ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সারাদেশে হঠাৎ হিমেল হাওয়া, নেমেছে শীত

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

সারাদেশে হঠাৎ হিমেল হাওয়া, নেমেছে শীত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঋতু শুরুর আগেই প্রকৃতিতে শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। মঙ্গলবার থেকেই সারাদেশে হিমেল হাওয়া বইছে। দু’দিনের ব্যবধানে তাপমাত্রাও কয়েক ডিগ্রী কমে গেছে। সকাল-সন্ধ্যা অনেকেই গরম কাপড় জড়িয়ে বাইরে বের হচ্ছেন। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিমের হিমেল হাওয়া দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের অনুভূতি বাড়ছে। তবে তারা জানান, ঠা-া পড়লেও এখনই হাড়কাঁপানো শীত আসছে না। মধ্য ডিসেম্বর থেকে শীতের তীব্রতা বাড়তে পারে। এ সময় মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, গত দুই দিনের ব্যবধানে সারাদেশের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রী কমে গেছে। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধানও অনেক কমেছে। গত দু’দিন ধরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে অবস্থান করছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও ১২ থেকে ১৮ ডিগ্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তারা জানান, সামনের দিনে এই তাপমাত্র ক্রমান্বয়ে আরও কমে আসবে। তখন শীত আরও বেড়ে যাবে। বর্তমানে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে শীতল বাতাস প্রবাহিত হাওয়ার পাশাপাশি উপমহাদেশীয় উচ্চচাপবলয় বিস্তৃত রয়েছে গোটা অঞ্চল জুড়ে। ফলে তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে বলে জানান। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আবুল কালাম মল্লিক বলেন, উচ্চচাপবলয় বিস্তৃত রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম দিক থেকেও ঠা-া বাতাস দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে তাপমাত্রা কমছে। আগামী কয়েক দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। তবে আপাতত শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ডিসেম্বরের আগে তীব্রতা তেমন বাড়বে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। অফিস সূত্রে জানা গেছে, উত্তর ভারতে ইতোমধ্যে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। ফলে ওই এলাকায় তাপমাত্রা অনেক কমে গিয়ে স্বাভাবিকের নিচে নেমে গেছে। এছাড়াও উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খ-ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। উত্তরাখ-, কাশ্মীরে ইতোমধ্যে চলছে তুষারপাত। উত্তর ভারতে চলা শৈত্যপ্রবাহের জেরেই তাপমাত্রা কমে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে এর প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়ছে। তারা জানায়, পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায় এখন শীতের প্রকোপ বিরাজ করছে। তবে এর ফলে এখনই শীত জাঁকিয়ে বসছে না। হাড়কাঁপানো শীতের জন্য আরও একমাস অপেক্ষা করতে হবে। মধ্য ডিসেম্বরের পর থেকেই মূলত আসল শীত শুরু হবে। আমাদের দেশে মূলত মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত শীতের তীব্রতা বেশি থাকে। এরপর শীত থাকলেও তার তীব্রতা অতবেশি থাকে না। এবার স্বাভাবিক এই নিয়মেই শীত আসবে। তারা জানায়, এবারের শীতে ডিসেম্বরেই দুটি শৈত্য প্রবাহ বয়ে যেতে পারে। মাসের শেষ দিকে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলে ১ থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তাপমাত্রা কমে ৮ থেকে ১০ ডিগ্রীর মধ্যে চলে আসবে মৃদু শৈত্যপ্রবাহের সময়। অপর দিকে তীব্র শৈতপ্রবাহে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসতে পারে। এ সময় তামাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে নেমে আসবে। এছাড়া মাঝারি মানের শৈত্যপ্রবাহের সময় তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রীর মধ্যে অবস্থান করবে বলে আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানান। গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ডিগ্রী নিচে নেমে যাবে। এছাড়াও জানুয়ারিতে মাঝারি এবং তীব্র শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কাও রয়েছে। এই মাসেও শেষের দিকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের আভাস দেয়া হয়েছে। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড় তাপমাত্রা এই মাসে এক ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি থাকবে। তারা জানায়, ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে শেষ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চল এবং দেশের নদ নদী অববাহিকায় ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। জানুয়ারিতে উত্তরাঞ্চল, উত্তর পূর্বাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং নদ নদীর অববাহিকায় ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকবে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশে আপাতত শীত তীব্র না হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শীত জেঁকে বসেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে শীত ভালভাবেই কড়া নাড়তে শুরু করেছে। এছাড়াও হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও দিল্লীতে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, মনিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে কুয়াশার মাত্রা বেড়েছে। তারা জানায়, ভারতের শীতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতের প্রভাবের সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে যে উচ্চচাপ বলয়ের কারণে এখানে শীত আসে তা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরেই এখানে প্রবেশ করে। তাই ভারতের শীত জাঁকিয়ে বসছে এর প্রভাব বাংলাদেশেরও পড়তে পারে। উত্তরাঞ্চলে শীত আগেভাগেই সমুদ্র হক বগুড়া থেকে জানান, হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলে শীত এবার আগেভাগেই নেচে উঠেছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করেই আসছিল। হঠাৎ কী যে হলো এখন যেন একটু জোরেই হাঁটছে শীত। ভোরের ঘন কুয়াশার স্থায়িত্ব দুপুরের রেশ না ফুরোতেই বয়ে আসে মৃদু বাতাস। গোধূলী বেলাকে ছেঁটে দিয়ে হলদেটে রোদ কুয়াশার সঙ্গে মিতালি করে দ্রুত সন্ধ্যা নামিয়ে দেয়। পশ্চিম গগনে সন্ধ্যার জ্বলজ্বলে লুব্ধক তারাটিও একটু আগেভাগেই মিটিমিটি করে চোখ মেলে। শিশির বসে থাকে না। সন্ধ্যা রাতেই ধরণীকূলে নেমে আসে। যা টের পাওয়া যায় মোটর গাড়ির বডি ও কাঁচে তর্জনী দিয়ে আঁকিবুকির পর নক্সা হওয়া দেখে। ঢাকা মহানগরীর কংক্রিটের বনে আলো ঝলমলে রাতে কুয়াশা ততটা দৃষ্টিতে আসে না। ঢাকা মহানগরীতে শীত একটু দেরিতেই আসে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ধুলোবালির আধিক্য খুব বেশি। ঢাকা এখন ধুলোবালির মহনগরীতে পরিণত। ধুলোমেঘের সৃষ্টি হয়ে সূর্যের আলো সহজে নামতে পারে না। এখন ভর বছর মাঠে ধানসহ কোন না কোন ফসল থাকায় আকাশে ধুলোর