ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেকারত্ব ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সহজ পথ টার্কি পালন

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

বেকারত্ব ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সহজ পথ টার্কি পালন

ওয়াজেদ হীরা ॥ দেশের বেকারত্ব নিরসনে নতুন দিক উন্মোচন করছে টার্কি পালন। অল্প কিছু টাকা বিনিয়োগ করে এক বছরের মধ্যেই দ্বিগুণ মুনাফা আয় করতে পারছেন টার্কি (বড় আকৃতির পাখি বিশেষ) খামারিরা। আর স্বল্প সময়ে মুনাফা আসায় তরুণ বেকারদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই টার্কি। সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবেও দেখা হচ্ছে। দেশের আনাচে কানাচে অল্প কিংবা বেশি টার্কি পালন করে বেকার যুবকরা স্বপ্ন দেখছেন স্বাবলম্বী হওয়ার। পরিবারে বাড়তি আয়ও যোগান দিতে চান এর মাধ্যমে। আর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রোটিনের নতুন আরেকটি উৎস হিসেবে টার্কি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সেই সঙ্গে বেকারত্ব ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সহজ পথও। টার্কি হচ্ছে বড় আকারের গৃহপালিত পাখি। যা দেখতে অনেকটা মুরগির মতোই মনে হয়। এদের উৎপত্তি উত্তর আমেরিকায় হলেও ইউরোপসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পালন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্য তালিকায় অন্যতম উপাদান এই টার্কি। এরা প্রতিদিন মোট খাদ্যের ৫০-৬০ ভাগ নরম ঘাস খায়। তাই খাবার খরচ কম। বার্ড ফ্লু, গুটি বসন্ত, ঠা-াজনিত রোগ ছাড়া অন্য কোন রোগ এখনও কোথাও হয়নি। মাংস উৎপাদনের দিক থেকে খুবই ভাল। ৬ মাস বয়সে ৫-৬ কেজি হয়। ৬-৭ মাস বয়স থেকে ডিম দেয়া শুরু করে। একটি মেয়ে টার্কি ৫-৬ কেজি এবং পুরুষ টার্কি ৮-১০ কেজি ওজন হয়। বাংলাদেশে টার্কি পালনটা খুব বেশি দিনের নয়। কয়েক জেলায় এটি বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও অনেক স্থানে এখনও পরিচিতিই পায়নি। তবে বাংলাদেশে যারা এই খামারের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই দেখেছেন লাভের মুখ। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে আর উন্নত দেশগুলোর মতোই ব্যাপক হারে পালন করা হচ্ছে। বিশেষ করে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, নরসিংদীতে দিন দিন খামারের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে সারাদেশে এই খামারির সংখ্যা প্রায় পনেরশত। যারা ছোট বড় খামার করে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। খামারির চেয়ে অল্প সংখ্যায় টার্কি পালনকারীর সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়িতে অল্প পরিসরে বা দেশী মুরগির সঙ্গে টার্কি পালন করা হচ্ছে। অল্প অল্প পালনের মধ্য দিয়েই এক সময় খামার করতে চান ভালুকার সাদিকুর রহমান সাদিক। তার সঙ্গে একই এলাকায় এমন ক্ষুদ্র পরিসরে টার্কি পালনকারীর সংখ্যা কমপক্ষে অর্ধশত। অধিকাংশ গ্রামেই তরুণ আর নারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন এই টার্কি পালনের প্রতি। খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটিতে প্রচুর লাভ আসে তবে টার্কি পালনে প্রচুর ধৈর্র্য আর পরিশ্রম দরকার হয়। টার্কি পালনে অন্যান্য পশু-পাখির চেয়ে খরচ কম হলেও সার্বক্ষণিক সময় দিতে হয়। এদিকে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানান, ঘাস, পোকামাকড়, সাধারণ খাবার খেতে এরা অভ্যস্ত। তবে উন্নত খাবার দিলে ডিম ও মাংস বেশি পাওয়া যায়। আমাদের দেশে অনেকের ব্রয়লার মুরগির মাংসের ওপর অনীহা আছে। তাদের জন্য এটা হতে পারে বিকল্প প্রিয় খাবার। রাজধানীর কাছেই খামার গড়েছেন মাহমুদুল হাসান। প্রায় তিন হাজারেরও বেশি পাখি আছে তার খামারে। প্রথম দিকে ৪শ’র মতো পাখি দিয়ে খামার