ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কামার শিল্পে চলছে দুর্দিন

প্রকাশিত: ২৩:০১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

কামার শিল্পে চলছে দুর্দিন

তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী ॥ আগের মতো আর নেই কামার শিল্পের কাজ কর্ম। শুধু ঈদ আর পূজা পার্বনেই কামারদের কাজের কদর বাড়ে। সারা বছর নানা সংকট আর কষ্টের মধ্যে দিয়ে কাটছে ঈশ্বরদীর কামার সম্প্রদায়ের দিনগুলো। ক্রমাগত ভাবে লোহা ও কয়লার দাম বাড়তে থাকায় টিকে থাকতে পারছেনা কামার সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত কামাররা। তাই ইতোমধ্যে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন অন্য পেশায় । কামার শিল্পের সাথে জড়িত কামাররা জানায়, দুই যুগ আগে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকায় ৫’শরও বেশি পরিবার কামার শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। যারা নিজেরাই লোহা দিয়ে কামারের কাজ করতেন। পর্যায়ক্রমে এ শিল্পের চাহিদা কম হওয়া ও লোহার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে ঈশ্বরদীতে ২’শর মতো কামার পরিবার রয়েছে। অনেক কষ্টে তারা দিনাতিপাত করছেন। আগের চেয়ে তাদের কাজের চাহিদা কমে যাওয়ায় এর মূল কারণ। দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে চলছে তাদের সংসার জীবন। ১০/১২ বছর আগে ঈশ্বরদী শহরের মশুড়িয়া পাড়ার কামার পল্লীতে ১০০ পরিবারের বসবাস ছিল। বর্তমানে সেখানে ৪২টি পরিবার বসবাস করছেন। এসব পরিবারের মধ্যে কামার শিল্পের সাথে বর্তমানে মাত্র ১০টি পরিবার জড়িত রয়েছে। শহরের মিলপট্রি এলাকার কামার মোঃ বাবলু মন্ডল জানান, কয়েক বছর আগে এক বস্তা কাঠ কয়লা ৭০ থেকে ৮০ টাকায় কেনাযেত। এছাড়া ১ মন পাথর কয়লা ৫ থেকে সাড়ে ৫’শ টাকায় পাওয়া যেত। বর্তমানে সেই কয়লা ১৮’শ থেকে দু’ হাজার টাকায় কিনতে হয়। আগে ইটের ভাটায় পোড়ানো খড়ি থেকে কয়লা পাওয়া যেত। বর্তমানে কয়লার ভাটা হওয়াতে সেখান থেকে কয়লা পাওয়া যায়না। বাসা-বাড়ি থেকেও অনেক কয়লা পাওয়া যেত। বর্তমানে গ্যাসের চুলা হওয়াতে কয়লা আর পাওয়া যায়না। কামার শিল্পের জিনিস পত্রের দাম বানের পানির মতো বেড়েই চলেছে। কয়েক বছর আগেও ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে ১ কেজি লোহা পাওয়া যেত। বর্তমানে সেই লোহা ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে কিনতে হয়। এছাড়া আগের মতো বাজারে ভালো লোহাও পাওয়া যায়না। চাপাতি বানানোর জন্য স্প্রিং ৭০ টাকার পরিবর্তে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা দরে কিনতে হয়। তাও আবার অনেক কষ্টে পাওয়া যায়। নগরবাড়ি ঘাট এলাকা থেকে কয়লা কিনে আনতে হয়। সেই তুলনায় মজুরী বা তৈরীর মূল্য তেমন একটা বাড়েনি। মশুড়িয়া পাড়ার কামার পল্লীর বাসিন্দা তোতা শেখ কামার বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত আছি। নতুন করে এই কাজে কেউ আসতে চায়না। কারণ প্রচন্ড গরম, উত্তপ্ত লোহা এবং চুলার আগুনের পাশে বসে কাজ করা ভিষণ কষ্ট দায়ক। কয়লার ধোয়া নিশ্বাসের সাথে তাদের শরীরের মধ্যে ঢুকে যায়। ফলে তারা প্রায় শ্বাস-কষ্ট ও পেটের পিড়ায় ভুগতে হয়। তবুও পৈত্রিক এই পেশা ছেড়ে যেতে পারছি না। তিনি জানান, ঈদ-পূজা পার্বণে তাদের কাজের চাহিদা একটু বাড়ে। বিশেষ করে কোরবানীর ঈদে প্রতিদিন হাজিরা ৫ থেকে ৬’শ টাকার মতো হয়। অন্য সময় ২ থেকে ৩’শ টাকা হাজিরা পাওয়া যায়। তবে মাঝে মধ্যে খালি পকেটে বাড়ি ফিরতে হয়। তিনি আরও জানান, ঈদ এবং পূজার সময় ছুড়ি, চাকু, বটি, চাপাতি, চাপ্লল বানানোর ধূম পড়ে। তবে কৃষি কাজের জন্য তাদের তৈরী লোহার জিনিসপত্র নিয়মিত কৃষকেরা তৈরী বা ক্রয় করে থাকেন। এছাড়া অনেকেই বাজার থেকে ষ্টীলের তৈরী বিদেশী ছুড়ি, চাকু ঈত্যাদি কিনে আনেন। ফলে চাহিদা কমে যাওয়ায় কামার শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকেরা এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারের সদ্বিচ্ছা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় হয়তো এই শিল্প হারিয়ে যেতে পারে বলে তিনি জানান।
×