ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কোন উদ্যোগেই দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না শেয়ারবাজারে

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কোন উদ্যোগেই দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না শেয়ারবাজারে

কাওসার রহমান ॥ কিছুতেই স্থিতি ফিরছে না দেশের শেয়ারবাজারে। কোন উদ্যোগেই দরপতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার। চলতি মাসেই সূচক নেমে এসেছে চার হাজারের ঘরে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পাঁচ কারণে ফিরছে না শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা। কারণগুলো হলো বড় দরপতনের জন্য তারল্য সঙ্কট, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট, কারসাজি, মানহীন কোম্পানির আইপিও এবং সুশাসনের ঘাটতি। বাজারের এই দুর্দশা নিয়ে চিন্তিত অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও। এই অবস্থায় শেয়ারবাজারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। সোমবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে শেয়ারবাজারের বর্তমান মন্দা পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে আলোচনা হবে। একই সঙ্গে মন্দা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নির্ধারণ নিয়েও আলোচনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সদ্যসমাপ্ত সপ্তাহেও পতনের এই ধারা অব্যাহত ছিল পুঁজিবাজারে। একদিন সূচকের উত্থান আর তিন দিন সূচক পতনের মধ্য দিয়ে আরও এক সপ্তাহ পার করল দেশের দুই পুঁজিবাজার। আলোচিত সপ্তাহেও সূচক, লেনদেন ও প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। আর তাতে সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও বিনিয়োগকারীদের পুঁজি অর্থাৎ বাজার মূলধন আরও কমল ১০ হাজার ৯৬২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। গত সপ্তাহে আশুরা উপলক্ষে সরকারী ছুটি থাকায় চার কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। তাতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমেছে ৫ হাজার ১৩৩ কোটি ৩১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমেছে ৫ হাজার ৮২৯ কোটি ৪৩ লাখ ৯ হাজার টাকা। এ নিয়ে টানা তিন সপ্তাহে পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমল ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন কমেছে গ্রামীণফোন কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের। এ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের ১৪ হাজার কোটি টাকার পুঁজি কমেছে। এর আগের দুই সপ্তাহ যথাক্রমে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন কমেছিল ১৩ হাজার এবং ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের পুঁজিবাজারের এই দুর্দশা নিয়ে চিন্তিত অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালও। কারণ দেশের অর্থনীতির চিত্রের সঙ্গে পুঁজিবাজারের এই দুর্দশা ঠিক মিলছে না। দেশের অর্থনীতি নির্বাচনকেন্দ্রিক ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়া সব সূচকের উত্থানের মধ্য দিয়েই ২০১৮-১৯ আর্থিক বছর শেষ হয়েছে। অথচ তার প্রতিফলন নেই দেশের পুঁজিবাজারে। ফলে পুঁজিবাজারের এই দুর্দশা নিয়ে তিনিও চিন্তিত। এই অবস্থায় শেয়ারবাজারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। সোমবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে শেয়ারবাজারের বর্তমান মন্দা পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে আলোচনা হবে। একই সঙ্গে মন্দা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নির্ধারণ নিয়েও আলোচনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। শেয়ারবাজার ভাল করার জন্য সরকার খুবই আন্তরিক। এ জন্য সম্প্রতি বেশকিছু প্রণোদনাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরও শেয়ারবাজার মন্দা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ফলে শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নীতিনির্ধারকরা বেশ বিব্রত। এ পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বৈঠকে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), ডিএসই ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) নেতাদের ডাকা হবে। এ প্রসঙ্গে ডিবিএর সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসবেন এটা আমরা শুনেছি। তবে এ বিষয়ে এখনও কেনে চিঠি পাইনি। কিন্তু বৈঠক হবে এটা নিশ্চিত। তিনি বলেন, বৈঠকে শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। চলমান মন্দা কাটিয়ে উঠতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সে বিষয়ে আমরা প্রস্তাব তুলে ধরব। সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, কেন যে পুঁজিবাজারের এই দুর্দশা, তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। পুঁজিবাজারে সরকারী নানা উদ্যোগ, আশ্বাস, প্রণোদনা কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝেও কেন যে পুঁজিবাজারের এমন দুরবস্থা তা তিনি বুঝতে ব্যর্থ। তবে দুরবস্থার কারণ না বুঝলেও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বিনিয়োগকারীদের ফের আশ্বাস দিলেন অর্থমন্ত্রী। বললেন, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় শুধু শেয়ারবাজার নয়, উন্নয়ন হবে বন্ড মার্কেটেরও। তিনি জানান, বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের টাকার কোন অভাব নেই। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকে দরপতন চলছেই পুঁজিবাজারে। সূচক নেমেছে তলানিতে, ৩৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে। নানা ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে ডিএসইর দ্বন্দ্বও এখন প্রকাশ্য। ফলাফল, গত তিন মাস ধরেই শেয়ার বাজারের বাজার মূলধন কমছে। বিনিয়োগের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সংগ্রহের জন্য বিশ্বব্যাপী আস্থা রাখা হয় পুঁজিবাজারে ওপর। যা প্রতিফলিত করে অর্থনীতির শক্তিমত্তাকেও। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটি হাঁটছে উল্টো পথে। দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক দরপতন সূচক নামিয়ে এনেছে চার হাজারের ঘরে। লেনদেনেও গতি নেই একেবারেই। যার কারণ হিসেবে সামনে আসছে নানা সঙ্কট আর সমস্যার কথা। ডিএসই প্রধান সূচক ৫ হাজার ৭১ পয়েন্ট নিয়ে শুরু হয়েছিল চলতি সেপ্টেম্বরে। কিন্তু ৯ কর্মদিবসে তা কমেছে ১৩৭ পয়েন্ট। যার পেছনে বাজার সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন, তারল্য সঙ্কট, বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব মানহীন প্রতিষ্ঠানের আইপিও, কারসাজি এবং সুশাসনের অভাবকে। ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, আইপিওএর প্রতিবেদনে যদি অসঙ্গতি থাকে তাহলে সেটাতে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিএসই পরিচালক রাকিবুর রহমানের মতে, সঠিক বিনিয়োগকারীরা মার্কেটে বিনিয়োগ করছেন না। স্ট্রং কোন বন্ড মার্কেট নেই বলেও জানান তিনি। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর কাছে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা নেই বলেও জানান ডিএসইর এই পরিচালক। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও পুঁজিবাজার এখনও পিছিয়ে। যা উঠে এসেছে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর কথায়ও। এমন অবস্থায়, বাজারের সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছেন অনেকে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ের ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে ভাল কিছু আশা করতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি পরিবর্তন করা জরুরী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির পক্ষে মত দেন তিনি। দেশের শেয়ারবাজারের এই অব্যাহত দরপতনের ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহের চার কার্যদিবসে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। ফলে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) কমেছে। এ নিয়ে টানা তিন সপ্তাহ ডিএসইর মূল্য আয় অনুপাত কমল। বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত সপ্তাহের চার কার্যদিবসের মধ্যে দুই কার্যদিবস শেয়ারবাজারে বড় পতন হয়। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকসহ বাকি দুটি সূচকেরও বড় পতন হয়েছে। সূচকের এই পতনের মধ্যে বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেয়া ৭৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এতে ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত দুই শতাংশের ওপরে কমছে। গত সপ্তাহের শুরুতে ডিএসইর পিই ছিল ১৩ দশমিক ৩৩ পয়েন্টে, যা সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষেও দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য ৪ পয়েন্টে। অর্থাৎ এক সপ্তাহে ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত কমেছে দশমিক ২৯ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১৮ শতাংশ।
×