ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাওইল তাঁতপল্লী

তৈরি হচ্ছে চাদর, গামছা লুঙ্গি- ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৬ নভেম্বর ২০১৭

তৈরি হচ্ছে চাদর, গামছা লুঙ্গি- ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান

মোঃ হারেজুজ্জামান হারেজ ॥ সান্তাহার পৌর শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম শাওইল। গ্রামটিতে অনেক আগে থেকেই তাঁতী শ্রেণীর মানুষের বসবাস। তাদের বুনন করা কাপড় বেচা-বিক্রির জন্য তখন থেকেই গ্রামের প্রবেশ মুখে একটি হাট গড়ে ওঠে। শুরুতে মশারি, সাধারণ চাদর ও গামছা বেচা-বিক্রিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে বেড়েছে পণ্যের প্রকার ও হাটের আকার। দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করা উলেন শালচাদর, সাধারণ চাদর, সোয়েটার, কম্বলসহ নানান শীত পণ্য, পা-পোস, মশারি, লুঙ্গি ও গামছা তৈরির শতাধিক কারখানা স্থাপন এবং এসবের সব ধরনের মালামাল মেলে এখানেই। শুরুতে হাতেগোনা কিছু দোকান গড়ে উঠলেও এখন ছোট-বড় মিলে প্রায় হাজার দুয়েক দোকান নিয়ে বিশাল আকার ধারণ করেছে শাওইল হাট। এতে করে তাঁতীদের আর দূর-দূরান্তে যেতে হয় না মালামাল কেনার জন্য। এই তাঁতপল্লীর তাঁতীদের কাঁচা মালামাল কেনার জন্য এক যুগ আগেও আসতে হত সান্তাহার শহরের সুতাপট্টিতে। কিন্তু নানা কারণে তা চলে গেছে তাঁতীদের দোরগোড়ায়। শাওইলের এই তাঁতপল্লীকে ঘিরে আশপাশের ২০/২৫ গ্রামে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান। শীতের মৌসুমে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। এসব গ্রামের পাশ দিয়ে চলতে গেলে শুনতে পাওয়া যায় চড়কায় সুতা তোলার ভন ভন আর তাঁতে কাপড় বুননের খট খট শব্দ। বরাবরের মতো এখানেও নারী কর্মীদের কদর বেশি। কিন্তু মজুরি কম। রবি ও বুধবার হাটবারে ভোর ৪টার দিক থেকে হাট বসতে শুরু করে। হাটবার এছাড়াও প্রতি দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেচা বিক্রি হয় এসব সামগ্রী। বগুড়ার আদমদীঘির শাওইল তাঁতপল্লী ও হাট এ শিল্পের এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যখন শাওইলের হাট বসে তখন মনে হয় যেন মেলা বসেছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীদের পদচারণায় সব সময় মুখরিত ওই গ্রামমুখী পথঘাট। এই হাটকে ঘিরে চলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধাসহ সারাদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের চাদর, কম্বল, সুতা আর বুনন সামগ্রী কেনার প্রতিযোগিতা। হাটের চার পাশে ঘিরে শত শত ট্রাক, বেবিট্যাক্সি, রিক্সা-ভ্যানের উপস্থিতি। তাঁতের খট খট শব্দে আর সুতার বুননে মিশে আছে শাওইলসহ আশপাশের গ্রামের মানুষের স্বপ্ন। কারও রয়েছে নিজের তাঁত আবার কেউ শ্রম দিচ্ছে অন্যের তাঁতে। আধুনিক কলকারখানায় প্রযুক্তির দাপটের মাঝে এই আদি শিল্প শাওইল গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের মানুষের আঁকড়ে ধরে আছে। শাওইলকে ঘিরে বহু গ্রামজুড়ে তাঁতের একটানা খট খট শব্দে মুখরিত গ্রামের পরিবেশ। আর নারী-পুরুষ কারিগরদের কর্মব্যস্ততা। কেউ সুতা ছাড়াচ্ছে, আবার কেউ বা চরকায় সুতা নলি উঠাচ্ছে। কেউ বা ববিনে ভরাচ্ছে সুতা। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ও ঘরে বসানো তাঁত যন্ত্র চলছে দিন রাত। প্রতিটি বাড়িতে কম করে হলেও ৫টা থেকে ১০টা পর্যন্ত তাঁত রয়েছে। কোনাটা চাকাওয়ালা আবার কোনাটা একেবারেই বাঁশ কাঠ দিয়ে হাতের তৈরি। শাওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, দেলুঞ্জ, পুশিন্দ, কেশরতা, বিনাহালী, ঘোড়াদহসহ আশপাশের প্রায় ২৫ গ্রামের চিত্র একই রকম। শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সভাপতি জৈইম উদ্দীন শেখ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন জানান, শাওইল হাটের শুরুতে ৫/৭টি দোকান থাকলেও এখন শাওইলে মার্কেট ভিত্তিক দোকান রয়েছে ছোট বড় মিলে প্রায় ২ হাজার। আর তৈরি হয়েছে নতুন নতুন কারিগর। এখানে উৎপাদিত চাদর, কম্বল, সোয়েটার, লুঙ্গি-গামছাসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় বেশ উন্নত মানের হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা দেশ-বিদেশে। তাঁরা আরও বলেন, এই তাঁতপল্লীকে ঘিরে উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বা মন্ত্রণালয়ের কেউ খতিয়ে দেখছে না। তাঁতীদের মাঝে সরকারী সুবিধা বাড়াতে পারলে গ্রামটি হতে পারে রফতানির বড় ক্ষেত্র। সবচেয়ে অসুবিধা হলো এখানকার ব্যবসায়ীদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এই বিশাল বাণিজ্যিক স্থানে কোন ব্যাংকের শাখা না থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের টাকা লেনদেনের জন্য ঝুঁকি নিয়ে আসা যাওয়া করতে হয় মুরইল বন্দর, আদমদীঘি সদর এবং সান্তাহার।
×