শুরু করেন। প্রতিনিয়ত পাখি ও ডিম বিক্রি করলেও তার খামার এখন টার্কি পাখিতে ভরপুর। এই টার্কি পালনের মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ায় কণ্ঠে ছিল উচ্ছ্বাসের সুর। প্রত্যেক বেকার যুবককে এটি পালনের পরামর্শও দেন তিনি। জানা গেছে, অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় এর উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। প্রয়োজনীয় আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকায় বছরে একেকটি টার্কি ৯০টিরও বেশি ডিম দিয়ে থাকে। সাধারণত ২৬ সপ্তাহ বয়স থেকে টার্কিগুলো ডিম দেয়া শুরু করে। এদিকে, অনেক খামারি এই টার্কি বিভিন্ন চেইনশপ যেমন স্বপ্ন, আগোরা ও মিনা বাজারে বিক্রি করেন। আর চেইনশপ থেকে ভোজনরসিক ক্রেতারা নিয়ে যান যার যার বাড়িতে। কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) সূত্রে জানা গেছে, দিন দিন এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। টার্কি পাখির লালন পালনের বিস্তারিত তথ্যও পাাওয়া যায় কৃষি তথ্য সার্ভিসে। রোগবালাই নিয়ে তেমন শঙ্কা নেই ॥ টার্কি পাখির তেমন বড় কোন রোগবালাই নেই। চিকেন পক্সের টিকা নিয়মিত দিলে এ রোগ এড়ানো সম্ভব। অতি বৃষ্টি বা বেশি শীতের সময় মাঝে মাঝে ঠা-াজনিত রোগ দেখা যায়, রেনামাইসিন জাতীয় ওষুধ দিলে ভাল ফল পাওয়া যায় বলে জানা গেছে। তবে নিয়মিত টিকা দিলেও এসব রোগ থেকে সহজেই টার্কিকে রক্ষা করা যায়। যে কারণে পালন করবেন টার্কি ॥ প্রথমত এদের মাংস উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। যা ব্রয়লার মুরগির চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ে। দেশী মুরগির সঙ্গেও অল্প অল্প পালন করা যায়। কোন বিশেষ খাবারের প্রয়োজন পড়ে না। তবে দিলে বৃদ্ধি আরও ভাল হয়। টার্কি পালনে তুলনামূলক খরচ কম। টার্কির মাংসে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি, চর্বি কম। তাই গরু কিংবা খাসির মাংসের বিকল্প হতে পারে। টার্কির মাংসে অধিক পরিমাণ জিঙ্ক, লৌহ, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি, ভিটামিন ই ও ফসফরাস থাকে। এ উপাদানগুলো মানব শরীরের জন্য উপকারী এবং নিয়মিত এ মাংস খেলে কোলেস্টেরল কমে যায়। সেই সঙ্গে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) তথ্য আর খামারিদের মতে, দুইভাবে টার্কি পালন করা যায়। মুক্ত চারণ পালন পদ্ধতি আর নিবিড় পালন পদ্ধতি। মুক্ত চারণ পালন পদ্ধতিতে এক একর ঘেরা জমিতে ২০০-২৫০টি পূর্ণ বয়স্ক টার্কি পালন করা যায়। আর নিবিড় পালন পদ্ধতিতে টার্কিদের রোদ, বৃষ্টি, হাওয়া, শিকারি জীবজন্তু থেকে বাঁচায় ও আরাম জোগায়। গরম অঞ্চলগুলোতে খামার করলে ঘরগুলো লম্বালম্বি পূর্ব থেকে পশ্চিমে রাখতে হবে। খোলা ঘরের প্রস্থ ৯ মিটারের বেশি হওয়া চলবে না। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ঘরের উচ্চতা ২.৬ থেকে ৩.৩ মিটারের মধ্যে থাকতে হবে। নতুন জন্ম নেয়া বাচ্চা কম সময়ের মধ্যে লালন পালন করেই মাত্র তিন মাসের মাথায় টার্কিগুলো দ্বিগুণের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করে বেশ ভাল মুনাফা দেখতে পারছেন টার্কি খামারিরা। একই সঙ্গে টার্কির ডিম বা বাচ্চার দাম নিয়ে এক জেলার সঙ্গে অন্য জেলার তারতম্য সর্বোচ্চ ৫০-৭০ টাকা। ময়মনসিংহের খামারি তুষার ও তার কর্মরত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এক মাসের বাচ্চা ৭০০-১০০০ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়াও প্রতি হালি (৪টি) টার্কির ডিম ৫০০-৮০০ টাকা। তবে গত বছর খামার শুরু করার সময় তাদের ডিম কিনতে হয়েছিল হালি প্রতি প্রায় ১৬০০ টাকা। বাজারে দাম কম বেশি উঠানামা করে বলেও জানা গেছে। ৪০টি দিয়ে শুরু করা খামারে টার্কিও সংখ্যা এখন ১০০। এর মধ্যে কত ডিম আর বাচ্চা বিক্রি হয়েছে সে হিসেব তারও জানা নেই। মুখে তার ব্যবসায়িক তৃপ্তির হাসি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নানা জায়গায় টার্কি পালনকারীদের মুখে এই হাসি দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন এর প্রতি। