ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শতাধিক নদী বিলীন ॥ মৃত্যুমুখে অনেক

প্রকাশিত: ১০:২০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শতাধিক নদী বিলীন ॥ মৃত্যুমুখে অনেক

শাহীন রহমান ॥ জালের মতো বিছিয়ে থাকা এই দেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এখনও গরমিল রয়েছে। তবে সংখ্যা নিয়ে গরমিল থাকলেও অধিকাংশ নদীই যে হুমকির মুখে এ বিষয়ে কারোর মধ্যেই দ্বিমত নেই। তারা বলছেন, একদিকে উজানে বাঁধ নিয়ে একতরফা পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে দেশে নদ-নদীর ভবিষ্যত নিয়ে যেমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে অপরদিকে তেমনি পলি পড়ে প্রবহমান অনেক নদী ভরাট হয়ে পড়ছে। এছাড়া দখল দূষণের কারণেও হুমকির মুখে পড়েছে অনেক নদী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব কারণে স্বাধীনতার পরে দেশে এখন পর্যন্ত শতাধিক নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। মৃত্যুর প্রহর গুনছে আরও অনেক নদী। আজ বিশ্ব নদী দিবস। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রবিবার সারাবিশ্বে এই নদী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। তবে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের নদ নদী সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন। সরকারী পর্যায়ে এই দিবস পালনের তেমন গুরুত্ব নেই বললেই চলে। শুধু বেসরকারী কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন নদী বাঁচাতে সারা বছরই আন্দোলন করে আসছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। কানাডার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও নদী অন্তঃপ্রাণ ব্যক্তি মার্ক এ্যাঞ্জেলোর উদ্যোগে বিশ্বের নদী দিবস পালন করা হয়ে থাবে। ২০০৫ সাল থেকেই সারা বিশ্বে এটি পালিত হয়ে আসছে এবং ক্রমশ এই দিবসের পরিচিতি বাড়ছে। বিশ^ব্যাপী নদী দিবস পালনের লক্ষ্য সম্পর্কে এই কর্মসূচীর ‘বৈশি^ক পরিষদ’ এর চেয়ারম্যান মার্ক এ্যাঞ্জেলো বলেন, ‘বিশ^নদী দিবস পালন হচ্ছে নদীর বা সারা পৃথিবীর পানি প্রবাহসমূহকে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করা। এই দিনটিতে নদীর বহুমুখী গুরুত্বকে তুলে ধরা, নদীর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা ও নদীর জন্য অধিক অভিভাবকত্ব নিশ্চিত করা। সারা বিশ্বেই নদীকে সুসংগঠিত হুমকির মোকাবেলা করতে হয়। একমাত্র নদীরক্ষা কাজে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই সতেজ নদী নিশ্চিত হতে পারে। পরিবেশ সংগঠন বাপাসার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের নদীগুলো দ্রুত মারা যাচ্ছে, ওদের বাঁচাতে চাই। নদী ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য-উন্নয়ন-চলাচল-পরিবহন-অর্থনীতি-রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-গান-সংস্কৃতির মূল চালিকাশক্তি। তাই নদী যদি বিনষ্ট হয় তা হলে আমরাও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হব। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সর্বোচ্চ সংকটের দেশও বাংলাদেশ। নদীরক্ষা আমাদের বেঁচে থাকার ও ভাল থাকার প্রধান চাবিকাঠি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি বা প্রবাহ না থাকায় বিলীন হওয়ার পথে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নদী। বর্ষাকালে প্রবাহমান থাকা অর্ধেকের বেশি নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। সারা বছরই চলে চাষাবাদ। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে এগুলোকে আর নদী বলে মনে হয় না। আবার অনেক নদী বিলুপ্ত হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে গেছে। মৃত্যুর প্রহরও গুনছে অনেক নদী। এর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোনার মগড়া, কংশ, সোমেশ্বরী, যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতি, বেতনা, মুক্তেশ্বরী, কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরী, খুলনার রূপসা, শিবসা, ডাকি, আত্রাই, ফরিদপুরের কুমার, বগুড়ার করতোয়া, কুমিল্লার গোমতি, পিরোজপুরের বলেশ্বর, রাজবাড়ির হড়াই, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, বান্দারবানের সাঙ্গু, খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, নওগাঁর আত্রাজ এবং জামালপুরের ঝিনাই নদী। যে নদীগুলোকে কেন্দ্র করে রাজধানীর গোড়াপত্তন হয়েছিল সেই বুড়িগঙ্গাসহ এর চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এবং ধলেশ্বীর নদী দখল দূষণের করুণ অবস্থার শিকার। এগুলোর অস্তিত্বও হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদী মৃত্যুর পেছনে যেমন প্রাকৃতিক কিছু কারণ রয়েছে পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কারণে এসব নদী আজ অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। ফারাক্কা বাঁধ এবং তিস্তা ব্যারাজ এবং উজানে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার কারণে অনেক নদীর মৃত্যু ঘটছে। দেশের মধ্যে থাকা নদীগুলোতে চলছে সীমাহীন দখল উৎসব। তারা বলছেন মানুষ তার লোভ বা মুনাফার কারণে শুধু নদীর গতিপথই বদলে দিচ্ছে না। আঘাত করছে নদীগুলোর প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর। বুড়িগঙ্গা তুরাগ বংশী, বালু লৌহজঙ্গ এবং শীতলক্ষ্যা নদীর দুধারে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে পড়ছে এসব নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় এসব নদী