ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

খুরশীদ আলম বাবু

কবিতা নিয়ে দু’কথা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১০ নভেম্বর ২০১৭

কবিতা নিয়ে দু’কথা

সবাই কবিতা সৃজন করেন না। এমন অনেকে ছিলেন- যারা কস্মিনকালেও একটি কবিতা লেখেননি, কিংবা কবিতা লেখার কথা ভাবেননি, কবিতা না লিখে সমাজে বসবাস করেছেন। তাতে বিশ্ব সংসারের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আমাদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর দেশের অধিবাসীদের কথা বাদই দিলাম। উন্নত সব্যতা গরিবন্ত দেশেও কবি ও কবিতা বিষয়ক একই সমস্যা রয়েছে। আজকাল প্রায়শ বলতে শুনি যে, কবিতার বাজার নেই। সমাজে কবির সংখ্যা কাকের চেয়ে বেশি। এটা মোটা দাগের রসিকতা, নাকি অন্য কিছু, এখন অবধি আমার বোধগম্য হয়নি। প্রথমটার উত্তরে আমি বলতে পারি যে, কবিরা ফেরিওয়ালা কিংবা ফুসকাওয়ালা নয়, তারা ‘কবিতা কিনুন’ বলে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাঁক দেবেন, চিৎকার করে জানাবেন আমি কবি আমাদের দেখুন। সুতরাং কবিতার বাজার না থাকলেও প্রকৃত কবির এমন কিছু যায় আসে না। আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ আজীবন পাঠকবিহীন অবস্থায় সৃজন করে গেলেন কবিতা। তাতেও কবির কবিতা লেখার ছেদ ঘটেনি। ফরাসি কবি ভেরলেনও, তার মৃত্যুর পর এ কবি যে পরিমাণ পাঠক পেয়েছেন, তারা জীবিত থাকলে একটু বিস্ময় বোধ করতেন, তা বলাই বাহুল্য। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা আমার কর্ম নয়। কারণ আমিও স্বয়ং একজন কবি কর্মী। তবে আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে, এ সমাজে বসবাসরত সব মানুষই কবি, স্বয়ং বিশ্ব বিধাতাও একজন কবি। তা না হলে এ বৈচিত্র্যময় ধরিত্রী সৃষ্টি করতেন না। এ কারণে কিনা জানি না, শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রেই এক আধটু কবিতা লেখার চেষ্টা করে থাকেন। একাজে অপরাধ আছে বলে আমার মনে হয় না। বর্তমানে লক্ষ্য করেছি এ শ্রেণীর কবির সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। ফলত যারা ভাল কবিতা লিখছেন, পাঠকরা তাদের চিনতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো এই যে, রাজনীতি এখন কবির ব্যক্তিগত পরিচয়কে নিয়ন্ত্রণ করছে; যা রীতিমতো দুঃখজনক। এটাকে কাব্য হিংসা না বলে প্রতিহিংসা বলাটাই স্বাভাবিক। জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে একই কলকাতা মহানগরীতে বাসকরতেন, তাদের মধ্যে দুই একবার দেখা সাক্ষাত হয়েছিল, এমন তথ্য কেউ দিতে পারবেন না। প্রত্যেকই প্রত্যেকের গ-িতে চলাফেরা করেছেন এবং এ শিবির বিভক্তিটা অনন্তকাল থাকবে বলে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। না থাকলে বৈচিত্র্য উধাও হবে, ঘটনা থাকত না আর ঘটনা না থাকলে বৈচিত্র্য থাকবে না। বুদ্ধদেব বসু ও রক্ষণশীল সজনীকান্ত দাসের মধ্যকার লড়াই এক সময় পাঠকরা বেশ চমৎকার উপভোগ করতেন। আসল কথা হলো কবিরা সাহিত্যের লড়াইয়ে লিপ্ত থাকলেই মঙ্গল। মুশকিলটা হলো অসাহিত্যিকদের প্রভাবটা আগের তুলনায় ক্রমশ বাড়তির দিকে। সাম্প্রতিককালের কয়েকজন তরুণ কবির কবিতা পড়ে আমার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আর সেটা আলোকপাত করতে গিয়েই ‘ধান ভানতে গাজীর গীত’ গাইলাম আর কি। বেশ কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি, কবিতাকে এলোমেলমীর বাজার বানিয়ে ফেলেছেন। তাদের কবিতা পাঠে মুগ্ধতার পরিবর্তে এদিক সেদিক ইতি উতি তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। তখন মনে মনে একটু ঈষৎ অন্য ভাবনার প্রশ্ন মনে এসে আঘাত করে সেটি হলো এই - কেন এরা কবিতাটি সৃজন করলেন? না লিখলে বাংলা কবিতা সাহিত্যের এমন কি ক্ষতি হতো? আমি ব্যক্তিগতভাবে কেবল তরুণ কবিদের দোষারোপ করার পক্ষপাতি নই। বাংলাদেশের বর্তমান একজন বিশিষ্ট কবির কবিতা পড়ে আমার সেই রকম ধারণা করতে দ্বিধা হচ্ছে না। আমি সে কবির নাম না বললেও তাকে চিনতে পাঠকের মোটেও অসুবিধা হবে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এ কবির এখন কবিতা না লেখাটাই উচিত। কবি মোহিতলাল মজুমদার যখন দেখলেন যে, নতুন ভাবে কবিতা সৃজন করতে পারছেন না, সেই মুহূর্তে তিনি কবিতা সৃজনের দ্বারে তালা দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য মোহিতলাল মজুমদার অসম্ভব সৎ কবি