ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মংডুতে এসে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে এদের সরানোর নির্দেশ

তমব্রু সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

তমব্রু সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন প্রথমে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্প ও পরবর্তীতে রাখাইন রাজ্যের ধ্বংসযজ্ঞ সফরের পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও বর্বরতার বিবরণ দিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে আবারও মিয়ানমার সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। এ অবস্থায় বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনে বর্তমানে অবস্থানরত ছয় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সেখান থেকে তাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযান জোরদার করেছে। মিয়ানমার সরকারের নির্দেশে সে দেশের সেনা, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী সদস্যরা নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের কোনারপাড়া নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে সরে যেতে মাইকিং শেষে এবার ফাঁকা গুলি ছোড়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে বলে সেখানকার সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। ইতোপূর্বে রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতার কারণে প্রাণ রক্ষায় তমব্রু সীমান্তে ১৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার জমায়েত ঘটেছিল। গত আগস্ট মাস থেকে এই অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পর সেখান থেকে হালনাগাদ প্রায় দশ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। অবশিষ্ট ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা জিরো লাইনে অস্থায়ী বসতি গেড়ে জীবনযাপন করে আসছিল। এপার থেকে কিছু এনজিও সংস্থা তাদের জন্য কিছু ত্রাণ সামগ্রি যোগান দিয়ে আসছিল। ফলে তারা আগামীতে রাখাইনের পরিস্থিতি বুঝে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায়রত ছিলেন। কিন্তু গত শুক্রবার থেকে প্রথমে মাইকিং করে তাদের ওই ভূখ- ছেড়ে চলে যাওয়ার হুঙ্কার দেয়া হয়। সোমবার থেকে থেমে থেমে ফাঁকা গুলিবর্ষণও শুরু করা হয়েছে। এর পাশাপাশি উগ্র মগ সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা বসতি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করাও শুরু করেছে। এছাড়া গত শুক্রবার মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মংডুতে এসে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে তমব্রু সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দেয়ার নির্দেশনাও প্রদান করে গেছে বলে ওপারের সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এরপরই এ ছয় সহস্রাধিক রোহিঙ্গার জীবন নতুন করে অনিশ্চয়তার কবলে পড়েছে। উল্লেখ্য, তমব্রু সীমান্তের এপারের সঙ্গে ওপারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রয়েছে। মঙ্গলবার সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে জানানো হয়েছে, তারা ইতোপূর্বে রাখাইন রাজ্য থেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে এসে তমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে আশ্রয় নিয়ে গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে অবস্থান করে আসছে। এপার থেকে কিছু এনজিও সংস্থার সহায়তায় তাদের ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো হতো। তাদের আশা ছিল রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি শান্ত হলে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যাবে, এ আশায় সীমান্তের জিরো লাইনে (মিয়ানমার অভ্যন্তরে) তাঁবু টাঙ্গিয়ে সাড়ে পাঁচ মাস ধরে অবস্থান করেছে তারা। শুক্রবার থেকে তিন দিন মাইকিং শেষে সোমবার সন্ধ্যায় ফাঁকা গুলি ছুড়েছে দেশটির সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি)। মাইকিং করার সময় তাদের ভূখ- ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলা হলেও মঙ্গলবার সকালে পুলিশের টহল দল এসে ওই রোহিঙ্গাদের এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। টহল পুলিশ তাদেরকে বলেছে, হয় ওপারে (বাংলাদেশ) নয়তো রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে। কিন্তু রোহিঙ্গারা বলছে রাখাইনের পরিস্থিতি এখনও আতঙ্কজনক। এছাড়া ফিরে যাওয়ার পথে রয়েছে মগ সন্ত্রাসীদের উৎপাত। এ অবস্থায় তাদের জীবন বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে। তারা বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার নজরে আনার জন্য আগ্রহী সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাদের মতে, রাখাইন রাজ্যে ফিরে গেলে তাদেরকে ক্যাম্পে রাখা হবে, যেখানে জীবন বাঁচানো দায়। অনাহারে অর্ধাহারে মরতে হবে। এ অবস্থায় সকলের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ভর করেছে। সূত্র জানায়, তিন দিন ধরে মাইকিংয়ে তারা বলেছিল, তোমাদের (রোহিঙ্গাদের) মিয়ানমারের ভূখ- ত্যাগ করতে হবে। বর্তমানে বলা হচ্ছে- সীমান্ত খালি করে মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলে যেতে পারবে। জিরো লাইনে আশ্রিত রোহিঙ্গা ছৈয়দ আকবর জানিয়েছেন, শুক্রবার মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মংডু এসে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ওইদিন বিকেলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে রোহিঙ্গাদের জানায়, তোমরা অবিলম্বে মিয়ানমারের ভূখ- ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও। নইলে তোমাদের অবস্থা খারাপ হবে। মিয়ানমারের সেনা ও সেখানকার উগ্রপন্থী সশস্ত্র রাখাইন যুবকরা পুলিশের সহযোগিতায় কোনারপাড়া এসে মঙ্গলবার বিকেলে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে ইট, পাথর, ঢিল ছুড়ে মারছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ এস এম সরওয়ার কামাল জানান, এই বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি তবে কোন ধরনের নির্দেশ পাওয়া যায়নি। নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া প্রায় ৬ হাজার ৯৩৯ জন রোহিঙ্গাকেও স্থানান্তরের ব্যবস্থা হতে পারে বলে আশা করছি। কক্সবাজার বিজিবি এক কর্মকর্তা জানান, জিরো লাইনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের চাপ দেয়ার বিষয়টি আমরা জেনেছি। আমরা সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করছি। এ ছাড়াও সীমান্তে বিজিবি সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে তিনি জানান। উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্টের পর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোনারপাড়াসহ নাইক্ষ্যংছড়ি সদর সাপমারা ঝিরি, বড় ছনখোলা, দোছড়ি বাহির মাঠ এলাকায় অন্তত ১৬ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা শূন্যরেখায় (বাংলাদেশ অংশে) আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাদের রেডক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন এনজিও ত্রাণ সামগ্রীর পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা প্রদান শেষে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু তুমব্রু সীমান্তের ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার অংশে অবস্থান করায় তাদের কোথাও সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। আরও এক এনজিও কর্মীর মৃত্যু ॥ উখিয়ায় শারমিন আক্তার দিপ্তি নামে এক এনজিও কর্মী অজ্ঞাত রোগে মারা গেছেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার মারা যান তিনি। এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের কর্মী হিসেবে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরিরত রত্মা পালং ইউনিয়নের রুহুল্লারডেবা গ্রামের আহমদ সোলতানের কন্যা শারমিন আক্তার দিপ্তি (১৮)। জানা যায়, উখিয়ার এনজিও ব্র্যাকের কর্মী কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্র্যাক পরিচালিত শিশু বিকাশ শিক্ষা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন দিপ্তি। গত কয়েক দিন ধরে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে আরও একজন ব্র্যাকের কর্মী একই কায়দায় মারা যায়।
×