আস্তরণ জমছে। ডিসেম্বরের মধ্যভাগে ধুলোর আস্তরণ পূর্ব দিক থেকে আসতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগে তা উল্টো দিকে ঘুরে যায়। শৈত্য প্রবাহের অন্যতম কারণ এই ধুলোমেঘ। বিশ্ব পরিবেশ বিজ্ঞান সমিতি ও ভারতের যৌথ গবেষণায় এমন প্রমাণ মিলেছে। এই সময়টায় সন্ধ্যা খুব দ্রুত চলে আসে। বিকেল ও সন্ধ্যার ব্যবধান এতটাই কম যে দিনের দ্বিতীয় ভাগ প্রথম ভাগের চেয়ে সঙ্কুচিত। নগরীর মানুষের চোখে ঋতুর পরিবর্তন এই টুকুই। গ্রামে শীত আগমনের বারতা নগরীর জৌলুস থেকে অনেক দূরে। যদিও বর্তমানের গ্রামে শহরের আঁচ পড়েছে। কুঁড়েঘর নেই। অট্টালিকা ও টিনের চালায় ইটের ঘরে গ্রামীণ জীবন আপগ্রেড হয়েছে। এর মধ্যেই সকাল-সন্ধ্যা কুয়াশার ঘনঘটা। শরীরে স্পর্শ করে হিমেল বাতাস। গাছপালা, পথের ধারের জাংলা ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠে ও দূর্বা ঘাস রাতভর ঝরে পড়া শিশিরে ভিজে ওঠে। সেই শিশিরের ফোঁটায় সকালের রোদ হীরের কুচির মতো দ্যুতিময় হয়ে ছড়ায় বর্ণচ্ছটা দিয়ে। শীতের রাত অনেক বড়। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে উঠানে জ্যোৎ¯œার ¯িœগ্ধ আলোয় গাছগাছালির ছায়া দেখে গা ছমছম করে ওঠে। এমন রাতের স্তব্ধতায় ভিন্ন ধরনের এক অনুভূতি পেয়ে বসে। এমনই হিমেল হাওয়ায় দূর থেকে ভেসে আসে বনফুলের সৌরভ। শীতের সকালে ও সন্ধ্যায় গ্রামের বড়ির উঠানে খড় লতাপাতা জ্বালিয়ে চারধারে বসে ও দাঁড়িয়ে উষ্ণতা নেয়া হয়। শীতের রূপের অনেক বর্ণনা আছে রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায়। শীতের ওপর কবিগুরুর কবিতা ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে/পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শীতের রূপ তুলে ধরা হয় নানাভাবে। যেমন- চালতার পাতা থেকে ঝরে পড়েছে শিশির বিন্দু, স্তব্ধ রাতের অন্ধকারে গাছের শাখায় শিকার ধরতে ওঁৎ পেতে আছে পেঁচা, মাকড়সার জালে জমেছে মুক্তার মতো শিশির বিন্দু। শীতের সন্ধ্যায় কাছের কোথাও থেকে ভেসে আসে শিয়ালের কোরাস ডাক। শীত এলেই তারা গলা সাধে। শুনতে ভালই লাগে। হালে বগুড়া নগরীতে শিয়ালের ডাক শোনা যায়। ডানা ঝাপটে নৈশ অভিসারে যাত্রা শুরু করে বাদুড়ের ঝাঁক। নদীর মন্থর স্রোতে ঝিলমিল করে ওঠা সূর্যের আলো নিসর্গের আরেক রূপ হয়ে ধরা দেয়। শীতের শুষ্ক ও রুক্ষ প্রকৃতির অপবাদ ঘোচাতে বিচিত্র রঙের গাঁদা মল্লিকা, গোলাপ, ডালিয়া যেন জৌলুস ফিরে পেতে শুরু করে। ফুলের কমনীয় রংটি শীতেই পাওয়া যায়। দিনকয়েকের মধ্যে বোরো ধানের চাষ শুরু হয়ে যাবে। এসব জমিতে রাতভর কুয়াশা শিশির প্রকৃতির সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে। কৃষকদের অভিজ্ঞতা-শীতে এই কুয়াশা আরও ঘন হয়ে নামলে তা জমিকে জখম করে দেয়। ইংরেজীতে বলা হয় কোল্ড ইনজুরি। এই অবস্থা হলে আবাদে ধীর গতি আসবে। অর্থাৎ রোদের তাপে ঘন কুয়াশার আস্তরণ না শুকালে চারা রোপণ করা যাবে না। এই সময়টায় রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। শীতের নিশুতি রাতে গ্রামের টিনের চালার ঘরে গভীর মনোযোগে কান পাতলে শিশির ঝরার মৃদু শব্দ পাওয়া যায়। শীতের মৌসুম উত্তরাঞ্চলে যতটা পাখনা মেলে পূর্বাঞ্চলে ততটা নয়। হিমেল বাতাসটি হিমালয় থেকেই ধেয়ে যায় পূর্বের দিকে। রাজধানী মহানগরী ঢাকায় কংক্রিটের বনে মৌসুমি বায়ু দুয়ারে টোকা দিতে পারে না। শীতল পরশের ক্লাসিক্যাল হাওয়া প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নে। যেখানে ভিড় করা ইমারত বিকেলের সোনা রোদই ঢেকে দেয় সেখানে আকাশ ছোঁয়া ইট পাথরের বনে শীতের ধ্রুপদী তাল বাজবে কী করে!
×