বাজারটি পরে তার নামও ডিমাতলি বাজার। কাঁটাতারের বেড়া হওয়ার আগে সেখান থেকে মানুষজন এই অংশে অনেক পণ্য নিয়ে আসতেন। দুইপাশে বেশ স্বাভাবিক যাওয়া আসা ছিল। দুই পাশে বিয়ে, নেমন্তন্ন সবই চলতো। সেই সময়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন রিনা বেগম। তিনি বলছেন, "ওইদিক থেকে আসতো। বাজার করে যেতো। আমরাও লাকড়ি আনতাম। তখন ওইপাশ থেকেও আনারস আসতো, কাঁঠাল আসতো। তখন সবার আসা যাওয়া ছিল।" ডীমাতলির সাথে লাগোয়া নো ম্যান্স ল্যান্ডের দেড়শ গজ বাদ দিয়ে তৈরি ভারতীয় এই কাঁটাতারের কারণে সেই আদান প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অনেকের আরো বড় ক্ষতি হয়েছে। মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বলছেন এখানে তিনি সহ অনেকেই তাদের জমি হারিয়েছেন। তিনি বলছেন, "হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে দেখি এইখানে তারকাঁটার বেড়া হবে। আরেকটু ওইপাশে হওয়ার কথা ছিল। তারপর যখন বেড়া হইলো। আমাদের বাবা-দাদার সম্পত্তি সব ওইখানে। ভিটাবাড়ি, সম্পত্তি এগুলো আমরা আর ফিরে পাইনি। এখন এইখানে আমাদের কিছু নেই। খাসজমিতে থাকি।" তবে এখানকার লোকজন এখনো নো ম্যান্স ল্যান্ডে রোজই কিছুদূর ঢুকে যান। কাঁটাতারের বেড়া থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে গবাদিপশুকে ঘাস খাওয়ান। তবে সেজন্য ভুগতেও হয় মাঝে মাঝে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের আটক ও গুলিতে মৃত্যুর খবর প্রায়ই শোনা যায়। বাংলাদেশের সাথে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে সীমান্তে উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কাজ প্রায়ই শেষ করে এনেছে ভারত। প্রচুর অংশ জুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। ইনফ্রারেড প্রযুক্তি দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে বেড়া নিয়ন্ত্রণের কথাও শোনা গেছে। ভারতের পক্ষ থেকে সবসময়ই বলা হয়েছে বাংলাদেশিদের অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান প্রতিরোধ, সীমান্ত এলাকায় অপরাধ দমন এবং নিরাপত্তার কারণে তাদের এই উদ্যোগ। এর কি কোন রাজনৈতিক ইঙ্গিত আছে? সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বিশ্লেষক নাসিম ফেরদৌসে বলছেন, "এখানে কোন পলিটিকাল ইমপ্লিকেশন আমি দেখতে পাইনা। বাংলাদেশে প্রথমদিকে একটু উচ্চবাচ্য করেছিলো। কিন্তু কেউ যদি বাড়ির চারপাশে দেয়াল দিতে চায় তাহলে প্রতিবেশীর কিছু বলার থাকে না। তো বাংলাদেশও খুব একটা আপত্তি করছে না।" যদিও ভারত সবসময় বলে আসছে বাংলাদেশ তার বন্ধু দেশ। কিন্তু পাকিস্তান বাদে ভারতের অন্য প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভুটান ও নেপালের সাথে সীমান্তে এমন কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই। বাংলাদেশের সীমান্ত এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বিষয়টিকে বাংলাদেশের সরকার কিভাবে দেখছে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলছেন, "ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক সবসময় অত্যন্ত উষ্ণ। তারা তাদের কাজ করেন আমরা আমাদের কাজ করে যাই।" সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে মন্ত্রীর কাছ থেকে খুব স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শুরু হওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরং বলেন, বাংলাদেশিরা ভারতের অংশে বাড়িঘরে অপরাধ করতে গিয়ে মারা পড়ছেন, সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এসব প্রসঙ্গ উঠবে বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু সীমান্তের রেখা আন্তর্জাতিক আইন কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কূটনীতি সম্পর্কে কতটুকুই বা জানেন সবুজ ডিমাতলী গ্রামের মানুষজন। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×