ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

পাঠ্যসূচীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ॥ বাধাটা কোথায়?

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১১ নভেম্বর ২০১৭

পাঠ্যসূচীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ॥ বাধাটা কোথায়?

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেন শিক্ষা ব্যবস্থায় বা পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না এ প্রশ্ন আজ সামনে চলে এসেছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো (টঘঊঝঈঙ) ভাষণটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য (GLOBAL HERRITAGE) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর আরও বেশি করে আলোচিত হচ্ছে। মনে হয় বাঙালী জেগেছে। ৪৭ বছর পার হয়ে গেল আমরা ভাষণটির গুরুত্ব অনুধাবনই করতে পারলাম না। ৪৭ বছর মানে Four and seven years ago -এরপর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে আমাদের টনক নড়ল। তারপরও আমাদের শিক্ষা বা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কি ভূমিকা পালন করবে, সে জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে? যদিও আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব অনুধাবনে ইউনেস্কো বা আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য হওয়ার পর আমরা জাগব তাহলে কোন কথা নেই। এটি বাঙালীর হৃদয়ে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এই ভাষণের প্রতিটি শব্দ একেকটি পলিটিক্যাল বুলেট ইতিহাস বিকৃতিকারীদের বিদ্ধ করে চলেছে। ভবিষ্যতেও কেউ পার পাবে না। কেননা, এ ভাষণের যে অন্তর্নিহিত শক্তি তাকে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারও নেই। ৪৭ বছরে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। তবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি গবেষণার ক্ষেত্রটাকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করে দিয়েছে। দেশের বাইরের যে তরুণ অধ্যয়নরত বা যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী গবেষণারত তার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সহজেই। যা ছিল আমাদের ১৬ কোটি (রাজাকার বাদ দিয়ে) মানুষের তা আজ বিশ্ববাসীর সম্পদ হয়ে গেল, যেমন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববাসীর মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হলো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর এই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণটিও আমরা পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি। এটি কি উপেক্ষা, না অবহেলা? কি জবাব দেবে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়? আমরা মনে করি সকল শ্রেণী থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পাঠ্যসূচীতে বাধ্যতামূলক থাকা দরকার। ভাষণটিই এমন। বিশ্বে আরও অনেক ভাষণ আছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে সেগুলোর পার্থক্য অনেক। আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জজ আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের প্রেক্ষিতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব তিনি ভাষণটি দিয়েছিলেন বিপ্লবের পর শান্ত সুশৃঙ্খল পরিবেশে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিনির্ধারণী হিসেবে। আর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণটি দেন সামরিক জান্তার বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে। ১৯৭১ সালের সেই ৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র এবং ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই মঞ্চের অল্প দূরে দাঁড়িয়ে ভাষণটি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। রেসকোর্স ময়দান বা বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারদিকে তখন ভারি কামানবাহী গান ক্যারেজ একটির পেছনে আরেকটি ঘুরছিল। মাথার ওপর আকাশে উড়ছিল কয়েকটি হেলিকপ্টার গানশিপ। রেসকোর্সের পাশের রমনা পার্ক ছিল বালুচ রেজিমেন্টের সেনায় সেনায় ঠাসা। এমনি পরিস্থিতিতেও রেসকোর্সে দশ লাখ মানুষের উত্তাল জনসমুদ্র। