ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীত কখনও আনন্দের কখনও কষ্টের, ফাল্গুন কি খুব দূরে...

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

শীত কখনও আনন্দের কখনও কষ্টের, ফাল্গুন কি খুব দূরে...

সমুদ্র হক ॥ শীত কখনও আনন্দের, কখনও কষ্টের। তারপরও বাঙালীর ঋতুবৈচিত্র্যের শীত। প্রকৃতিকে সবুজ করে দেয়। সবুজ হয়ে ওঠে মানুষের মন। কবিগুরু বরীন্দ্রনাথের কথায়- ‘শীতের হওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। পাতাগুলো শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে। উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে, তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে। শূন্য করে ভরে দেয়া যাহার খেলা তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা’। শীত জানিয়ে দেয় সামনেই বসন্ত। অপেক্ষায় থাকতে হয়। ‘ইফ উইন্টার কাম্স ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড!’- এই কবিতা ইংরেজ কবি পার্সি বিসি শেলীর। ভাবার্থ- শীত যদি আসে, ফাল্গুন কি তবে খুব দূরে! মোটেও না। শীতের পরই মধুর ভাব নিয়ে আসে বসন্তের ক্লাসিক্যাল সুর। এবারের শীতের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ফাগুনের রূপ। ডিসেম্বরে শৈত্যপ্রবাহ বইছে। এই হিমেল বাতাসের সঙ্গে মৃদুভাবে ফাগুনের ধুলিঝড় উড়ছে। যদিও আবহাওয়া বিভাগ বলছে শীতে কয়েক দফা শৈত্যপ্রবাহ বইবে। তারপর বসন্তের দিনগুলি এসে যাবে। শীতের সাক্ষী কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে ফের আত্মপ্রকাশ রোদ্দুরে। দেখে আশ মেটে না। প্রকৃতির মিলন মেলায় কতই না বৈচিত্র্য। কতই না রোমান্টিকতা। প্রকৃতির সঙ্গেই আনন্দ বেদনা নিয়ে মানুষের বাস। পিবি শেলী লিখেছেন ‘সুইটেস্ট সংগস আর দোজ দ্যাট টেল অব এ স্যাডেস্ট থট (সেগুলোই মিষ্টি সুরের গান যা ব্যথিত ভাবনা তুলে ধরে)’। শীতও বোধ হয় তেমনই। শীতকালের আনন্দের সুরে কখন যে শীতের কষ্টে কাবু হয়ে পড়ে মানুষ। শেলীও শীতের মধ্যেই বসন্তকে খুঁজে পেয়েছেন। পথ দেখিয়েছেন প্রণয়েরও। বাঙালীর ঋতুবৈচিত্র্যে প্রকৃতিকে লালনের মধ্য দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় নিসর্গ। শীতের কুয়াশা মেঘ জানান দেয় সামনেই রোদেলা দিনের মায়া। প্রতিটি ঋতু মানব জীবনের চলার পথকে এগিয়ে দিতে নানা প্রতিকূলতা নিয়ে আসে। এই প্রতিকূলতা যারা উত্তীর্ণ হতে পারে তারাই পায় সুখ ও শান্তির পরশ। প্রকৃতি নিয়ে দেশে দেশে কত কবি, কত লেখক সাহিত্যিক কত কিছুই না বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতিকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় উপন্যাসে টেনে এনেছেন প্রকৃতি। বিশ্বের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলুলয়েডের ফিতায় সেই প্রকৃতিকে তুলে এনেছেন। শীতের বর্ণনায় কবি সেক্সপিয়র বলেছেন ‘হে শীতের বাতাস, তুমি প্রবাহিত হতে থাক। তোমার কনকনে শীতের দংশন অত নিষ্ঠুর নয়, যত নিষ্ঠুর মানুষের নির্মমতা ও অকৃতজ্ঞতা।’ বাঙালীর শীতের প্রকৃতিতে প্রথমেই আসে পিঠা পুলি। কত বাহাড়ি পিঠাই না বানান হয় বাঙালীর ঘরে। সংস্কৃতির এই পথেই শহরে বসে পিঠা মেলা। খেজুর গাছের মাথায় ঝুলতে থাকে কলসি। রাতভর টুপটুপ করে রস গড়িয়ে কলস ভরে ওঠে। খেজুর গাছের সঙ্গে শীতের মমত্ব বেশি। শীতকে নিয়ে কত যে কথা....। শীত মৌসুমেই গ্রামের পথে প্রান্তরে নজর কেড়ে নেয় হলুদে ছড়ানো প্রান্তরজুড়ে সরিষা ক্ষেত। গোধূলী বেলা ঘন কুয়াশায় ছেয়ে টেনে নেয় সন্ধ্যায়। দ্রুত নেমে আসে রাত। শিয়ালের ডাক ভেসে আসে। লক্ষ্মী পেঁচা রাতের প্রহর গুনতে হিসাব গড়মিল করে ফেলে। একটা সময় হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলে শীত এলেই মানুষের দুর্দশা ও জবুথবু হওয়ার নানা চিত্র তুলে ধরা হতো। আজ আর সেই অবস্থা নেই। গত কয়েক বছরে দরিদ্রতার হার অনেক কমে যাওয়ায় গ্রামের মানুষের জীবন মান বেড়ে গিয়েছে। ঘরে লেপ কাঁথা কম্বল ও শীতের পোশাকের অভাব আর নেই। জেলা শহর ও উপজেলা সদরের পথের ধারে এবং গ্রামের হাটবাজারে এখন শীতের পোশাক মেলে। গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এবং উন্নত জীবন গড়ায় তারাও এখন আর শীতের ত্রাণ নিতে চায় না। ত্রাণকে অমর্যাদাকর হিসাবেই দেখে। উল্টো শীতকে কি ভাবে মোকাবেলা করা যায় সেই চেষ্টা করে। এভাবেই শীত ফাগুনের আবেশে আনন্দমুখর হয়েই উঠেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফেরেও পড়েছে শীতকালও। কোন বছর শীতের দাপট একেবারেই কম। কোন বছর শীতের তীব্রতা এতটাই বেশি যে পঞ্চাশ বছর আগের রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়। যেমন এবারের শীত। শীতে কাহিল হওয়ার পরও শীতকে নিয়েই মানুষের বাস। শীত মানব হৃদয়ে প্রকৃতির প্রেম এনে দেয়। টেনে নিয়ে যায় ফাগুনের ধারায়....।
×