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে টার্কি পালন দিনে দিনে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও মূলত এটি বাণিজ্যিক মাংস উৎপাদনের জন্য। বাণিজ্যিকভাবে ডিম উৎপাদনের জন্য নয়। গাজীপুরের খামারি আবু কাউসার জানান, শখের বশে এই ব্যবসা শুরু করি। টার্কি পালনে অন্যান্য হাঁস-মুরগি পালনের মতো ঝামেলা না থাকার কারণে আরও আগ্রহ বেড়েছে। আর এই ব্যবসায় অনেক মুনাফা পাওয়া যায়। টার্কি খামারিদের ‘বাংলাদেশ টার্কি বার্ড ডেভেলপমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন’ (বিটিবিডিএ) নামে একটি সংগঠনও আছে। যার কার্যক্রম গতিশীল করতে গত মাসের শেষ সপ্তাহে ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। এই বিটিবিডিএ’র আয়োজনে ২০১৬তে প্রথম টার্কি উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়। সেই উৎসবেও ছিল নানা তথ্য জানার বড় একটি প্লাটফর্ম। এ বছর এমন আয়োজন হবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কমিটির মাধ্যমে নতুন কাজ শুরু করেছি। বিভিন্ন জায়গায় কমিটিও করব। আমার মনে হয় দেশে ভাল মানের খামার আছে প্রায় দেড় হাজারের মতো। তবে এর বাইরেও অনেকে অল্প অল্প করে টার্কি পালন করছেন বলেও মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র দাস জনকণ্ঠকে বলেন, এই পাখিটি আগেও ছিল তবে সেটা ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বাড়িতে শখের বশে পুষতেন। হঠাৎ দেখা যেতো। সীমান্ত এলাকায় এটি প্রথম দেখা যায়। বর্তমানে সব শ্রেণীর মানুষ এর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষরা গ্রামীণ পরিবেশে দেশী মুরগির সঙ্গে খোলা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে এটি পালন করছে। অনেকেই খামার করতে পারছে না তবে বাসায় কয়েকটি পালন করছে। এতে ওই পরিবারের দারিদ্র্য কমে আসছে। রাজধানীতে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে এর মাংস পাওয়া যায়। তবে দামটা অন্যান্য মাংসের মতো কোথাও নির্ধারিত নয়। ঝামেলা কম থাকায় এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বলেও মত দেন তিনি। একই সঙ্গে এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত বলেও মনে করেন। টার্কি পাখির প্রতি মানুষের এতো আগ্রহ এ নিয়ে কি ভাবছে প্রাণি সম্পদ অধিদফতর যোগাযোগ করা হলে দফতরের মহাপরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা জানি মানুষের মধ্যে এটি পালনের প্রচুর আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। আমরাও এই টার্কির বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করছি। এটি পালনের ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। কি করে আরও পালন প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়, শঙ্কামুক্ত থাকে তার জন্য কাজ করছি। তবে যারা ইতোমধ্যেই এটি পালন করে লাভবানসহ বেকারত্ব ঘুচিয়েছে তাদেরও সাধুবাদ জানান তিনি। কৃষিতে এগিয়েছে দেশ। প্রাণিজ সম্পদে সমৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে মৎস্য উৎপাদন। শিল্পায়ন বৃদ্ধিতে হচ্ছে কর্মসংস্থান। একটি দেশ যখন বিভিন্নভাবে এগিয়ে যায় সে সময় নানা সেক্টর হয়ে ওঠে সম্ভাবনাময়। টার্কি পালন সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছুই নয়। একটুখানি সচেতনতা, সরকারী গবেষণা এবং ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক অংশগ্রহণে এ টার্কিই হয়ে ওঠতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের এক বড় মাধ্যম। একই সঙ্গে এর ব্যাপক উৎপাদনের মাধ্যমে হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি পথও।
×