ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী;###;১৯২২ সালে বেনারসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে প্রথম ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ হয়;###;‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মাতৃভাষা যেন হারিয়ে না যায়’

অসত্যের বিরুদ্ধে সাহিত্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

অসত্যের বিরুদ্ধে সাহিত্য

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহিত্যচর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, সাহিত্যচর্চা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়। যে সমাজ সাহিত্যে যত ঋদ্ধ, সে সমাজ তত আধুনিক। সাহিত্যচর্চা মানুষের মধ্যে শুভবোধের বিকাশ ঘটায়। মানুষের অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে। আর বাংলা ভাষার ওপর নানা সময়ে কতভাবে আক্রমণ হয়েছে। সেই আক্রমণ বারবার প্রতিহত করা হয়েছে। এই উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশই একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করেই আমাদের স্বাধীনতা। শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন নিয়ে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মাতৃভাষা যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যুগের পরিবর্তন হচ্ছে, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে। সভ্যতা অগ্রসরমান। কিন্তু সভ্যতার চাপে মাতৃভাষা হারিয়ে যাক সেটা কখনও আমরা চাই না। তিনি বলেন, সভ্যতা বিকশিত হয়েছে মানুষের সৃজনশক্তিতে। আর এই সৃজনশীলতার বাহন হচ্ছে ভাষা। আর তাই সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিও অনেক সুদৃঢ়। আর সে কারণেই বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের অন্যতম মর্যাদার আসনে আসীন। ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালী হ’- গুরুসদয় দত্তের এই অমিয় বাণীকে ধারণ করে আয়োজিত হচ্ছে এবারের আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বসছে তিন দিনব্যাপী এ সাহিত্য সম্মেলন। এতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের তিন শতাধিক কবি-লেখক-সাহিত্যিক-সমালোচক অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। সাহিত্য সম্মেলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করি, এই আয়োজন একদিকে নতুন সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করবে, অন্যদিকে নিজেদের সামর্থ্যকে তুলে ধরবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সম্মেলন আয়োজক পরিষদের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষ, জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য ও ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি সত্যম রায় চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন এই সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়কারী নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন পরিষদের এ আয়োজনে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ সহযোগিতা করছে। বিষয়ভিত্তিক ছয়টি সেমিনারের সঙ্গে সম্মেলনে থাকছে দুটি মঞ্চনাটক, সঙ্গীত, গল্প ও কবিতা পাঠ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও আবৃত্তির আয়োজন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। সেই সম্মেলনের উদ্বোধনে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ১৯২২ সালে ভারতের বেনারসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে প্রথম ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ হয়। এরপর ৯৪ বছরে ৮৯ বার এ সম্মেলন বসেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে হবে। যুক্তিকে আরও শাণিত করতে হবে। মানবিক বোধকে উচ্চকিত করতে হবে। আর এজন্য সাহিত্যচর্চার কোন বিকল্প নেই। কেননা, সাহিত্য মানুষকে যুক্তিবাদী ও সংবেদনশীল করে তোলে। বহুমাত্রিক সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। বাংলা সাহিত্যকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সব বাঙালীর মনে রাখতে হবে, আমাদের শেকড় হচ্ছে বাংলা। আমরা বাঙালী এটি ভুলে গেলে চলবে না। শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক পরিসরে টিকে থাকতে হলে আমাদের বাঙালিত্ব নিয়েই লড়াই করতে হবে। কারণ বাঙালী মানে দুরন্ত সাহস; বাঙালী মানে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা; বাঙালী মানে অজেয়কে জয় করার অদম্য ইচ্ছা। সাহিত্য সম্মেলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করি, এই আয়োজন একদিকে নতুন সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করবে, অন্যদিকে নিজেদের সামর্থ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরবে। অতীতের বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষার ওপর শাসকগোষ্ঠীর খড়গ নেমে এসেছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কেবল বাংলা ভাষা নয়, বাংলা অক্ষরও মুছে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। বারবার ভাষার ওপর আক্রমণ এসেছে। কিন্তু সবগুলো আক্রমণই প্রতিহত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সূচনার মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতি স্বাধীনতা লাভ করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একুশের পথ বেয়েই বাঙালী জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারী ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছিল। আমরা এর জন্য ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, পাকিস্তানী শাসকরা বাংলা ভাষাকে কেড়ে নেয়ার জন্য নানাভাবে বাধা দিয়েছে। কেবল বাংলা ভাষা নয়, বাংলা অক্ষরও মুছে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আরবী হরফে বাংলা লিখতে হবে। আমাদের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী কেউ তা মানেননি। রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব এলো, সেটাতেও বাধা দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না বলে সমন জারি করে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকরা। এরপর আঘাত আসে নজরুলের ওপর। তাঁর কবিতায় সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন আনার অপচেষ্টা হয়। বাংলা সাহিত্যকে কলুষিত করার চেষ্টা করা হয়। বারবার ভাষার ওপর আক্রমণ এসেছে। কিন্তু সব আক্রমণই প্রতিহত করা হয়েছে। এসব বাধা জয় করেই আমরা বাংলা ভাষা পেয়েছি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যারা রক্ত দিয়েছেন তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউনেস্কো বাংলা ভাষার সম্মানে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এই মাতৃভাষা যেন হারিয়ে না যায়, তার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ার কাজ শুরু করি। এখানে ভাষাকে জানা, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে গবেষণা করা হয়। সারা বিশ্বের মাতৃভাষা সেখানে সংরক্ষণ হবে, সেসব ভাষা নিয়ে গবেষণা হবে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। আমিও যতবার ভাষণ দিয়েছি, ততবারই বাংলায় দিয়েছি। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততা ও নেতৃত্বের ইতিহাস বিস্তারিত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট ঘোষণার দিন। সে সময় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। তখনকার ছাত্রসমাজ সেটি ভাঙ্গার কারণে গুলিতে শহীদ হন ছাত্রনেতারা। পাকিস্তান নামের দেশটাতে আমরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু আমাদের অধিকার কেড়ে নেয়ার সবসময়ই চেষ্টা করা হয়েছে। নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতায় ‘মহাশ্মশান’ এর জায়গায় ‘ গোরস্তান’ দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ এটাকে বদলে ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি’ বানানোর চেষ্টা হলো। বাংলা সাহিত্যকেও তখন কলুষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ করে তারই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন দিন কোন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। আমি সারাজীবন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করেছি, এখনও করছি। ভবিষ্যতে যা কিছু করব জনগণকে নিয়েই করব।” বঙ্গবন্ধুর এমন বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ মানুষ। যেহেতু আমার পিতা দেশ স্বাধীন করে গেছেন, আমি সব সময় এটাই মনে করি যে, এই দেশকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলব। বাঙালী যেন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে চলতে পারে- এটাই আমার লক্ষ্য।’
×