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব ১৮ মিনিট কয়েক সেকেন্ডে ১০৯৫ শব্দের একটি ভয়-জড়তাহীন (যা তার চরিত্রে ছিলই না) কালজয়ী ভাষণ দিয়ে গেলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় ‘রাজনীতির কবি শেখ মুজিব’ তার কবিতাখানি আবৃত্তি করলেন। তখন লাখো কণ্ঠে স্লোগান ওঠে “বীর বাঙালী অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “জয় বাংলা”। হ্যাঁ, যে কথাটি বলছিলাম আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটি ছিল “লিখিত” এবং বারবার পরিমার্জিত আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ “এক্সটেম্পোর”। তারপরও কীভাবে এত গুছিয়ে শব্দের মালা তথা বুলেটের মালা গাঁথলেন, এ এক বিস্ময় বৈ কিছু নয়! আসলে দক্ষিণ বাংলার মতো পশ্চাৎপদ এলাকা টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে আসা এবং শেখ মুজিব হওয়া সেই তো এক বিস্ময়। যে নেতা সারাজীবন রাজনীতি করেছেন, তাঁর ভাষায় “আমার মানুষ”, “গরিব দুঃখী” মানুষের জন্য এবং তাদের আশা-আকাক্সক্ষা বুকে ধারণ করেন তাঁর পক্ষেই এমন ভাষণ দেয়া সম্ভব। আমেরিকার কালো মানুষের নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর “ও যধাব ধ ফৎবধস” বা নেতাজী সুভাষ বসুর “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই”, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ” এর মাধ্যমে কিং-এর “উৎবধস” বা নেতাজীর “স্বাধীনতার” স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করে। যাকে তৎকালীন পত্রপত্রিকা নাম দিয়েছিল “বজ্রকণ্ঠ”। ৭ মার্চের ভাষণকে কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করা যাবে : এক. প্রথমত “আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি”- এই বলে তিনি পাকিস্তানের (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের) শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন। দুই. “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। একই সঙ্গে কোন্ কোন্ অফিস খোলা থাকবে, কোন্গুলো বন্ধ থাকবে, পশ্চিম পাকিস্তানে কি কি যাবে না, অবাঙালীদের নিরাপত্তা, সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান এমনি সব এক এক করে বলে দিলেন একজন দক্ষ রাষ্ট্রনেতার মতো। তিন. বঙ্গবন্ধু আর্মি জেনারেল ছিলেন না, তবু কীভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হবে সব বললেন - “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে... রাস্তাঘাট যা যা আছে সব বন্ধ করে দেবে... আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না.... (পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উদ্দেশে)... তোমরা আমাদের ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবে না, আর আমাদের বুকে গুলি চালিও না... ভাল হবে না”... লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এখানে শত্রু চিহ্নিত এবং রীতিমতো হুমকিও দিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করলেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা” বলে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন এবং কীভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে হবে তা সবই বলে দিলেন। তার আগে যাতে কেউ তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বদনাম দিতে না পারে সে জন্য সংসদে অংশগ্রহণের শর্ত হিসেবে ৪টি দাবি দিলেন- ১. মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে, ২. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, ৩. যত হত্যাকা- হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে এবং ৪. জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অর্থাৎ সাপও মরল, লাঠিও ভাংল না। যদিও তরুণ নেতৃত্ব এবং ছাত্রলীগ চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সামনে তখন ‘বায়াফ্রার স্বাধীনতার হঠকারী ঘোষণা এবং ব্যর্থতার উদাহরণ ছিল, তাই এমনভাবে ঘোষণাটি দিলেন ৭ মার্চ এবং পাকিস্তান গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি ও চূড়ান্ত ঘোষণাটি দিলেন “ঞযরং সধু নব সু ষধংঃ সবংংধমব. ঋৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রং রহফবঢ়বহফবহঃ”. কাজেই টঘঊঝঈঙ-র স্বীকৃতির পর আগামী দিনে এই ভাষণ বিশ্বব্যাপী কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হবে, গবেষণা হবে, অক্সফোর্ড-হার্ভার্ডের গবেষণার সাবজেক্ট হবে সেদিনও বেশি দূরে নয়। সেদিন আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় মুখ দেখাবে কি করে? বঙ্গবন্ধুর ভাষণের লাইনে লাইনে চিত্রকল্প। তা দিয়ে প্রামাণ্যচিত্র যেমন বানানো যায়, তেমনি নৃত্যনাট্যও সৃষ্টি করা যায় এবং তা ইংরেজী অনুবাদ করে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া যায়। এটাই সর্বাগ্রে জরুরী। ঢাকা ॥ ৯ নবেম্বর ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×