ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, সততা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায় সম্ভব হয়েছে এ উন্নয়ন

‘উন্নয়নের বিস্ময়’ বাংলাদেশ ॥ অর্থনীতিতে এখন রমরমা অবস্থা

প্রকাশিত: ১০:১৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ বাংলাদেশ ॥ অর্থনীতিতে এখন রমরমা অবস্থা

কাওসার রহমান ॥ দেশের অর্থনীতিতে এখন রমরমা অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন বলেই দেশের অর্থনীতিতে এত রমরমা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত দশ বছরের এই অথনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বকে শুধু বিস্মিতই করছে। বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মহলে প্রায়ই ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, সততা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায়। বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত আর্থিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত ১০ বছর ধরে সমৃদ্ধি বজায় রেখেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এর সুফলও পাচ্ছে দেশের মানুষ। এখন আর কোন মানুষ না খেয়ে থাকে না। খাদ্য ঘাটতির ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন খাদ্যশস্যে উপচে পড়ছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে এসে অভাবনীয় সাফল্য। মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। প্রায় ঘরে ঘরেই পৌঁছে গেছে বিদ্যুত। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে ‘বলিষ্ঠ অগ্রগতি’ অর্জন করেছে। মাইলফলক অর্জন এসেছে নারী-পুরুষ সমতা এবং বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তির ক্ষেত্রে। জলবায়ু অভিযোজনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বাংলাদেশ এখন সৌরবিদ্যুত ব্যবহারকারী হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুওরস (এসএ্যান্ডপি)-এর কাছ থেকে ২০১০ সাল হতে বাংলাদেশ ঋণমানের একই রেটিং পেয়ে আসছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৪৫টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এডিবি জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ হতে পারে। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এডিবি তাদের আভাসে আরও বলছে, বাংলাদেশ ২০১৯ ও ২০২০ অর্থবছরে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে, যা হবে একটি নতুন রেকর্ড। বাংলাদেশ এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলে দ্রুততম প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত রাখবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা শক্তিশালী। বাংলাদেশ বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে রাখতে পেরেছে। দেশে উৎপাদন ও অবকাঠামো নির্মাণের হার বেড়েছে। একইসঙ্গে ভোক্তা ও রফতানি বেড়েছে। আবার বিদ্যুত উৎপাদনসহ কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি দেখিয়েছে। এসব কারণে বেসরকারী খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকার পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির আকার দ্রুত বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বের দ্রুত বেড়ে ওঠা অর্থনীতির শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতি ও রফতানি নির্ভর শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির কারণে এ অর্জন করেছে। এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগ হতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল থাকতে হবে এবং আর্থিক খাত, ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ ও অবকাঠামো শূন্যতা পূরণের মতো খাতগুলো সংস্কার করতে হবে। স্পেকটেটর ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী, গত ১০ বছরে মোট ২৬টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ। এ সময়ে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনের ব্যাপ্তি ঘটেছে ১৮৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার ছিল ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বেড়ে চলতি বছরে দাঁড়িয়েছে ৩০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে ৮.১৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, রফতানি আয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় তিনগুণ বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৪০.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় সাড়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯০৯ মার্কিন ডলার হয়েছে। ২০০৫-০৬ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে বিনিয়োগ জিডিপি’র ২৬ শতাংশ হতে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারী বিনিয়োগ ৫ গুণ বেড়ে হয়েছে ৭০ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৯ গুণ বেড়ে হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারী বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও বেসরকারী বিনিয়োগে বিশেষ করে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে মূলত সহজে ব্যবসা সূচকে পিছিয়ে থাকার কারণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গত কয়েক বছর ধরেই এ সূচকের উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। সরকার চাইছে এ সূচক ১০০ এর নিচে নামিয়ে আনতে। এই প্রচেষ্টার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে বেশি ভালভাবেই। বিশ্ব ব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচকে উন্নতির তালিকায় সেরা ২০টি দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলস্বরূপ এ স্বীকৃতি মিলেছে। আগামী ২৪ অক্টোবর প্রকাশ করা হবে সেরা ব্যবসাবান্ধব দেশের মূল তালিকা। এর আগেই এ তালিকায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যাওয়া ২০টি দেশের নাম প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাটি। বিশ্ব ব্যাংকের ওয়েবসাইটে নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে প্রকাশিত দেশগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সেখানে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। বিদ্যুত-সংযোগ ও ঋণপ্রাপ্তির দিক থেকেও বাধা কমেছে। দেশে নতুন কোম্পানি নিবন্ধনে খরচ কমেছে। ডিজিটাল সনদ পেতে কোন ফি দিতে হচ্ছে না। শেয়ার ক্যাপিটালের ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন ফিও কমানো হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় নতুন বিদ্যুত-সংযোগ পেতে জামানত কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে, এ খাতের জনবল বৃদ্ধি ও