বলেই এটা সম্ভবপর হয়েছিল। আমাদের সাহিত্য এটি একটি বিরল ঘটনা। তবুও মোহিতলাল মজুমদারকে এখনও খুব কম স্মরণ করা হয়। বিশ্ব সাহিত্যে টি, এস, এলিয়ট এক সময় কেবল কবিতার পরিবর্তে সমালোচনায় নিজেকে নিবন্ধ রেখেছিলেন। বিষ্ণু দে যদি শেষ জীবনে কবিতা লেখা বন্ধ করতেন তাহলে বাংলা কবিতা সাহিত্যের এমন কোন ক্ষতির আশঙ্কা থাকত না। কিন্তু সমস্যা হলো যে, আমাদের অধিকাংশ প্রধান কবি সেটা বুঝতে চান না। এ সমস্যা বিমোচনে তরুণ কবিদের এগিয়ে আসাটাই বাঞ্ছনীয়। তবে তরুণ কবিরা একটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত নাচার এ কারণে যে, কাব্য জীবনের প্রারম্ভেই এ সব কবির প্রভাবেই তরুণ কবিরা সৃজন করে থাকেন। ফলত ভবিষ্যৎ পাথেয় সম্বন্ধে বোঝার ক্ষমতা থাকে না। এ ধারা সব দশকেই বিদ্যমান থাকে, সুতরাং তরুণ কবির দায়িত্ব এক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার নামান্তর মাত্র তা বলাই বাহুল্য। তাদের কবিতা পড়েই পরাবাস্তব শিল্পীর আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে দর্শকের যে প্রতিক্রিয়া হয় ইদানীং আমার সেই রকম হচ্ছে। ছন্দ কোথায়? আর তালইবা কোথায়? খুঁজতে গিয়ে বারবার বিব্রত বোধ করেছি। অনেকের ধারণা কবিতা মানেই গদ্য ভঙ্গি, কবিতা সৃজনের জন্য যে লেখাপড়া ইত্যাদির প্রয়োজন আছে তারা সেটা মানতে চায় না। বলা বাহুল্য এই সময় কবিতা পাঠকপ্রিয়তার পরিবর্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এত কবিতা ছাপানো হচ্ছে, কবিতা কোথায়? সম্পাদক মহাশয়রা এসব ছাপেন কেন? গদ্য ছাপালেই পারেন। রাজধানীতে অনেক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপানো হয় লবিং গ্রুপের মধ্য দিয়ে। একজন প্রকত কবিকে যে লড়াই করতে হয়, তাকে ভয়াবহ বললে কম বলা হবে। প্রত্যেক সম্পাদকের নাকি একদল তল্পিবাহক কবি সম্প্রদায় থাকে। এ সব কবি কবিতা ছাড়া অন্য কারও কবিতা ছাপা হয় না। তবে আমি সবটাই বিশ্বাস করি না। বেশ কিছুদিন আগে এক লিটল ম্যাগাজিনে কবি সাযযাদ কাদিরের এক কবিতা বিষয়ক নিবন্ধ পাঠ করেছিলাম। পত্রিকাটির নাম ‘গণ সাহিত্য’ কিংবা ওই গোছের মতো হবে। সাযযাদ কাদির লিখেছেন একবার দৈনিক বাংলায় লেখা জমা দিতে গিয়ে শুনলাম ফজল শাহাবুদ্দীন নাকি তাদের লিস্টে সর্বশেষ কবি। এর বাইরে অন্য কারও কবিতা ছাপানো যাবে না। বলা বাহুল্য, এ ধরনের উক্তি যে কোন তরুণ কবির জন্য তাজ্জব কথা বলে বিবেচিত হবে। মোয়া মুড়কির মতো কবিতা ছাপানোর ফ্যাশান সম্ভবত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শুরু হয়েছে। কিন্তু তার আগে একটা সময় ছিল হুমায়ূন কবীর যখন কোন তরুণ কবির কবিতা ‘চতুরঙ্গে’ ছাপাতেন কিংবা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ হলে পাঠক মহলে রীতিমতো আলোড়ন তুলত। তার কারণ ছিল, দুজনেই ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক। তাদের যোগ্যতা নিয়ে পাঠক মহলে তেমন কোন প্রশ্ন উঠত না। সবচেয়ে বড় কথা ডান বাম এই দুই সম্প্রদায়েরই ভাল কবিতা এই দুই পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। বুদ্বদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাশাপাশি বিষ্ণু দে’র এমনকি মঙ্গলাচরণ চট্টপাধ্যায়ের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থের ওপর মনোরম, সপ্রশংস দীর্ঘ আলোচনা করেন, বলা যায় যে ওই সমালোচনার বদৌলতেই সুভাষের প্রতিষ্ঠা অর্জিত হয়ে যায়।লেখার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন, এই তথ্য এখন অবধি অনেকের কাছে হাস্যাস্পদ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাধারণ পাঠকদের সোজা সাপটা উত্তর এরকম কবিতা আমরা লিখতে পারি। লিখিনি তাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ বিশ্বাস নষ্টের মূলে বিশিষ্ট কবিদের সঙ্গে অপকবিরাও দায়ী। আমার এ মন্তব্য অনেকের কাছে রুঢ় রুদ্র বলে মনে হতে পারে। এক্ষেত্রে আমি অনন্যোপায়। অবশ্য অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন কবিতা কারা লিখবেন? এর উত্তর তো জীবনানন্দ দাশ অনেক আগেই দিয়ে গেছেন, ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধ গ্রন্থ থেকে খানিকটা তুলে ধরলে আমার বক্তব্য পরিষ্কার হবে। ‘শুধুমাত্র যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও ভেতরের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবক্তা রয়েছে।’
×