প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। শুধু ফারাক্কার প্রভাবই নয়, উজানে বিভিন্ন নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া, প্রতি বছর বর্ষায় বিলিয়ন টন পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট নানা কারণেও ভরাট হয়ে প্রবাহ শূন্য হয়ে পড়ছে নদীগুলো। স্বাধীনতার পর গত তিন দশকের বেশি সময়ে নদীগুলো বেশি করুণ অবস্থার শিকার হয়েছে। তবে মূলত ফারাক্কা বাঁধের কারণেই নদীগুলো এত তাড়াতাড়ি মরতে বসেছে। এছাড়া নদীতে প্রতি বছর এত পরিমাণ পলি জমছে যে তা পানির অভাবে বহন করে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটারের তিস্তার অববাহিকায় নদী ভিত্তিক জীবনযাত্রা ও জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ এ প্রকল্পের। এর আওতাধীন ৬ হাজার ৫শ’ হেক্টর বোরো চাষের জন্য শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। তিস্তায় পানি না থাকায় এ অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, অখিরা, দুধকুমার বুড়িতিস্তাসহ ছোট বড় প্রায় ৩৩ নদী ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রমত্ত পদ্মায়ও দেখা দেয় ধুধু বালুচর। লঞ্চ এবং ফেরি চলাচল অব্যাহত রাখতে ড্রেজিং করে চ্যানেল তৈরি করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে পদ্মায় পানি না থাকাতে শুধু পাবনা জেলাতেই শুকিয়ে যাচ্ছে ২০ নদী। এসবের মধ্যে কিছু কিছু নদী একেবারে বিলীন হয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম নিয়েছে। যমুনার বুকে জেগে উঠে শত শত ডুবোচর। পদ্মা যমুনায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সিরাজগঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শাখা নদী করতোয়া, ইছামতি, বাঙালী নদী, ফুলজোড়, দইভাঙ্গা, হুরসাগর ও বড়াল শুকিয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়। কুড়িগ্রামের অনেক নদীর অস্তিত্ব এখন আর নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদীতে বিশাল চর জেগে সেচ সুবিধা হুমকির মুখে। তিস্তায় পানি না থাকায় বগুড়ার অসংখ্য খাল, বিল পানি শূন্য হয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর। জয়পুরহাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চারটি নদীই ভরাটের সম্মুখীন। নওগার এক সময়ে খরস্রোতা আত্রাই মৃতপ্রায়। ঠাকুরগাঁও জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৪টি নদীর মধ্যে ১১টি নদী মৃত। পানির অভাবে এসব নদী শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়। টাঙ্গর, নাগর, কুলিক ও তীরন নদীর মাঝখান দিয়ে নালার মতো পানি প্রবাহিত হয়। পানি না থাকায় পাবনা জেলায়ই শুকিয়ে যাওয়া নদীর তালিকায় রয়েছে কমলা, শাসসাডাঙ্গী, ইছামতি করতোয়া, ভাঙ্গুড়া, রত্নবাড়ি, টেপাবাড়ি নদী। অস্তিত্ব সংকটে ঐতিহাসিক চলনবিল। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে পানি স্বল্পতায় হুমকির পড়ে কুষ্টিয়ায় অবস্থিত অন্যতম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষ বা জিকে প্রজেক্ট। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদীই মরা খালে পরিণত হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি নদী ও খাল বিল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ইরি-বোরো চাষ ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরী, পুরাতন ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা ও ইছামতি নদী আজ মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুম ছাড়া এসব নদী বছরের অধিকাংশ সময় পানি শূন্য থাকে। উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে ফেনী নদী। খুলনা বিভাগের পাঁচটি নদী মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনার হামকুড়া, সাতক্ষীরার মরিচাপ, কুষ্টিয়ার হিসনা, যশোরের মুক্তেশ্বরী ও হরিহর নদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নদী গবেষণায় ইনস্টিটিউটের জরিপের হিসাব অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের ১৯টি নদীর পানিই শুকিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুম আসার আগে এ অবস্থা চলতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জালের মতো বিছিয়ে থাকা এদেশের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয় দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এরপর ২০১১ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আরও খানিকটা অনুসন্ধান করে নদ-নদীর সংখ্যা উল্লেখ করেছে ৪০৫টি। এটাই এখন সরকারী হিসাব ধরা হয়। কোন কোন সূত্রমতে, নদীর সংখ্যা ২৩০টি। বেসরকারী হিসাবে দেশে, নদী সংখ্যা ৭শ’ থেকে ২ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদীর প্রকৃত সংখ্যা যাই হোক না কেন সব নদীই আজ হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। তারা বলেন, নদীর পানির উৎসমুখ বন্ধ করে, ভরাট করে, দখল করে নদীকে মেরে ফেলছি। নদীর সঠিক পরিসংখ্যান থাকলে কেউ সহজে মেরে ফেলতে পারত না। নদীর যে কোন পরিবর্তন সূচিত হলে তখন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত। দেশে এমন অনেক নদী আছে, যেগুলোকে সরকারী নদীর তালিকায় আনা হয়নি। জমির পুরনো দলিলে নদীর উল্লেখ আছে, এ রকম শত শত নদী চোখের সামনে দখল হচ্ছে। অনেক মাঝারি এবং বড় নদীর প্রাণ হচ্ছে আমাদের ছোট ছোট নদী। এই ছোট ছোট নদী উপনদী হিসেবে যুক্ত হয়ে মূল নদীপ্রবাহ বৃদ্ধি করে। এ কারণে ছোট নদীগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই।
×