ডিজিটালকরণে বিনিয়োগ বেড়েছে। বাংলাদেশ ঋণ তথ্য ব্যুরোর (সিআইবি) কার্যক্রমের আওতা বেড়েছে। সেখানে এখন যেকোন পরিমাণের ঋণের পাঁচ বছরের তথ্য সহজেই পাওয়া যায়। ব্যবসা সহজীকরণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম কেন্দ্র হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গতবছরই ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা এদেশে লগ্নি করেছে বিদেশীরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলছেন, বিনিয়োগের জন্য বেশ সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চীন, জাপানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের বিনিয়োগে কয়েক বছরের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসবে অর্থনীতিতে। বিনিয়োগে সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থানে থাকায় বাংলাদেশে গত বছর দু’য়েক জাপানের হোন্ডা কিংবা চীনের রাষ্ট্রীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেদারছে টাকা লগ্নি করেছে এদেশে। গতবছরই বলা চলে বিদেশী বিনিয়োগের হার বেড়েছে অনেকটা রকেট গতিতেই। ২০১৭ এর সঙ্গে তুলনায় দেখা যায় এই প্রবৃদ্ধি হার ৬৮ শতাংশ। বেশ ঘটা করে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে সৌদি আরব। ইউরোপ থেকেও কয়েকটি নামীদামী শিল্প জায়ান্ট যোগাযোগ করছে নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও বাংলাদেশে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। ব্যবসা বা শিল্প কারখানা চালু করতে একই স্থানে সবধরনের সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অঞ্চল গড়ে তুলবে সরকার। বেজার চেয়ারম্যান বলছেন, অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনবে এইসব অঞ্চল। বাংলাদেশের সঙ্গেই শতকোটি মানুষের বাজারের দেশ ভারত। একটু এগুলেই চীন। সঙ্গে আছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া-কম্বোডিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি শক্তিশালী অর্থনীতি। এই অবস্থানের সুযোগ নিতেই বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী নাম করা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। একদিকে সস্তা শ্রমিক আর বিদ্যুত ও জ্বালানিতে সরকারের অব্যাহত বিনিয়োগ। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের দৃশ্যমান অগ্রগতি। নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এর একটা সুফল পাওয়া যাবে খুব শীঘ্রই। কয়েকটি সূত্র জানায়, দিন কয়েক আগে জাপানের অন্তত ৮০ জন নামকরা শিল্পপতির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশী নীতিনির্ধারকদের। দেশে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ থাকার কারণে আর্থিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও জোরালো প্রবৃদ্ধি ও বিপুল উন্নয়ন চাহিদার কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতোই ‘স্থিতিশীল’ থাকবে বলে আভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুওরস (এসএ্যান্ডপি)। বাংলাদেশের ঋণমান দীর্ঘ মেয়াদে ‘বিবি-’ ও স্বল্প মেয়াদে ‘বি’ বহাল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক সেবাদাতা সংস্থাটি। দ্রুততম সময়ে দারিদ্র্য হ্রাসকারী দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২১ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ হতে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকে পেছনে ফেলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম। মূলত প্রতিবন্ধী, অটিজম ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সম্পৃক্ত করার কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে এ ধরনের প্রায় ১৬ লাখ ৪৫ হাজার ব্যক্তি নিয়মিত সরকারী ভাতা পাচ্ছেন। সবমিলিয়ে, এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে সুবিধা পাচ্ছেন প্রায় ৮৯ লাখ মানুষ। এ জন্য বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ এবং জিডিপি ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। মূলত এই কর্মসূচীই দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য হ্রাসে বিরাট সহায়তা করছে। ২০১৫ সালে করা সরকারী হিসাবে এই সুরক্ষা কর্মসূচীর মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে। খাদ্য উৎপাদনের কারণেই স্বাধীনতা পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার ভাষায় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন উদ্বৃত্ত খাদ্যে উপচে পড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সাথী করে বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ হওয়ার স্বাদ পায়। ২০০৮-২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পরিণত হয় খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে। এ অর্থবছরে দেশে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় এক লাখ ৪৬ হাজার টন। ওই বছর তিন কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্যের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন দাঁড়ায় তিন কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন। অর্থাৎ প্রায় এক লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত হয়। পরের বছর ২০০৯-১০ অর্থবছরে খাদ্য উদ্ধৃত্তের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় লাখ ৩৯ হাজার টন। এ বছর খাদ্য উৎপাদিত হয় তিন কোটি ৩৮ লাখ ৩১ হাজার টন। চাহিদা ছিল তিন কোটি ৩১ লাখ ৯২ হাজার টন। সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম মাসেই অন্যতম কৃষি উপকরণ সারের মূল্য এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনে। ভর্তূকি দেয় সেচে। কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ সররবরাহ করে। এর ফলে দেশে খাদ্যশস্যের আবাদ বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন বেড়ে যা। গত ১০ বছর ধরে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ক্রমাগতভাবে কৃষিখাতে নীতিগত সমর্থন বাড়িয়েছে। সার বীজ জ্বালানি ও কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে কৃষকদের দেয়া হয়েছে প্রণোদনা ও ভর্তূকি সুবিধা। আমন ও আউশ আবাদে প্রান্তিক কৃষকদের বিনামূল্যে সার ও বীজ দেয়া হয়েছে। ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্যের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার কোটি সাত লাখ ১৪ হাজার টন। চাল উৎপাদন হয়েছে চার কোটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার টন। ফলে দানাদার খাদ্যেও দেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই উদ্বৃত্ত খাদ্য শস্য দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার অবস্থাকে আরও সুসংহত করেছে। সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের সাফল্য অভূতপূর্ব। এসব সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও অনেক এগিয়ে গেছে। নারী-পুরুষ সমতা এবং বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তির মাইলফলক অর্জনের পর বাংলাদেশ এখন মানসম্মত শিক্ষার প্রসারে মনোনিবেশ করেছে। