ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়ান প্লানেট সামিটে প্রধানমন্ত্রী

নিরাপদ পৃথিবী গড়তে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চাই

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

নিরাপদ পৃথিবী গড়তে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চাই

বিডিনিউজ ॥ ফ্রান্সের প্যারিসে ওয়ান প্লানেট সামিটে নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রত্যাশা করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় অভিন্ন প্রচেষ্টা এগিয়ে নিতে সরকারী ও বেসরকারী অর্থায়নের কর্মপন্থা নির্ধারণের লক্ষ্যে এই সম্মেলন হচ্ছে। বিশ্বের ১৮৮টি দেশের ঐকমত্যে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির দুই বছরের মাথায় মঙ্গলবার প্যারিসের এলিসি প্রাসাদে এ সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অংশ নিয়েছেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বিশ্ব নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে বেঁধে রাখার উদ্যোগে নেয়া হবে, যাতে তা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি না হয়। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোর দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোর প্রতি আমি আহ্বান জানাতে চাই, জলবায়ু সঙ্কটে সুবিচার প্রতিষ্ঠা এবং ইতিহাসের দায় মেটাতে তারা যেন তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন। কেবল যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা এই পৃথিবীকে নিরাপদ করতে পারি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জলবায়ু প্রশ্নে আমাদের যৌথ অঙ্গীকার, উদ্যোগ শান্তি, স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখবে, সাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।’ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় উদ্যোগ গ্রহণে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বশীল ভূমিকার প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা। গত সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের উদ্যোগে জাতিসংঘে ‘গ্লোবাল প্যাক্ট ফর দ্য এনভায়রনমেন্ট’ চালুর কথা উল্লেখ করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অথচ এ ভয়াবহ আপদের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রতিরোধ ও অভিযোজনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে যাচ্ছি। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে আমাদের টেকসই উন্নয়ন কৌশলে এটিকে মূল ধারায় রাখা হয়েছে।’ এই সম্মেলন থেকে শেখ হাসিনা বনায়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে ২ শতাংশ বনাঞ্চল বৃদ্ধি করে বিদ্যমান ২২ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে উন্নীতে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘দেশের মোট আয়তনের ২২ শতাংশ বনভূমিকে আগামী পাঁচ বছরে ২৪ শতাংশে নিয়ে যেতে সরকার প্রয়োজনীয় বনায়ন কর্মসূচী নেবে।’ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের জিডিপির এক শতাংশ ব্যয় হওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের কৃষিকে আমরা জলবায়ু সহিষ্ণু করছি। আমরা শহরে পানি সরবরাহে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে কাজ করছি।’ সহিংসতার মুখে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিপুলসংখ্যক জনগণকে আশ্রয় দিতে গিয়ে দেশের উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু অভিযোজনের বিষয়টি ‘বিরাট’ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের ১০ লাখের বেশি নাগরিক আশ্রয় নেয়ায় বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে কক্সবাজারে এক হাজার ৭৮৩ একর বনভূমিতে এসব বাস্তুচ্যুত মানুষকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। প্রলম্বিত এই উদ্বাস্তু সমস্যা ওই অঞ্চলে আমাদের বন ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে সেখানে পরিবেশ সুরক্ষা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে।’ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা এবং পরিবেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বনায়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বৃক্ষ রোপণে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নিয়েছি। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য ও বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন সংরক্ষণে পাঁচ কোটি সাড়ে ৭ লাখ ডলারের প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় অংশীদার ছাড়াও নিজস্ব সম্পদ দিয়ে লক্ষ্য পূরণে সর্বাত্মকভাবে কাজ করে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমি ক্ষয়, লবণাক্ততা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করতে শুরু করেছি। এ অঞ্চলে প্রায় ৬৭ হাজার হেক্টর ভূমি বনায়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।’ এর আগে ওয়ান প্লানেট সামিটে আসা নেতৃবৃন্দের সম্মানে এলিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দেয়া মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। সকালে এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ম্যাক্রোঁর সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার কাছে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিস্তারিত জেনে এর স্থায়ী সমাধানের কথা বলেছেন ফরাসী প্রেসিডেন্টও। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্স সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার প্যারিসের এলিসি প্রাসাদে এই দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান ম্যাক্রোঁ। সেখানে শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। বৈঠক শেষে শেখ হাসিনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন তিনি। পরে বৈঠকের বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হক। বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা ছাড়াও জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা, বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস এবং বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানান তিনি। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে বিস্তারিত জানতে চান ম্যাক্রোঁ। ‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে রোহিঙ্গা সমস্যার অবস্থা এবং তা মেকাবেলায় সরকার কী করছে, তা জানতে চান। আমাদের কাছ থেকে কী আশা করছেন, তাও বলেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট। ‘মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রায় দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা চলে আসার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা এবং পরিবেশের উপর বড় ধরনের দুর্যোগ।’ কয়েক যুগ ধরে ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অবস্থানের মধ্যে গত আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা শুরু হলে বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল। নতুন করে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ইতোমধ্যে ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাবও তুলে ধরেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, এই পাঁচ দফা বাস্তবায়নের মধ্যেই সমস্যার সমাধান নিহিত। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও চাপ দুটোই অব্যাহত থাকুক। এটা না করলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না।’ জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে সবাইকে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। বৈঠকে দুই দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়েও আলোচনা হয় জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘বিনিয়োগে নিজ দেশের আগ্রহের কথা প্রকাশ করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘কোন কোন সেক্টরকে আপনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন, যেখানে ফ্রান্স বিনিয়োগ করতে পারে।’ জ্বালানি, অবকাঠামো, ওষুধ, তথ্য-প্রযুক্তি এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন গঠনের কথাও বলেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট তা গ্রহণ করেন। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
×