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার এখন ৫০ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নেমেছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে বিশ্বের যে ১০টি দেশ ‘বলিষ্ঠ অগ্রগতি’ অর্জন করেছে তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তৈরি করা নতুন হিসাব অনুযায়ী, আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে অধিক মা-শিশুরা বেঁচে যাচ্ছে। ২০০০ সালের পর থেকে শিশুমৃত্যু প্রায় অর্ধেক এবং মাতৃমৃত্যু এক-তৃতীয়াংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার দেশের সকল নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এসব কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগণকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। সেবাগ্রহীতাদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। এসব কর্মসূচীর ফলেই মাতৃমৃত্যুর হার, নবজাতক ও শিশু মৃত্যুহার, পুষ্টিহীনতা, খর্বকায়তা ও ওজনহীনতার মতো সমস্যাসমূহ ক্রমাগত কমছে। পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মূলনীতিকে উপজীব্য করে বাংলাদেশ রূপপুরে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যে ৯৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধার আওতায় এসেছে। অথচ ২০০৯ সালে দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পেত। ওই সময় দেশে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫৭ মেগাওয়াট। অথচ এর বিপরীতে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বিদ্যমান বিতরণ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ এখন বিদ্যুত উদ্বৃত্তের দেশ। বিদ্যুত সরবরাহের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য এসেছে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সরকারের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে ৬০ লাখের বেশি গৃহস্থালিতে ইতোমধ্যেই সৌর বিদ্যুত ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুতের এক দশমিক পাঁচ শতাংশ আসছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জ্বালানি কর্মসূচীতে সফল হিসাবে আখ্যায়িত করে বলছে, বাংলাদেশের রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সফল নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচী। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে ১০ শতাংশের জনগণের মধ্যে বিদ্যুত সরবরাহ করা হচ্ছে। এই সাফল্য অর্জন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, ‘গত ১০ বছর ধরে আমরা প্রগতিশীল ও সময়োপযোগী নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছি, যা আমাদের এনে দিয়েছে অসামান্য সাফল্য।’ তিনি বলেন, ‘দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তার সরকার নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া উন্নয়ন কৌশল হিসেবে দারিদ্র্য দূরীকরণ, টেকসই প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সুরক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেয়া হচ্ছে।’ বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন কৌশল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা, শোভন কর্ম পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বৈষম্য দূরীকরণই এই কৌশল। বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে সমাজের অনগ্রসর ও অরক্ষিত অংশের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছে। অর্থ, খাদ্য, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, সঞ্চয় ও সমবায়-এর মাধ্যমে এই সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারী সরকারগুলো দেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন করে এগিয়ে চলা শুরু হয়। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সরকার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে বলেই দেশের অর্থনীতিতে এত রমরমা অবস্থা। এখন আর কোন মানুষ না খেয়ে থাকে না। গড় আয়ুও বেড়েছে। বিদ্যুত সুবিধা পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে সম্মিলিতভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মহলে প্রায়ই ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, সততা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায়। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে ছাড়িয়ে যাব। ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৬তম দেশে হিসেবে আবির্ভূত হবে। আর আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন পর্যায়ে উন্নীত হবে, এমন গতিশীলতা আসবে। যার ওপর ভিত্তি করে আমরা উন্নত হব। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১০ বছরে পৃথিবীর অর্থনীতিতে আমাদের যে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে তাতে বিশ্বের মধ্যে আমরা এক নম্বরে। এটি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থনীতির এই ভিত করে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের আজকের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে এর পেছনে আমাদের অনেক ঋণ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের ঋণের পরিমাণ বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। আমরা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মাসেতু করতে সক্ষম হয়েছি। দারিদ্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে ২১ শতাংশ দারিদ্র্য থাকলেও আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের দারিদ্র্যসীমা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হবে। তখন কোন দরিদ্র মানুষ থাকবে না। আর ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর বিশ্বের সেরা ২০টি দেশের একটি হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, একসময় বলা হতো বাংলাদেশের কোন ভবিষ্যত নেই। বাংলাদেশ নামের দেশটি কখনো অর্থনীতিতে এগুতে পারবে না। একদিন বাংলাদেশকে নিয়ে যারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন, ব্যঙ্গ করে কথা বলতেন তারাই আজ বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি উজ্জল নক্ষত্র। আর এটি সম্ভব হয়েছে আমরা একজন ভাল নেতা পেয়েছি। তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
×